ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

তৎপর পৃথক সিন্ডিকেট

খাতুনগঞ্জ ও মৌলভীবাজার থেকেই ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস

প্রকাশিত: ০০:০৩, ৬ মার্চ ২০২৪

খাতুনগঞ্জ ও মৌলভীবাজার থেকেই ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ

দেশের ভোগ্যপণ্যের অন্যতম বৃহৎ দুটি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ

দেশের ভোগ্যপণ্যের অন্যতম বৃহৎ দুটি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও ঢাকার মৌলভীবাজার। এ দুটি বাজার থেকেই সারাদেশের ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এ দুটি বাজারজুড়ে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র। প্রতিটি পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আলাদা আলাদা সিন্ডিকেট সদা তৎপর থাকে। আমদানি পণ্য ছাড়াও দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য নিয়েও এসব চক্রের কালো হাত কাজ করে।

ফলে নিমিষেই পণ্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী হতে সময় নেয় না। এ সুযোগে সিন্ডিকেট চক্র হাতিয়ে নেয় কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। চট্টগ্রামে এসব সিন্ডিকেট চক্র ভাঙতে তৎপরতা চালিয়েও ব্যর্থ হওয়ার ঘটনা রয়েছে। এটাই চলে আসছে বছরের পর বছর।

উল্লেখ্য, ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর যারা পণ্যের আমদানিকারক তারাই পাইকারি বিক্রেতা। তারাই ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা। আবার পণ্যের মূল্য বেড়ে গেলে তারাই নেমে যান নানা সমালোচনায়। এর ফলে সরকার বিভিন্ন সময়ে আমদানি শুল্কে ছাড় দেয়। কিন্তু এর পরও পণ্যের দাম কমে না। সিন্ডিকেট চক্র কমাতে দেয় না। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলে থাকেন, মূল আমদানিকারকরা দাম না কমালে সুযোগ কোথায়। আর খুচরা ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে নিয়মনীতির কোনো বালাই নেই। যে যেভাবে পারে গলাকাটা মূল্য হাতিয়ে নিতে তৎপর থাকে। 
মোদ্দা কথা হলো- সিন্ডিকেটের ইশারায় পণ্যের মূল্য যেভাবে বৃদ্ধি পায় শুল্ক কমালেও সেভাবে হ্রাস পায় না। চিনি, খেজুরসহ কয়েকটি পণ্যের শুল্ক অতি সম্প্রতি হ্রাস করা হলেও বাজারে মোটেও কমেনি।  উল্টো বেড়েছে। 
বর্তমানে দেশে বেশ কয়েকটি করপোরেট হাউস ভোগ্যপণ্যের প্যাকেটজাত প্রক্রিয়া বাণিজ্যিক কার্যক্রম রেখেছে। এক্ষেত্রে দেখা যায়, এরাই পণ্যের আমদানিকারক, গুদামজাতকারী ও পাইকারি পর্যায়ে বিক্রেতা। এদের অনেকেই আবার ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা।
দেশের ভোগ্যপণ্যের দাম ওঠা-নামা ও সরবরাহ এবং জোগান নিয়ন্ত্রণ করেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। এ খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় করপোরেট কার্যালয় রয়েছে। তারা দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজে যেমন প্রভাব রাখেন  তেমনিভাবে তারা পাইকারি ব্যবসায়ও নিয়ন্ত্রণ করেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন পণ্যের ডিও ( ডেলিভারি অর্ডার) ও স্লিপ ব্যবসার কারণে সারাদেশে তেল, চিনি,  পেঁয়াজ, ডাল ও বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের দাম ওঠানামার নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। 
সর্বশেষ গত সোমবার জেলা প্রশাসনের অভিযানে উঠে আসে এলাচ নিয়ে তুঘলকি কা-। এর পর  দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পগ্রুপ এস আলমের চিনির একটি  গোডাউনে আগুন লাগার ঘটনার পর খাতুনগঞ্জের পরিস্থিতি পাল্টে যায়। হু হু করে বাড়তে থাকে চিনির দাম। একদিনে বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ৭০ টাকা বেড়ে যায় চিনির দর। যদিও এস আলম বলছে চিনির বাজারে প্রভাব পড়বে না। কিন্তু বাস্তবে ভিন্ন। আবার এস আলমের চেয়ারম্যান নিজেই আশঙ্কা করছেন, ব্যবসায়ীরা চিনির মিলে আগুনের ঘটনাকে পুঁজি করতে পারে। 
এসব বক্তব্য এবং খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে খোদ  ভোক্তারাই বলছেন, বাজার যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তারাই এখন বিভিন্ন সুরে কথা বলছেন। এবার রোজার আগে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন নাটক শুরু করেছেন, যা নানা পণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির আভাস। 
খাতুনগঞ্জে  ভোজবাজির এ ব্যবসার কারণে বাজার পরিস্থিতি  কোন অবস্থায় গিয়ে  পৌঁছে তা এখন দেখার অপেক্ষা।  সোমবার খাতুনগঞ্জে  জেলা প্রশাসনের অভিযানে গিয়ে এক কেজি এলাচ বিক্রি করে এক হাজার টাকা লাভ করার প্রমাণ পায়। অভিযানে  নেতৃত্ব দেওয়া চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত বলেন, এলাচের আমদানি এবং বিক্রয় মূল্যের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। মাত্র সাড়ে সাত ডলার কেজি দরে এলাচ আমদানি করা হয়েছে। এর ওপর ৫৯ শতাংশ ট্যাক্স।

তারপর বন্দরের চার্জ ও ক্যারিং কস্টসহ সবকিছু মিলিয়ে এক কেজি এলাচের সর্বোচ্চ মূল্য হতে পারে ১৫শ’ টাকা। কিন্তু বাজারে এলাচ বিক্রি হচ্ছে  কেজি ২ হাজার ৩শ’ থেকে ৩ হাজার টাকায়। খুচরা পর্যায়ে কিন্তু এটি আরও  বেশি। এলাচের অন্যতম প্রধান আমদানিকারক খাতুনগঞ্জের মেসার্স আবু মোহাম্মদ অ্যান্ড কোম্পানিকে আমদানি মূল্যের অতিরিক্ত দামে এলাচ বিক্রির দায়ে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

মূল্যতালিকা ও ক্রয়-বিক্রয় রশিদ না রাখার অভিযোগে খাতুনগঞ্জের মদিনা ট্রেডার্সকে ১০ হাজার, আজমির ভান্ডারকে ৩ হাজার এবং ফারুক  ট্রেডার্সকে ৩ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সরাসরি ডিও/এসও বিক্রির দায়ে ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজকে ১০ হাজার এবং দ্বীন অ্যান্ড  কোম্পানিকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
বাজার সূত্রে জানা যায়, খাতুনগঞ্জে কাগজ বিক্রির ব্যবসা চালু রেখেছে বড় বড় শিল্প গ্রুপ। কয়েক হাত ঘুরে এসব কাগজ নিয়েই চলে কোটি কোটি টাকার খেলা। ডিও/এসও বিক্রি বন্ধ করার জন্য ২০১১ সালে জেলা প্রশাসন কঠোর হয়েছিল।  বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল তখন। কিন্তু অজানা কারণে লাগাম টানতে পারেনি। 
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পেঁয়াজের এক আড়তদার জানান, আমরা কমিশনভিত্তিক ব্যবসা করি। যারা ট্রেডিং করে তারাই মূলত এ বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তবে চট্টগ্রামের  বেশ কয়েকজন মুদির দোকানি জানালেন ভিন্ন কথা। তারা বলেন, দেশের তেল, চিনি, গম, ডাল এসবের বাজার নিয়ন্ত্রণ যারা করেন তারা পরিচিত। এদের খাতুনগঞ্জে ট্রেডিং ব্যবসা আছে। আড়ত আছে। যেমন ডালের বাজার চট্টগ্রামের চিহ্নিত এক ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রণ করেন। একইভাবে মসলার বাজার নিয়ন্ত্রণ করে একজন।

তেল চিনির ক্ষেত্রে দুটি শিল্পগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়। গোডাউনে গোডাউনে চিনি তেল অথচ দাম বাড়ছে। সোমবার আগুন লাগার পর পরই খাতুনগঞ্জে দাম বেড়েছে চিনির। অথচ আমদানিতে  কোনো ব্যাঘাত  নেই, সরবরাহও ঠিকমতো আছে। অথচ  কোনো কারণ ছাড়াই পণ্যের দাম উঠছে। এর মূল কারণ ডিও বা এসও এবং স্লিপ ব্যবসা। হাত বদল হতে হতে পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যাচ্ছে।

×