
গ্রীষ্মের ফুল কৃষ্ণচূড়া। সম্প্রতি ঢাকাÑময়মনসিংহ আঞ্চলিক সড়কের পাশ থেকে তোলা
কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন ‘যেখানে সবুজ ডাঙ্গা ভ’রে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল; সেখানে গাছের নাম : কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল;’ স্বর্ণালি রঙের শোভায় প্রকৃতিকে আরও নয়নাভিরাম রূপে সাজাতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করে না সোনালু ফুল।
কৃষ্ণচূড়া গ্রীষ্মের অতি পরিচিত ফুল। বাঙালির কবিতা, সাহিত্য, গানও বিভিন্ন উপমায় কৃষ্ণচূড়া ফুলের নাম ভিন্ন ভঙ্গিমায় এসেছে। কাজী নজরুল ইসলামের মনোমুগ্ধকর গান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কৃষ্ণচূড়ার তাৎপর্য। ‘কৃষ্ণচূড়া রাঙা মঞ্জরি কর্ণে-আমি ভুবন ভুলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে।
প্রকৃতি ও পরিবেশের শোভা বর্ধনে সোনালু ফুলের ভূমিকা অনেক। সোনালি রঙের ফুলের বাহার থেকেই সোনালুর নামকরণ। যার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ঈধংংরধ ঋরংঃঁষধ, পরিবার ঈধবংধষঢ়রহধপবধব. এই ফুলের আদিনিবাস হিমালয় অঞ্চল হলেও বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমার অঞ্চলজুড়ে রয়েছে এর বিস্তৃতি। গাছটি সাধারণত ১৫ থেকে ২০ মিটার উঁচু হয়ে থাকে।
উঁচু থেকে মাঝারি উঁচু ভূমি সোনালু ফুল উৎপাদনের জন্য উপযোগী। স্বভাবে এরা পত্রঝরা বৃক্ষ, শীতে গাছের সমস্ত পাতা ঝরে যায়। পত্রশূন্য শীত পেরিয়ে বসন্তের শেষে ফুল কলি ধরার পূর্বে গাছে নতুন পাতা গজায়। গ্রীষ্মে গাছের শাখা-প্রশাখাজুড়ে ঝুলন্ত মঞ্জরিতে সোনালি হলুদ রঙের ফুল ফোটে এবং এর ব্যাপ্তি থাকে গ্রীষ্মকালজুড়ে।
ফুল থেকে গাছে ফল হয়। ফলের আকার দেখতে সজিনা সবজির আকৃতির। তবে সজিনার গায়ের চামড়াতে ঢেউ তোলা, যা সোনালু ফলে নেই। চামড়া মসৃণ। এটি লম্বায় প্রায় এক ফুট হয়। প্রথমে সবুজ ও ফল পরিপক্ক হলে কালচেখয়েরি রঙ ধারণ করে। ফলে বীজ হয়। ফলবীজ থেকে বংশ বিস্তার ঘটে।
কোনো কোনো অঞ্চলে সোনালু গাছকে বানর লাঠি গাছ বলতে শোনা যায়। সোনালু গাছের বাকল- পাতায় ঔষধি গুণাগুণ রয়েছে। অজ্ঞতা, অবহেলায় এই গাছ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। প্রকৃতি হারাচ্ছে গ্রীষ্মকালে স্বর্ণালি রঙের সৌন্দর্য শোভায় চিরচেনা বাংলার রূপ।
কৃষ্ণচূড়া ॥ কৃষ্ণচূড়ার আদিনিবাস মাদাগাস্কার। পরিবার খবমঁসরহড়ংধব, বৈজ্ঞানিক নাম উবষড়হরী ৎবমরধ. তবে এই ফুল বাংলাদেশের প্রকৃতি, পরিবেশ ও ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে মিশে আছে যুগ যুগ ধরে। বসন্তের শেষে গ্রীষ্মের আগমনী বার্তা নিয়ে প্রকৃতিকে নতুন করে সাজিয়ে তোলে কৃষ্ণচূড়া। গাছের ডালে সবুজ পাতার ফাঁকে উঁকি দেওয়া টকটকে লাল রঙের বাহারি ফুলে ভরে যায় গাছ।
গন্ধহীন, পাঁচ পাপড়ি, নমনীয়, কোমল, মাঝে লম্বা পরাগদ- অবস্থিত। ফুল ফুটন্ত কৃষ্ণচূড়ার মনোরম দৃশ্য দেখে পথিকের পথচলা থেমে যায়। মনে আনন্দের ঢেউ জাগে। পত্রঝরা বৃক্ষ, শীতে গাছের সমস্ত পাতা ঝরে যায়। বসন্তে গাছে নতুন পাতা গজায়। ক্ষুদ্র, যৌগিক ও চিরুনির মতো সাজানো থাকে পাতা। ফুল শেষে গাছে ফল ধরে। আকার চ্যাপ্টা লম্বা, দেখতে তলোয়ার শিমের আকৃতির। ফলের রঙ প্রথমে সবুজ, পরিপক্ক হলে কালচে রঙ ধারণ করে। ফলের অভ্যন্তরে বীজ হয়। বীজের রঙ কালো। এর মাধ্যমে বংশ বিস্তার হয়। দ্রুত বর্ধনশীল।
সাধারণত বীজ অথবা চারা রোপণের ৫ থেকে ৬ বছর বয়সে গাছে ফুল ফোটে। উঁচু ভূমি কৃষ্ণচূড়া গাছ উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত স্থান। অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পার্ক, সড়ক-মহাসড়কের ধারে ও অন্যান্য স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে সুউচ্চ কৃষ্ণচূড়া চোখে পড়ে।
জারুল ॥ ফুলটির ইংরেজি নাম Giant Crape-myrtle, পরিবার : Lythraceae, বৈজ্ঞানিক নাম : Lagerstroemia Speciosa. বৃক্ষজাতীয় জারুল ফুলের আদি নিবাস শ্রীলঙ্কা। নীলাভ ও গোলাপি দুই রঙের জারুল ফুল বাংলাদেশের সর্বত্র চোখে পড়ে। এই পাতাঝরা বৃক্ষ শীতকালে পত্রশূন্য থাকে। বসন্তে গাঢ় নতুন সবুজ পাতা গজায়। জারুলের দৃষ্টিনন্দন রং ও রূপ নয়নাভিরাম। ফুলে পাপড়ি ছয়টি।
ফুলের মাঝখানে হলুদ রঙের পরাগ রয়েছে। সাধারণত ১০ থেকে ১৫ মিটার উঁচু হয়। গাছের পাতা সবুজ, পুরু ও বেশ বড়। শাখা-প্রশাখা কাঠ-শক্তমানের, শাখা-প্রশাখার অগ্রভাগে বোঁটায় অসংখ্য ফুল ফোটে। বোঁটার নিচ থেকে প্রথমে ফুল ফোটা শুরু হয়। বোঁটার সামনের দিকে ধীরে ধীরে ফুল ফোটে।
গ্রীষ্মের শুরুতে ফুল ফোটে এবং শরৎ পর্যন্ত দেখা যায়। ফুল শেষে গাছে বীজ হয়। বীজ দেখতে গোলাকার। এর মাধ্যমেই বংশ বিস্তার হয়। জারুল ভারতীয় উপমহাদেশের নিজস্ব বৃক্ষ। বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও চীন, মালয়েশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে এই গাছের দেখা মেলে। নিম্নাঞ্চলের জলাভূমিতেও এটি বেড়ে উঠতে পারে।
আবার শুকনো এলাকাতেও এদের মানিয়ে নিতে সমস্যা হয় না। জারুল কাঠ লালচে রঙের, অত্যন্ত শক্ত ও মূল্যবান। ঘরের কড়ি-বগড়া, লাঙ্গল, আসবাবপত্র ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। জারুল গাছের ভেষজ গুণাগুণ রয়েছে। এর বীজ, ছাল ও পাতা ডায়াবেটিস রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া জ¦র, অনিদ্রা, কাশি ও অজীর্ণতায় জারুলের ব্যবহার লক্ষণীয়।
গফরগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এন এম আব্দুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রকৃতির পরিবেশ রক্ষায় প্রশাসন সবসময় সচেষ্ট। আর এ কারণেই উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় সোনালু, কৃষ্ণচূড়া ও জারুল ফুলের গাছ লাগানোর ব্যাপারে আমরা ভাবছি। গাছ লাগালে পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক থাকে। মানুষ প্রাকৃতিক অক্সিজেন পায়।