ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

নভেম্বর থেকে সহজ হবে দেশের আকাশ ও সাগর পাহারা

এক রাডারেই নজরদারি

আজাদ সুলায়মান

প্রকাশিত: ২৩:৪৩, ১২ জুন ২০২৪

এক রাডারেই নজরদারি

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণ পাশে স্থাপন করা সর্বাধুনিক রাডার

বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ সমুদ্রসীমাসহ বাংলাদেশের আকাশ নজরদারি করতে বহুল প্রতীক্ষিত রাডার স্থাপনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ না হলেও এখন সেই রাডার দিয়েই দেশের আকাশ পরীক্ষামূলকভাবে নজরদারি করা হচ্ছে। তবে নভেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দেশের সমুদ্র ও আকাশ নজরদারির আওতায় আসবে। 
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেশের আকাশে নজরদারির জন্য প্রয়োজনীয় রাডার স্থাপন প্রকল্পের কাজ এখন শেষের পথে। এটিসি টাওয়ার ও অপারেশন বিল্ডিংয়ের চলমান কাজও প্রায় শেষের পথে। অবশ্য কাজ শেষ না হলেও এখন নতুন রাডার দিয়েই চলছে গোটা দেশের আকাশের নজরদারি। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ সমুদ্রও চলে এসেছে এই রাডারের আওতায়।

এখন শুধু বাকি আনুষ্ঠানিকভাবে এটা উদ্বোধনের। তবে এই রাডার ও নেভিগেশনের পুরো সুবিধা পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছু সময়। রাডারের কাজের সঙ্গে অটোমেশনের আরও কিছু আনুষঙ্গিক কাজ বাকি রয়েছে, সেগুলো শেষ করতে এ বছরের বাকি সময়টাই লেগে যাবে। 
এ প্রকল্পের স্থানীয় প্রতিনিধি অ্যারোনাস জানিয়েছে, আগামী নভেম্বরের মধ্যেই বাকি কাজ শেষ করে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে। বহুল আলোচিত এই প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৭৩০ কোটি টাকার পুরোটাই নিজস্ব তহবিল থেকে দেবে বেবিচক। অত্যাধুনিক এই রাডার ব্যবস্থা চালু হওয়ায় এখন উড়োজাহাজ চলাচল আরও নিরাপদ হয়েছে।

একইসঙ্গে নজরদারির আওতায় এসেছে দেশের পুরো আকাশ। এতে দেশে অবতরণ না করে যেসব উড়োজাহাজ বাংলাদেশের আকাশ ব্যবহার করে সেগুলো থেকেও ফি আদায় করা যাচ্ছে। ফলে দেশ আর্থিকভাবে লাভবান হবে।
বেবিচক সূত্রমতে, বর্তমানে ব্যবহৃত ৪৪ বছরের পুরনো রাডার ও নেভিগেশন ব্যবস্থার কারণে বঙ্গোপসাগরের বড় একটি অংশের পাশাপাশি দেশের পুরো আকাশ নজরদারির আওতায় নেই। এতে ওভার ফ্লাইং ফি পুরোপুরি আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ একবার আকাশ ব্যবহারের জন্য ‘ফ্লাইং ওভার ফি’ প্রায় ৫০০ ডলার।

এতদিন পূর্ণাঙ্গ রাডার সিস্টেম না থাকায় নিরাপত্তা ঝুঁকির পাশাপাশি আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ। এ প্রসঙ্গে বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, ‘সরকারের কাছ থেকে আমরা রাডার প্রকল্পে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছি। বেবিচকের নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থায়নে প্রকল্পটি দ্রুততার সঙ্গে শেষ করা হয়েছে। রাডার ব্যবস্থাপনার জন্য যে স্থাপনা, সেটির কাজ হয়ে গেছে।

ফ্রান্স থেকে রাডারের টাওয়ার স্থাপনের স্টিল স্ট্রাকচার এনে দাঁড় করানো হয়েছে। এটিসি টাওয়ার এবং অপারেশন বিল্ডিংয়ের কাজও শেষ। তবে এখনো বেবিচকের কাছে রাডার টাওয়ার হস্তান্তর করা হয়নি। সম্পূর্ণ কাজ শেষে বুঝে নিতে আরও কিছু সময় লাগবে। 
এ বিষয়ে বেবিচক সদস্য (এটিএম) এয়ার কমোডর জিয়াউল হক বলেন, আমরা নতুন রাডার দিয়েই এখন কাজ করছি।

পুরনোটা বন্ধ করে দিয়েছি মাস তিনেক আগেই। এখন নতুন রাডার প্রকল্পের কিছু আনুষঙ্গিক কাজ, যেমন অটোমেশনসহ অন্যান্য কাজ চলছে। 
বেবিচক জানিয়েছে, হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে পুরনো রাডার প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০৫ সালে। ২০১২ সালে একটি প্রতিষ্ঠান পিপিপির আওতায় রাডার স্থাপনে ৩৩০ কোটি টাকার প্রাথমিক প্রস্তাব দেয়। পরে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি পিপিপিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অনুমোদন দেয়। এর ভিত্তিতে ২০১৫ সালে দরপত্র ডাকা হলে চারটি প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেয়।

যাচাই-বাছাই শেষে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করিম অ্যাসোসিয়েটসকে প্রাথমিকভাবে মনোনীত করে বেবিচক। কিন্তু প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার মতো বিশাল ব্যয়ের চিত্র দেখে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ায় শেষ পর্যন্ত উদ্যোগটি বাতিল হয়ে যায়। 
এ অবস্থায় বিতর্ক এড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ উদ্যোগে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলে জিটুজি পদ্ধতিতে রাডার বসানোর সিদ্ধান্ত নেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের এপ্রিলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সিএনএস-এটিএম (কমিউনিকেশন, নেভিগেশন অ্যান্ড সার্ভিল্যান্স-এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট) ব্যবস্থাসহ রাডার স্থাপন নামে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার।

বেবিচকের কমিউনিকেশন, নেভিগেশন, সার্ভিল্যান্স ও এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট আধুনিকায়নে ‘হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সিএনএস-এটিএম (কমিউনিকেশন, নেভিগেশন, সার্ভিল্যান্স ও এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট) সিস্টেমসহ রাডার স্থাপন’ নামের এই প্রকল্প ২০২১ সালের ৮ জুন ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন করে। এর ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৭৩০ কোটি টাকা।

এই ব্যয় বেবিচকের নিজস্ব তহবিল থেকে বহন করা হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ফ্রান্সের রাডার প্রস্তুতকারী কোম্পানি থ্যালেসের সঙ্গে ২০২১ সালের অক্টোবরে চুক্তি করে বেবিচক। চুক্তি অনুযায়ী, পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে রাডার স্থাপনের কাজ শেষ করতে হবে। অত্যাধুনিক এই রাডার পরিচালনার জন্য বেবিচকের কর্মকর্তাদের থ্যালেসের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বেবিচক সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রাডার বসানোর প্রথম উদ্যোগ বাতিল করে জিটুজি পদ্ধতি অবলম্বন করায় কমপক্ষে দেড় হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। দেশের স্বার্থ বিকিয়ে প্রভাবশালী মহলের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় রাডার প্রকল্পটি এখন সবার নজর কাড়ছে।

শাহজালালের অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের সামনে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ৪৫ মিটার উঁচু কন্ট্রোল টাওয়ারটি দূর থেকেই সবার চোখে পড়ে। কৌতূহলী পথচারীদের কাছেও এটা বিস্ময়কর স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত। 
জানা গেছে, আগামী মাসেই দেশের পুরো আকাশ নজরদারি করতে পারবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অত্যাধুনিক রাডার বসাতে পাঁচ মাস সময় বাকি থাকলেও এরইমধ্যে রাডারটির আংশিক ব্যবহার করে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। আকাশপথে ঝুঁকি এড়াতে নতুন রাডারের পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার নিশ্চিত করার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের। 
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্য দেশের উড়োজাহাজ বাংলাদেশের আকাশসীমা ব্যবহার করলে ফি নেওয়ার বিধান আছে। তবে বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে চলাচল করা ভিনদেশী উড়োজাহাজের ক্ষেত্রে এই অর্থ হারাচ্ছে বাংলাদেশ। কারণ, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৪০ বছরের পুরনো রাডার ব্যবস্থাটি আছে, তার কার্যক্ষমতা শেষ হয়েছে বেশ আগেই।

এ রাডারটি দিয়ে আকাশপথে নজরদারি চালাতে হিমশিম খেতে হয় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারকে। তার ওপর সুন্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু অঞ্চল ও বঙ্গোপসাগরে নতুন নিয়ন্ত্রণে আসা বিস্তীর্ণ এলাকা এর আওতার বাইরে থাকায় সে এলাকায় কোনো আকাশযান উড়ে গেলে তা জানতে পারছে না বাংলাদেশ। এতে ঝুঁকিতে পড়ছে আকাশপথের সার্বভৌমত্ব। 
জানতে চাইলে এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেন, ‘অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে অবশেষে রাডার প্রকল্পটি হয়েই গেল। এরইমধ্যে নতুন রাডারটি কার্যকর হয়ে গেছে। ঢাকার রাডার থেকে পাওয়া তথ্য আমরা পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছি। তবে রাডারের সঙ্গে ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেমসহ কিছু বিষয়ের কাজ শেষ হতে আরেকটু সময় লাগবে। আমরা তো শুধু রাডার সংগ্রহ করছি না। এখানে রাডারের সঙ্গে অটোমেশনের বিষয় আছে। তারপরে কমিউনিকেশন আছে।’ 
নতুন রাডার থেকে বর্তমানে কী সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, পুরো আকাশে নজরদারির সুবিধা আমরা এখনো পাচ্ছি না। এখন ঢাকা ও চট্টগ্রামের আকাশসীমায় যেসব উড়োজাহাজ চলাচল করছে, ওইগুলোকে আমরা সার্ভিল্যান্সে রাখতে পারছি।

পুরো সিস্টেম অটোমেশন না হওয়া পর্যন্ত সব সুবিধা আমরা পাব না। তা থেকে রাজস্বও আদায় করতে পারছে না সরকার। এসব এলাকায় রাডার কাভারেজ দিয়ে আয় করছে ভারত ও মিয়ানমার। ফলে বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। 
সারাবিশ্বে এখন ড্রোন দিয়ে অন্য দেশের ওপর নজরদারির প্রবণতা বাড়ছে। শাহজালালে থাকা রাডারটি পুরনো প্রযুক্তির হওয়ায় দেশের আকাশসীমায় নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া কোনো আকাশযান বা ড্রোন শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। এতে দেশের নিরাপত্তাও ঝুঁকির মুখে ছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন বাস্তবতায় বসানো হয়েছে ফ্রান্সের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থ্যালাসের অত্যাধুনিক রাডার। থ্যালাসের স্থানীয় এজেন্টস দেশের শীর্ষস্থানীয় এভিয়েশন লজিস্টিক সাপোর্ট কোম্পানি অ্যারোন্যাস। 
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মাহবুব আনাম জানিয়েছেন, করোনার মহামারির মধ্যে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দ্রুততম সময়ে শেষ করা হয়েছে রাডার প্রকল্পের কাজ। শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও এক মুহূর্তের জন্য কাজ বন্ধ থাকেনি। এটা এভিয়েশন তো বটেই-গোটা দেশের জন্য একটা বড় ধরনের অর্জন বলা চলে।

প্রধানমন্ত্রীর সময়োচিত ও সাহসী পদক্ষেপের জন্য শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে বহুল আলোচিত এই রাডার প্রকল্প। বিশ্বের অত্যাধুনিক এই রাডার সিস্টেমে রয়েছে হেলমেট, এডি, এসবি ও মাল্টিলেটারেশানের মতো সুবিধা- যা উড়োজাহাজের নিখুঁত অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম। ঢাকা থেকে ২৮০ নটিক্যাল কিলোমিটার পর্যন্ত দূরের আকাশসীমায় সবধরনের প্লেনের অবস্থান ও গতিপ্রকৃতির নির্ভুল চিত্র ধরা পড়বে।

×