
ছবি: সংগৃহীত
ছোট বেলা থেকেই বাবা তোফাজ্জেল ফকিরের সাথে চা তৈরি করতেন আলতাফ মাহমুদ। বছরের পর বছর চা সেই গতানুগতিক চা বিক্রি করলেও জীবনকে বদলাতে পারেননি তারা। অভাব ও কষ্টের মধ্যে জীবন পার করেছেন। ছোট চায়ের দোকানটিই ছিলো তাদের একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম। সেই মাধ্যমটিকে কিভাবে কাজে লাগিয়ে আরো বেশি আয় করা যায়, তাই ভাবতে থাকেন আলতাফ। এরপর করোনা ভাইরাসের সময় ২০২১ সালের শুরুর দিকে ইউটিউবের মাধ্যমে কলকাতার তান্দুরী চা বানানোর কৌশল শিখে নেন তিনি। এরপর থেকেই শুর হয় তার তান্দুরী চায়ের ব্যবসা। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই লাভের মুখ দেখতে থাকেন আলতাফ। মানুষের মুখে মুখে জেলাসহ আশে-পাশের জেলাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে তান্দুরী চায়ের স্বাদের প্রশংসা। তাই চাপ্রেমীরা মাটির ছোট্ট ও মাঝারী কাপে তান্দুরী চা খেতে দুর-দুরান্ত থেকে আসতে শুরু করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদারীপুর সদর উপজেলার ঘটকচর এলাকার তোফাজ্জেল ফকিরের ছেলে আলতাফ মাহমুদ (৩০)। এক সময় বাড়ির কাছে পার্শবর্তী পেয়ারপুর বাজারে খুপরি দোকানে বাবা চা তৈরি করে বিক্রি করতেন। সেই বিক্রির টাকায় চলতো তাদের সংসার। সেই চায়ের দোকানে ছোট বেলা থেকেই বাবার সাথে চা বানাতেন আলতাফ মাহমুদ। প্রায় ১৫ বছর ধরেই তিনি চায়ের ব্যবসা করে আসছেন। প্রায় ৭ বছর আগে তার বাবা মারা যান। এরপর পুরো দোকানের দায়িত্ব এসে পড়ে তার উপর। বছরের পর বছর চা বিক্রি করেও ভাগ্য পরিবর্তন করতে না পারায়, কি করা যায় এ নিয়ে নতুন করে ভাবনায় পড়েন তিনি।
২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে করোনা ভাইরাস মহামারি শুরু হলে বেচাকেনাও কমে যায় আলতাফের। এরপর ঘরে বসে মোবাইলে ইউটিউবের মাধ্যমে কলকাতার তান্দুরী চা বানানোর কৌশল শিখে নেন। মাদারীপুরের এই গ্রামের মধ্যে তান্দুরী চা বিক্রি হবে কিনা তা নিয়েও তিনি চিন্তায় পড়েন। ভাবেন একবার শুরু করে দেখি কি হয়। ২০২১ সালের প্রথম দিকে শুরু করেন তান্দুরী চায়ের ব্যবসা। দোকানের নাম রাখেন আফতাফ তান্দুরী চা ঘর। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সারা জেলাসহ আশে-পাশের জেলাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে তান্দুরী চায়ের স্বাদের প্রশংসা। শীতের সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে এই চা খেতে হয়। এখন চলছে বারোমাস। প্রথম দিকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার চা বিক্রি হতো। এরপর আলতাফকে দেখে অনেকেই মাদারীপুরের মস্তফাপুর, রাজৈর, কালকিনিসহ বেশ কিছু জায়গায় তান্দুরী চায়ের ব্যবসা শুরু করেন। তাই তার ব্যবসায় কিছু কমেছে। বর্তমানে তিনি প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার টাকার তান্দুরী চা বিক্রি করেন। এতে মাসে তার দেড় লাখ টাকার চা বিক্রি হয়। তবে শীতের সময় প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ হাজার টাকার তান্দুরী চা বিক্রি হয়।
খোজ নিয়ে আরো জানা গেছে, গরম পানি, চায়ের লিকার, কাজু বাদামের গুড়ো, কালোজিরা, থ্রি ওয়ান চা, দুধের স্বর, ট্যাংক, চিনি, গুড়ো দুধ, তরল দুধ, ওভালটিন, চকলেটের গুড়োসহ প্রায় ১০ থেকে ১২ রকমের বিভিন্ন খাদ্য উপাদান দিয়ে তৈরি করেন তান্দুরী চা। গরম এই চা মাটির তৈরি ছোট্ট হাঁড়িতে ঢেলে চা পিপাসুদের পরিবেশন করেন আলতাফ। পোড়া মাটির গন্ধে ভরপুর এই সুস্বাদু চা পান করতে আলতাফ তান্দুরী চা ঘরে প্রতিদিন বিকেল ৩ টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চা পিপাসুদের লাইন লেগেই থাকে। তবে শুক্রবার তিনি দোকান বন্ধ রেখে পরিবারের সাথে সময় কাটান।
শুধু তান্দুরী চা নয়, এখানে আরো নানা ধরণের চা পাওয়া যায়। ‘চায়ের সাথে কাপ চিবিয়ে খাবেন’ এই শিরোনামে চকলেট চা বিস্কুট কাপ ৫০ টাকা, চকলেট কপি বিস্কুট কাপ ৬০ টাকা, মাটির কাপে করে তান্দুরী চা ৩০ টাকা, তান্দুরী চকলেট চা ৫০ টাকা, কফি তান্দুরী চা ৫০ টাকা, পেপার কাপে দুধ চা ১০ টাকা, মালাই চা ২০ টাকা, কফি রেগুলার ৩০ টাকা ও গ্রীণ চা ১০ টাকা করে বিক্রি করেন।
কুনিয়া ইউনিয়নের আদিত্যপুর থেকে আসা সানজিদা আক্তার বলেন, ‘এখানে অনেকেই চা খেতে আসেন। বিশেষ করে তান্দুরী চায়ের স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয়। তাই আমি প্রায় আসি এখানে এই চা খেতে।’ শহরের ১নং শকুনি এলাকা থেকে আসা তানমিরা বলেন, ‘যখন ইচ্ছে হয়, তখন স্বামীর মোটরসাইকেলে করে এতদুরে এসে তান্দুরী চা খাই। এই চায়ের খুব নাম আছে, তাই সুযোগ পেলেই পরিবারসহ এখানে চলে আসি।’ আয়ান হাসান নামের ৯ বছরের এক শিশু বলেন, ‘আমি মায়ের সাথে প্রায় আসি এখানে চা খেতে। তান্দুরী চায়ের মধ্যে চকলেট থাকে, তাই খেতে আমার খুব ভালো লাগে।’
স্থানীয় তানিয়া আক্তার বলেন, আলতাফের চা মানেই মজা। অনেক দুর থেকে এখানে চা খেতে মানুষজন আসেন। তাছাড়া আমাদের গ্রামেও নতুন কেউ বেড়াতে এলে আলতাফের চা না খেয়ে যায় না। আলতাফের চা এর দোকানের জন্যই এই বাজারটা জমে উঠেছে।’
চা বিক্রেতা আলতাফ মাহমুদ বলেন, ‘আমি ইউটিউব দেখে এই চা বানানো শিখে মাটির কাপে করে তান্দুরী চা বিক্রি শুরু করেছি। প্রথম দিকে আমি একা তান্দুরী চা বানালেও বর্তমানে অনেকেই এই চা বানিয়ে তা বিক্রি করে বেকারত্ব দুর করেছেন। আর্থিক সংকটে লেখাপড়া খুব বেশি করা হয়নি। পরিবারের চাহিদা মেটাতে বাড়ির পার্শ্ববর্তী পেয়ারপুর ইউনিয়নের পেয়ারপুর বাজারে বাবার ছোট্ট চায়ের দোকানেই আজ আমার ভাগ্য বদল হয়েছে। তবে দোকানটি এখন একটু বড় করে সাজিয়ে নিয়েছি। শুধুমাত্র চা বিক্রি করে পরিবারে স্বচ্ছলতা আনতে পারবো, তা কখনও ভাবিনি।’
ঘটকচর এলাকার দুলাল সরদার বলেন, “আলতাফের তান্দুরী চায়ের স্বাদই আলাদা। একটা চায়ের দোকান যে একজন অসহায় মানুষকে স্বাবলম্বী করতে পারে আলতাফ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। জেলার বিভিন্ন স্থানে আরো কয়েকটি তান্দুরী চায়ের দোকান হয়েছে, তবে এই চায়ের উদ্যোক্তা আলতাফ মাহমুদ। আগে শীতের সময় বেশি বিক্রি হতো, এখন বারোমাসই আলতাফের দোকানে তান্দুরী চা বিক্রি হচ্ছে। আমার বাড়ির পাশে হওয়ায় আমিও মাঝে মধ্যে যাই। ওর দোকানের কারণে বাজারটাও জমে উঠেছে।’
পেয়ারপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লাবলু হাওলাদার বলেন, আমাদের পেয়ারপুর বাজারের আলতাফ তান্দুরী চা ঘরের এই অসাধারণ স্বাদের তান্দুরী চা প্রশংসার দাবীদার। আমাদের এই পেয়ারপুর বাজারটি তন্দুরী চাকে কেন্দ্র করে জমজমাট হয়ে উঠেছে। আলতাফ তার তান্দুরী চায়ের মাধ্যমে ভাগ্যের পরিবর্তন এনেছে।’
আসিফ