ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

রেমালের তাণ্ডবে আট লাখ গ্রাহকের ভোগান্তি

বরিশালে বিদ্যুৎ ও টেলি যোগাযোগ বিপর্যস্ত

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল

প্রকাশিত: ০০:২৯, ৩০ মে ২০২৪

বরিশালে বিদ্যুৎ ও টেলি যোগাযোগ বিপর্যস্ত

ঘূর্ণিঝড় রেমাল তা-বে বরিশালের বাকেরগঞ্জের একটি আঞ্চলিক সড়কের ওপর উপড়ে পড়া গাছ অপসারণ করা হচ্ছে

ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে বরিশালে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও টেলিযোগাযোগ সেবা চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। রেমালের তাণ্ডব শুরুর পর জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটে। বুধবার দুপুর পর্যন্ত জেলায় তা পুনস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। ফলে বরিশাল বিভাগের কমপক্ষে আট লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎহীন রয়েছেন।
অপরদিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় বিপর্যয়ে পড়েছে টেলিযোগাযোগ পরিষেবা। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট যোগাযোগ বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন সংবাদকর্মীসহ কয়েক লাখ গ্রাহক। এতে ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা যাচ্ছে না। সেইসঙ্গে স্বজনদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারছেন না স্থানীয় বাসিন্দারা।

বুধবার দুপুরে টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলোর সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে জেলার ১০ হাজারের বেশি মোবাইল টাওয়ার বা বেজ ট্রান্সমিটার স্টেশন (বিটিএস) সেবা দিতে পারছে না। বিটিএস রেডিও সংকেতের মাধ্যমে মোবাইল ডিভাইসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কল ও ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে থাকে।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়েছে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর লাখ লাখ মানুষের মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর। যে কারণে বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, ভোলার অধিকাংশ এলাকার মানুষ টেলিযোগাযোগ সেবার বাইরে রয়েছেন।
টেলিকম কোম্পানির কর্মকর্তাদের মতে, একটি বিটিএসের জন্য স্ট্যান্ডার্ড ব্যাটারি ব্যাকআপের সময়কাল সাধারণত চার থেকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত। যা বিদ্যুৎ প্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে। স্বল্প থেকে মাঝারি সময়ের বিদ্যুৎবিভ্রাট হলেও এই ব্যাকআপের মাধ্যমে টাওয়ার চালু থাকে। কিন্তু দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকায় টেলিযোগাযোগ একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

অপরদিকে বরিশালে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো) ও দুটি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় প্রায় ৯ লাখ ১৯ হাজার ৮৬ গ্রাহক রয়েছেন। এরমধ্যে ওজোপাডিকোর আওতায় ৩ লাখ ৪০ হাজার ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এর আওতায় ৩ লাখ ২০ হাজার ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর আওতায় ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৬ গ্রাহক রয়েছেন।

এরমধ্যে বরিশাল নগরীসহ জেলার গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বুধবার দুপুরের মধ্যে প্রায় তিন লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল করা সম্ভব হলেও বাকি গ্রাহকরা এখনো বিদ্যুৎবিহীন রয়েছেন।
ওজোপাডিকোর বরিশাল অঞ্চলের পরিচালন ও সংরক্ষণ সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুল মজিদ বলেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনে অসংখ্য গাছ ভেঙে পড়ে খুঁটি ও সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব মেরামত ও গাছ অপসারণে অসংখ্য কর্মী আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর মহাব্যবস্থাপক মো. হুমায়ুন কবির বলেন, আমাদের সমিতির আওতায় ৩ লাখ ২০ হাজার গ্রাহক রয়েছেন। এরমধ্যে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার তিন থেকে চারশ’ গ্রাহক মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যে ও সহ¯্রাধিক গ্রাহক বুধবার দুপুরের মধ্যে বিদ্যুৎ পেয়েছেন। তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনে অসংখ্য গাছ উপড়ে পড়ে রয়েছে। সম্পূর্ণ সরবরাহ ঠিক করতে আরও প্রায় ৪/৫ দিন লেগে যেতে পারে। তারপরেও যত দ্রুত সম্ভব সরবরাহ স্বাভাবিক করতে আমাদের সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
বরিশাল জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। টেলিযোগাযোগ ও বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল না হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র তুলে আনা যাচ্ছে না। জেলা ত্রাণ পুনর্বাসন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ছয়টি পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও ৮৮টি ইউনিয়নেই কমবেশী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিক হিসাবে জেলায় ১ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ জন সরাসরি ক্ষতির শিকার হয়েছেন। ঝড়ে মারা গেছেন তিনজন। পাশাপাশি রেমালের তা-বে প্রায় তিন হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক হিসাবে জেলায় ২৫৫টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ এবং ২ হাজার ৬৮৫টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া নগরীতে দেওয়াল ধসে দুজন ও বাকেরগঞ্জে গাছচাপা পড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত প্রত্যেকের পরিবারের কাছে ২৫ হাজার টাকা করে অর্থ সহায়তা পৌঁছে দিয়েছে জেলা প্রশাসন।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা রণজিৎ সরকার বলেন, ঝড়ের পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রস্তুত করতে আরও ৩/৪ দিন সময় লাগবে। আবহাওয়া ও যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক না হলে এটা করাটা দুরূহ। জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমাল আমাদের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করেছে। তবে বরিশালের মানুষ সংগ্রামী জীবন- যাপনে অভ্যস্ত। তারা আবার ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করেছে। সরকার তাদের পাশে আছে।
খাদ্য সহায়তা প্রদান ॥ ঘূর্ণিঝড় রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত জেলার গৌরনদী উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন ও পৌর এলাকার পাঁচশ’ পরিবারের মাঝে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বুধবার সকালে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে খাদ্য সহায়তা প্রদান করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আবু আবদুল্লাহ খান। এ সময় সরিকল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ফারুক হোসেন মোল্লা, উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা অশোক কুমার চৌধুরী, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. সালাউদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।
টেক্কা দিয়েছে সিডর-আইলা ও নার্গিসকে ॥ ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে মুষলধারে বৃষ্টি ও জোয়ারে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে মাছের কয়েক হাজার ঘের ও লক্ষাধিক একর ফসলি জমি প্লাবিত হয়ে খামারি ও চাষিদের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা জানিয়েছেন, এবারে ঝড়ের সময় যে প্লাবন হয়েছে তা দক্ষিণাঞ্চলে এর আগে কখনো দেখা যায়নি।

আবার ঘূর্ণিঝড় রেমালের মতো দীর্ঘসময় ঝড়ের তা-বও তারা দেখেননি। এ ঝড় রাত কাটিয়ে গোটা দিনের অর্ধেকের বেশি সময় অর্থাৎ ১৫ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে দক্ষিণাঞ্চলে প্রভাব খাটিয়েছে। যা সিডর, আইলা, নার্গিসের সময়ও এমনটা লক্ষ্য করা যায়নি।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূলীয় অধ্যয়ন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. হাফিজ আশরাফুল হক বলেন, বিগত ২০ বছর পূর্বেও বর্ষার সময়ে ৮০ ভাগ বৃষ্টিপাত হয়ে যেত। কিন্তু বর্তমানে আমরা শীতকালেও বৃষ্টিপাত হতে দেখছি। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণেই মূলত এমনটা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বছরে মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে যে বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা তার ২০ শতাংশও হয়নি। তবে সংরক্ষণে থাকা শক্তির বহির্প্রকাশ ঘটেছে ঘূর্ণিঝড় রেমালে। ফলে ঝড়ের সময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে।
বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের জলানুসন্ধান বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মাসুম বলেন, ঝড়ের কারণে স্বাভাবিক জোয়ারের সময়েই নদ-নদীতে পানির উচ্চতা বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। তার ওপরে মুষলধারে বৃষ্টি থাকায় প্লাবিত এলাকায় পানির উচ্চতা বেশি লক্ষ্য করা গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, দক্ষিণাঞ্চলের মেঘনা, বুড়িশ্বর, বলেশ্বর, তেঁতুলিয়া, বিষখালী, কচা, কীর্তনখোলা নদীসহ বেশিরভাগ নদীর পানি ঝড়ের দিন সর্বোচ্চ বিপৎসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হয়েছে।

এক্ষেত্রে কোনো কোনো নদীর পানি বিপৎসীমার ৫ থেকে ৮ ফুট উচ্চতা অতিক্রম করে প্রবাহিত হয়েছে। অপরদিকে আবহাওয়া অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বরিশালে ১৪০ মিলিমিটারের ওপরে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
কৃষিতে ১১০ কোটি টাকার ক্ষতি ॥ ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বরিশালজুড়ে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে কৃষিখাতে। বুধবার দুপুরে কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, শুধুমাত্র বরিশাল জেলায় ৬ হাজার ৪৪১ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত বা আক্রান্ত হয়েছে। যারমধ্যে পুরোপুরি আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ৮৫ হেক্টর জমির ফসল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খামার বাড়ির বরিশাল জেলার উপপরিচালক মো. মুরাদুল হাসান তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমাল পরবর্তী প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব অনুযায়ী আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১১০ কোটি টাকা। তবে এর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সূত্রমতে, বরিশাল জেলায় মোট ১৩ হাজার ৪৬৯ হেক্টর জমিতে আউশ, পান, শাক-সবজি, পেঁপে এবং কলা আবাদ হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে ৬ হাজার ৩৬৬ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হয়েছে। এরমধ্যে ৪ হাজার ২৭১ হেক্টর জমিতে আংশিক এবং ২ হাজার ৬৫ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণভাবে আক্রান্ত হয়েছে।
সূত্রে আরও জানা গেছে, ২ হাজার ৩৪৯ হেক্টর জমিতে আউশ আবাদের মধ্যে ১ হাজার ৮৭৯ হেক্টর জমির ফসল আংশিক এবং ৯৩৯ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণভাবে আক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়া ২ হাজার ৯৮৭ হেক্টর জমিতে পান আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৯২ হেক্টর জমির পান আংশিক এবং ৮৯৬ হেক্টর জমির পান সম্পূর্ণভাবে আক্রান্ত হয়েছে। শাক-সবজির আবাদ হয়েছে ৭ হাজার ৪৩০ হেক্টর জমিতে।

এরমধ্যে ৫০০ হেক্টর জমির শাক-সবজি আংশিক ও ২০০ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণভাবে আক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়া ৩৯১ হেক্টর জমিতে আবাদ করা বিভিন্ন ধরনের কলা গাছের মধ্যে ১০০ হেক্টর জমির কলাগাছ আংশিক ও ৩০ হেক্টর জমির কলাগাছ সম্পূর্ণভাবে আক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়া ৩১২ হেক্টর জমিতে পেঁপে আবাদ হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত বা আক্রান্ত হয়েছে ৫৫ হেক্টর জমির পেঁপে গাছ ও সম্পূর্ণভাবে আক্রান্ত হয়েছে ২০ হেক্টর।

×