
কলাপাড়া : মানবেতর জীবনযাপন করা রাবনাবাদ পাড়ের অসহায় মানুষেরা
মধ্য বয়সেই ফিরোজা বেগম বার্ধক্যের ধকলে পড়েছেন। চোখেমুখে চরম হতাশা। জীবনের সাজানো গোছানো সংসার তছনছ হওয়ার কষ্টে মানুষটার এমন অবস্থা হয়েছে। তিন সন্তান আর স্বামী নিয়ে ছিল তার সাজানো সংসার। পুকুরে মাছ ছিল, কৃষি জমিতে চাষাবাদ, রবিশস্যের আবাদ করতেন। স্বামী আবু জাফর মসজিদের ইমাম ছিলেন। ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করত। পাঁচ জুনিয়া গ্রামেই অনাবিল সুখ না থাকলেও ছিল স্বস্তির বসতি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া একটি পরিবেশ বিনাশী উন্নয়ন প্রকল্প আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জমি অধিগ্রহণের কারণে বাড়িঘর হারা হয় ফিরোজা বেগম। এক পর্যায়ে সন্ত্রাসী স্টাইলে একটি মধ্যস্বত্বভোগী চক্র ও পুলিশি হয়রানিতে চাপের মুখে ২০২০ সালের শেষ দিকে অন্যদের মতো বাড়িঘর ছাড়তে হয়েছে। উপায় না পেয়ে আশ্রয় নেন রাবনাবাদ নদীর তীরে বাঁধের কান্ট্রি সাইডের স্লোপে। সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে এখন ফিরোজার বসবাস। ঘরের নিচে পচা পানি। খাবার পানি নেই। এক কিলোমিটার দূর থেকে আনতে হয়। রান্নাসহ গোসলের পানির অভাব। সামনে নদীর তীব্র ভাঙন আর পেছনে পাওয়ার প্লান্টের সীমানা প্রচীর। মাঝখানে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার মধ্যেই বসবাস। এক অসহনীয় অবস্থা। ঘর নয় যেন বস্তি। রোগব্যধি লেগেই আছে। এমনসব অসহনীয় কষ্টের মধ্যে এক বছর আগে এ মানুষটার স্বামী আবু জাফর পরপারে চলে গেছেন। অনার্স পড়ুয়া ছেলে হেলাল উদ্দিন এখন মসজিদের ইমামের দায়িত্ব নিয়েছেন। চারটি বছর ধরে ফিরোজা বেগমের এমন কষ্টের দিন চলছে। শুনেছেন আবাসন পুনর্বাসনে তার মা একটি ঘর পাবেন। কিন্তু কবে সেখানে যেতে পারবেন তাও জানা নেই। বয়োবৃদ্ধা রাশিদা বেগম বলেন, ‘বাড়িঘর থেইক্যা নামাইয়া দেছে চাইর বছর আগে। ভেকু দিয়া ঘর ভাইঙা দিছে। এহন খালের মধ্যে থাহি। হাস মোরগ, গরু-ছাগল পানিতে ভাসাইয়া নেছে। রান্না করতে পারি না। ঘর-দুয়ারের টাহা খাইয়া ফালাইছি। আর পারি না।’ এক পর্যায়ে কান্নাজুড়ে দেন।
একই দশা ছয় জনের সংসার নিয়ে রাসেল ফকিরের। মানুষটি জানালেন, সাজানো সংসার ছিল। কৃষি জমি চাষাবাদ করতেন। পুকুরে মাছ চাষ করতেন। গবাদিপশু পালন করতেন। আমন-আউশ, রবিশস্যের আবাদ করতেন।
একই পরিণতি ভোগ করছেন হেলাল ফকির, জাকির ফকির, শাহজাহান ফকির, স্বপন ফকির, লিটন ফকির, ছোবাহান মৃধা, হনুফা বেগম, মন্নান গাজী, রুবেল সিকদার, রুহুল আমিন সিকদার, রাশেদা বেগমসহ অন্তত ৩০টি পরিবার। এসব পরিবারের দুরবস্থা চোখে না দেখলে বোঝানো সম্ভব নয়। চলাচলের পথটি পর্যন্ত নেই। তাদের ভাষায়, ‘তিন বেলা খাওন জোটে না। উপোস করতে হয়। পানি নাই। বিদ্যুৎ নাই। নদীতে মাছ নাই। গোসল-রান্নার পানি নাই। অসুখ-বিসুখ লাইগ্যা আছে।’ অপরিকল্পিত একটি উন্নয়ন পরিকল্পনার শিকার হয়ে এসব মানুষ জীবন বিপন্নের চরম ঝুঁকিতে রয়েছেন।
এখানকার অন্তত ৩২টি পরিবারের ৪০ জন শিশুসহ প্রায় পৌনে দুইশ’ মানুষ কার্যত বন্দিদশায় পড়েছেন। মানবেতর অবস্থায় চারটি বছর কাটছে তাদের। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ সব ধরনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। তারা বর্তমান সরকারের কাছে ন্যূনতম বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিতের দাবি করেছেন। কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রবিউল ইসলাম জানান, তিনি খোঁজখবর নিয়ে অসহায় এই পরিবারগুলোকে কীভাবে সহায়তা করা যায় তা করবেন।
প্যানেল