জোয়ার-ভাটার পানির প্রবাহ বন্ধ করে গাছগুলো মেরে ফেলা হচ্ছে।
কলাপাড়ায় বেড়িবাঁধের বাইরের ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল নিধন চলছে ফ্রি-স্টাইলে। ফলে সবুজ দেয়ালখ্যাত ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটার প্রাথমিক রক্ষাকবচ থাকছে না। বাঁধগুলো অরক্ষিত হয়ে গেছে। ঝুঁকি বেড়েছে বাঁধের। পাশাপাশি তীব্র ঝড়-জলোচ্ছ্বকালীন মানুষের জীবন ও সম্পদের ঝুঁকি বাড়ছে। ম্যানগ্রোভ প্রজাতির ছইলা, কেওড়া ও গোলগাছের বাগানে মাছের ঘের থেকে বাড়িঘর করায় জোয়ার-ভাটার পানির প্রবাহ বন্ধ করে গাছগুলো মেরে ফেলা হচ্ছে। একসময় মরা গাছ কেটে করা হয় বিরাণভূমি। এই নিধন প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।
কলাপাড়ায় গত দুই যুগে বেড়িবাঁধের বাইরের প্রায় দুইশ’ কিলোমিটার এলাকার ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল উজাড় করা হয়েছে। এখন যেটুকু আছে তাও ধ্বংসের শেষ পেরেক মারা হচ্ছে। লতাচাপলী, মহিপুর, মিঠাগঞ্জ ও ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের বিভিন্ন বেড়িবাঁধের বাইরের ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল নিধনের ভয়াবহ দৃশ্য দেখা গেছে। ম্যানগ্রোভ প্রজাতির প্রাচীন গাছগুলোকে চারদিকে বাঁধ দিয়ে শত শত পুকুরসহ মাছের ঘের করা হয়েছে। একেকটি মাছের ঘের কিংবা বদ্ধ পুকুরের মধ্যে ৫-৬ থেকে ১০-১২টি প্রাচীন গাছ দাড়িয়ে আছে। জোয়ার-ভাটার পানির প্রবাহ আটকে দেওয়ায় গাছগুলো ক্রমশ বিবর্ণ হয়ে গেছে। লতাচাপলী ইউনিয়নের আলীপুর থেকে চাপলী বাজারে যেতে বেড়িবাঁধের বাইরে এমনদৃশ্য দেখা গেছে। একই দৃশ্য রয়েছে বিভিন্ন ইউনিয়নে।
আশির দশকেও বাঁধের বাইরে ২০-৫০ মিটার প্রস্থ ছইলা-কেওড়া, গেওয়া, গোলপাতা, বাইনসহ গুল্মজাতীয় গাছপালা লতাপাতায় আচ্ছাদিত ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল ছিল। বাঁধের ওপর দিয়ে চলতে গেলে শরীর ছম ছম করত। বন্যপ্রাণী বসবাস করত। সন্ধ্যার পরে বেড়িবাঁধে মানুষ শেয়ালের ভয়ে চলাচল করতে ভয় পেত। আর এখন এসব বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বনাঞ্চল ছিল লতাচাপলী, কুয়াকাটা, ধুলাসার, বালিয়াতলী, মিঠাগঞ্জ, ডালবুগঞ্জ, মহিপুর, ধানখালী, চম্পাপুর ও লালুয়ায়।
লতাচাপলী ইউপির বাসীন্দারা জানান, ইউনিয়নে প্রায় ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। বর্তমানে এই বাঁধের বাইরের, আশি শতাংশ এলাকার ম্যানগ্রোভ বাগান নেই। এগুলো থাকলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস গাছের ওপর আছড়াইয়া পড়তো। এখন তো বাঁধের ওপর পড়বে। দূর্যোগকালীন জলোচ্ছ্বাস ঝুঁকি বাড়ছে। গঙ্গামতির ধোলাইর মার্কেটের দোকানি সাইফুল ইসলাম জানান, এই বাঁধের দুই দিকে গভীর বন ছিল। যা ২০০১ সাল থেকে ধ্বংস শুরু হয়। সবশেষ গত তিন-চার বছরে বাঁধ মেরামত করতে গিয়ে বাকি বনাঞ্চল উপড়ে ফেলা হয়েছে। এখন নতুন করা বেড়িবাঁধও পানির ঝাপটায় ভেসে যাবে। কারণ পানির ঝাপটা প্রতিরোধের মতো বাঁধের বাইওে তেমন কোন গাছপালা নেই। মধুখালী লেক এর দুইদিকে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল দখল করে করা হয়েছে অসংখ্য বাড়ি-ঘর। এখনও প্রাচীন গাছ দাঁড়িয়ে আছে অথচ ওই বনাঞ্চল চাষযোগ্য কৃষিজমি দেখিয়ে বহু আগে বন্দোবস্ত দেয় স্থানীয় ভূমি অফিস।
ধুলাসার ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল জানান, এই বাগান দূর্যোগকালে দেওয়ালের মতো জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটা ঠেকায়। এখন বেড়িবাঁধের বাইরের ভেতরের কোন গাছপালা, বনাঞ্চল নেই। কেটে সাবাড় করে দেয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার অফিসসূত্রে জানা গেছে, কলাপাড়া উপজেলায় প্রায় ৩৩০ কিলোমিটার বন্যানিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ রয়েছে। এই বাঁধের দুই রিভার সাইটে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল ছিল।
বনবিভাগ মহীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, লতাচাপলী ইউনিয়নের বাঁধের বাইরের জমির ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনাঞ্চল থাকা অনেক জমি রেকর্ডিয় মালিকানা দাবি করে মামলা পর্যন্ত দিয়েছে একটি মহল। ফলে ওইসব গাছ রক্ষা কঠিন হয়ে গেছে। তবে বনাঞ্চলের অধীন ম্যানগ্রোভ গাছ রক্ষায় তারা সচেষ্ট রয়েছেন বলে জানান এ কর্মকর্তা। গাছ ও বনবিভাগের জমি রক্ষায় বনদস্যুসহ দখলদারের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। তবে নিয়ম রয়েছে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছ কেউ নিধন করতে পারবে না। কিন্তু এসব নিয়মের তোয়াক্কা করছেন না।
এম হাসান