ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে দুর্বৃত্তদের হামলার পর শিক্ষার্থীরা সেখানে দেওয়াল লিখন ও গ্রাফিতি আঁকেন
বড় একটা পরিবর্তন ঘটে গেল দেশে। চোখের সামনে বদলে গেল অনেক কিছু। এখন কী চায় শিক্ষার্থীরা? চাওয়াগুলো রাজধানীর দেওয়ালে দেওয়ালে রং তুলি দিয়ে লিখে রাখছে তারা। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আশপাশের এলাকায় দিনভর গ্রাফিতি আঁকতে দেখা যাচ্ছে। বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল অতীত, লড়াই সংগ্রামের অজেয় ইতিহাস এবং বর্তমানের নানা ছবি ফুটিয়ে তুলছে তারা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু গান কবিতা রচিত হয়েছিল। জাগরণী গান কবিতায় বাঙালির দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম, আত্মত্যাগ এবং রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস বিধৃত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা স্বাধীন বাংলা বেতারের সেইসব গান থেকে পঙ্ক্তি বাছাই করে দেওয়ালে লিখে রাখছে। একইভাবে চোখে পড়ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নানা উক্তি। মহান নেতার বিভিন্ন সময়ে দেয়া বক্তৃতা থেকে এসব বাণী সংগ্রহ করে দেওয়ালে লিখেছেন শিক্ষার্থীরা। মুজিবের কণ্ঠেই যেন কথা বলার চেষ্টা করেছেন।
একই চেতনার জায়গা থেকে গ্রাফিতি হয়েছে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটি ঘিরেও। বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী এই ভবন। এখানে থেকেই অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি সংগ্রামের পথরেখা তৈরি করেছেন। মুক্তিকামী মানুষের মিছিল এসে থামত এই বাড়ির আঙিনায়। পরবর্তীতে এখানে গড়ে তোলা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর। কিন্তু গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর পরই একদল দুষ্কৃতকারী ভবনটিতে হামলা চালায়।
নিষ্ঠুর আগুনে পুড়ে যায় গোটা জাদুঘর। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আশপাশের কলেজের শিক্ষার্থীরা এখানে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন। ওই সময় জাদুঘরে আগুন দেওয়ার বিরোধিতা করেন তারা। আর বর্তমানে সেখানে চলছে গ্রাফিতি আঁকার কাজ।
বুধবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সবই পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এর পরও দু’-একটি দেওয়াল বা পিলার রং করে নিয়ে সে সবের ওপর গ্রাফিতি করা হয়েছে। লেকের পাড়ে জাতির পিতার যে মন্যুমেন্টে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হতো সেটিও এখন আর চেনা যায় না। তবে প্রতিকৃতিটি নতুন করে আঁকা হয়েছে। দৃশ্যমান করা হয়েছে। প্রতিকৃতির পাশে ধ্বংসের চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দেওয়াল। সেই দেওয়ালে লেখা হয়েছে : ‘একটা আঙুল তাক করা আসমানে/অর্থ যেটার স্বাধীনতাÑ/বিশ্বজুড়ে মানুষ/শিশির ঘাস জানে।’
এখান থেকে প্রশস্ত যে সিঁড়িটি নিচে নেমে জল ছুঁয়েছে সেখানেও গ্রাফিতি। অঙ্কনের পাশাপাশি তাতে শিক্ষার্থীরা লিখেছে, ‘বর্তমান যদি অতীতকে ধারণ না করে তবে ভবিষ্যৎ হবে শূন্যতায় পূর্ণ।’ এ ছাড়াও এখানে ওখানে লেখা রয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গ্রাফিতি আঁকার কাজ করেছেন কার্টুনিস্ট মোরশেদ মিশুও। তিনি আগুনে পোড়া বাড়ির সামনে করা গ্রাফিতির ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধু ভবন ও জাদুঘরে যারা আগুন দিয়েছে তারা দুর্বৃত্ত। বাস্তবতা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর প্রতি শিক্ষার্থীদের কোনো ক্ষোভ নেই। তারা তাঁকে শ্রদ্ধা করেন। গ্রাফিতিতে সেই শ্রদ্ধাই ফুটে উঠেছে। শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধুর ইতিহাসকে আজীবন স্মরণ করবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
এদিকে, বঙ্গবন্ধু ভবনের পাশেই মাস্টারমাইন্ড স্কুল। ইংরেজি মাধ্যমের এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা এখনো গ্রাফিতির কাজ করছেন। তাদের স্কুলের সব দেওয়ালজুড়ে চিত্রকর্ম। একাধিক চিত্রকর্মে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের দেওয়া পতাকার ছবি। সহজে আঁকা যায় বলেই হয়তো লাল সবুজের পতাকাটা ওরা খুব আঁকছে। দেখে সেই অমর কবিতা মনে পড়ে যায়, যেখানে বলা হচ্ছে, ‘ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের ওপর পতাকার মতো/দুলতে থাকে স্বাধীনতা।’