রাজধানীর বেইলি রোডে বহুতল ভবনে ভয়াবহ আগুন (ইনসেটে)। উদ্ধার কাজ চলছে
রাজধানীর বেইলি রোডে অবস্থিত একটি বহুতল ভবনে বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৫০ মিনিটে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ৪৩ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন রাত ২টায় এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মৃতদের মধ্যে কয়জন নারী, পুরুষ কিংবা শিশু তা এখনো জানার চেষ্টা চলছে। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিটের প্রায় আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ১২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
আগুনে আতঙ্কে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিকের মতো। ৭ম তলা ভবনের ছাদে ও বিভিন্ন ফ্লোরে অনেকে আটকা পড়েন। তারা চিৎকার করে বাঁচার আকুতি জানান। রাত সোয়া ১২টা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ৭৫ জনকে নিরাপদে উদ্ধার করেছেন এবং অচেতন অবস্থায় ৪২ জনকে উদ্ধার করা হয়। আটকেপড়াদের সন্ধানে এবং উদ্ধারের অপেক্ষায় নিচে ভিড় করেন স্বজনরা। উৎসুক জনতাকে সরিয়ে দিতে ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে একত্রে কাজ করেন পুলিশ, র্যাব ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা।
জানা গেছে, ৭ম তলা বিশিষ্ট ভবনটির নিচতলায় স্যামসাং মোবাইলের শোরুম, ২য় তলায় কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট, ৩য় তলায় পাঞ্জাবির শোরুম, ৪র্থ তলায় খান রেস্টুরেন্ট এবং বাকি ফ্লোরগুলোতেও রেস্টুরেন্ট। মূলত ২য় তলার কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট থেকে আগুনের সূত্রপাত। কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেতে খেতে হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণের শব্দ পাই, এরপর চারদিক অন্ধকারাছন্ন হয়ে পড়ে।
এমনটিই জানিয়েছেন রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া লোকমান নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘রাত আনুমানিক ৯টা ৪৫ মিনিটের দিকে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর আগুন ধরে যায়। এরপর দৌড়ে বাইরে বের হয়ে আসি।’
এ ঘটনায় লাফিয়ে পড়ে অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসা হয়েছে।
রাত সাড়ে ১১টায় দেখা যায়, ‘আমরা এখনো উপরে, আমাদের বাঁচান’- এমন চিৎকার করছেন আটকাপড়া অনেকে। তাদের উদ্ধারে নানামুখী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস। পরে ফায়ার সার্ভিসের টার্ন টেবল লেডার (টিটিএল) ব্যবহার করে তৃতীয় তলায় পৌঁছান উদ্ধারকারীরা। এরপর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তৃতীয় তলার কাঁচ ভেঙে আটকেপড়াদের উদ্ধার করতে অভিযান শুরু করেন। একে একে নামিয়ে আনা হয় তাদের। তাদের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। এর মধ্যে রাত ১২টা পর্যন্ত ভবনটির ছাদে আটকে আছেন প্রায় ৫০ জন।
আটকেপড়াদের মধ্যে রয়েছেন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘আমরা এখনো মারা যাইনি, ছাদে আছি। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন ইনশাআল্লাহ। কল নয়, দোয়া করুন।’
আগুন লাগা ভবনটির তিনটি ফ্লোরে তখনো আগুন জ্বলছিল। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভবনটির পাশের ভবনে উঠে পানি দিচ্ছেন। অন্যদিকে আরেক দল ফায়ার সার্ভিস কর্মী ভবনের নিচ থেকে পানি দিচ্ছেন।
এদিকে আগুনের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে ভবনটির সামনে ভিড় করতে শুরু করেন ভেতরে আটকেপড়াদের স্বজনরা। সেই সঙ্গে উৎসুক মানুষের অতিরিক্ত ভিড়ে আগুন নেভানোর কাজ ব্যাহত হয়েছে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত উৎসুক মানুষের ভিড় এবং আটকেপড়া ব্যক্তিদের স্বজনদের উপস্থিতিতে উদ্ধার কাজ বিঘিœত হওয়ার কারণে ভবনটির সামনে থেকে সবাইকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন পুলিশ সদস্যরা। তবে বারবার চেষ্টা করেও এসব উৎসুক মানুষকে সরাতে পারেনি পুলিশ। রাত সাড়ে ৯টার পর লাগা এ আগুন ১২টা ১০ মিনিটের দিকে নিয়ন্ত্রণে আসে।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেছেন, আমরা ভেতরে তল্লাশি করছি। আটকে পড়াদের জীবিত উদ্ধারে যতটুকু করা সম্ভব আমরা সেটা করার চেষ্টা করছি। বাকি পরিস্থিতি এখনো বলার সময় হয় নাই।
আগুন নিয়ন্ত্রণে তারপরও ভেতরে ধোঁয়া আছে। আমরা আমরা যতজন পারছি জীবিত উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠাচ্ছি।
স্ত্রীর খোঁজে ঘটনাস্থলে আসেন তারেক আহমেদ। তিনি জানান, বান্ধবীদের নিয়ে বেইলি রোড কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয় খেতে এসেছিলেন তার স্ত্রী। কিন্তু আগুন লাগার পর থেকে স্ত্রীর ফোন বন্ধ পাচ্ছেন তিনি। তাই উদ্বিগ্ন হয়ে খোঁজ নিতে বেইলি রোডে এসেছেন তিনি। তারেক আহমেদ বলেন, মতিঝিল এজিবি কলোনিতে আমাদের বাসা।
আমার স্ত্রী তার কয়েকজন বান্ধবীর সঙ্গে খেতে এসেছিলেন। আগুন লাগার পর থেকে তার বন্ধ পাচ্ছি। শুনেছি আগুন লাগা ভবনের ছাদে কিছু মানুষ আছে। ভাই দোয়া করবেন। তারেক আহমেদ মতো স্বজনের খোঁজে বেইলে রোডে আসছেন অনেকেই। তারা সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন। অনেকে কান্নাকাটি করতেও দেখা গেছে।
অগ্নিকা-ের ঘটনায় ৩ প্লাটুন সাধারণ আনসার ও ১ প্লাটুন আনসার গার্ড ব্যাটালিয়ন (এজিবি) সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আনসার সদস্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণ ও আটকেপড়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করতে কাজ করছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক ঘটনাটি মনিটরিং করেন। ঘটনাস্থলে ছুটে যান ডিএমপি কমিশনার হাবিবুুর রহমান ও স্থানীয় সাংসদ বাহাউদ্দিন নাছিম।