ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

রবিবার বিশ্ব ইজতেমার আখেরী মোনাজাত

মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম, টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দান থেকে

প্রকাশিত: ১৮:৪৯, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

রবিবার বিশ্ব ইজতেমার আখেরী মোনাজাত

বিশ্ব ইজতেমা ময়দান

কহর দরিয়াখ্যাত টঙ্গীর তুরাগ পাড়ের বিশ্ব ইজতেমাস্থল এখন দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লিদের পদচারণায় মুখরিত। শিল্প নগরী টঙ্গী এখন যেন ধর্মীয় নগরীতে পরিণত হয়েছে। এবারের ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিন শনিবার আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান ও রাসুল (সঃ) প্রদর্শিত তরিকা অনুযায়ী জীবন গড়ার আহ্বান জানিয়ে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি জিকির আসকার, ইবাদত বন্দেগী আর ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে পবিত্র কোরআনের আলোকে গুরুত্বপূর্ণ বয়ানের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছে। 

রবিবার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে মুসলিমবিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। এদিন সকাল ১০টার মধ্যে আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বীদের বরাত দিয়ে জিএমপি কমিশনার মাহবুব আলম জানিয়েছেন। বিশ্ব তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি বাংলাদেশের হাফেজ মাওলানা জুবায়ের আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন বলে জানিয়েছেন আয়োজক কমিটি। মোনাজোতে বিশ্বের সকল মানুষের সুখ, শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে দোয়া করা হয়। আয়োজকেরা ধারণা করছেন প্রায় ২৫-৩০ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি আখেরি মোনাজাতে অংশ নিবেন বলে আশা করছেন ইজতেমা আয়োজক কমিটি। ইজতেমা ময়দানে বিদেশী নিবাসের পূর্বপার্শ্বে বিশেষভাবে স্থাপিত মঞ্চ থেকে এ মোনাজাত পরিচালনা করা হবে। এরআগে অনুষ্ঠিত হবে হেদায়তি বয়ান। 

রবিবার হেদায়তি বয়ান ও আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে এবারের বিশ্ব ইজতেমার তিন দিনের প্রথম পর্ব। আখেরি মোনাজাতে মুসল্লীদের আসা ও যাওয়া নিরাপদ করতে শনিবার দিবাগত মধ্যরাত থেকে মোনাজাত অনুষ্ঠাণ পর্যন্ত ইজতেমা ময়দানগামী সড়কে যানবাহন চলাচলে বিধি নিষেধ আরোপ করেছে পুলিশ। এবারও অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বইজতেমার অন্যতম আকর্ষণ যৌতুক বিহীন বিয়ে। প্রথম পর্বেও আখেরী মোনাজাতের পর চারদিন বিরতি দিয়ে আগামি শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারি) শুরু হবে আদি তাবলীগ জামাতের মাওলানা সা’দ পন্থীদের তিন দিনের বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। বাংলাদেশে সা’দ গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন ওয়াসেকুল ইসলাম। আগে একপর্বে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হলেও গত ২০১৫ সাল হতে দেশের একাধিক পর্বে বিভক্ত করে ইজতেমার আয়োজন করা হচ্ছে।

মহান আল্লাহতাআলার নৈকট্য লাভের ব্যাকুলতায় দ্বীনের দাওয়াতে মেহনত করার জন্য ইসলামের মর্মবাণী সর্বত্র পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা দলে দলে ছুটে আসছেন টঙ্গীর তুরাগ তীর ইজতেমা ময়দানে। শনিবারও টঙ্গী অভিমুখী বাস, ট্রাক, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে ছিল মানুষের ভিড়। 

রবিবার আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মানুষের এ ঢল অব্যাহত থাকবে। ইতোমধ্যে ইজতেমা ময়দান পূর্ণ হয়ে গেছে। মূল প্যান্ডেলে স্থান না পেয়ে অনেক মুসুল্লী নিজ উদ্যোগেই প্যান্ডেলের বাইরে পলিথিন সিট ও কাপড়ের সামিয়ানা টানিয়ে তাতেই অবস্থান নিয়েছেন। সৃষ্টিকর্তার বন্দনা, আরজ-গুজার, শোকরানা আর ইবাদত বন্দিগীতে মশগুল মানুষের কলরব। সৃষ্টিকর্তার দিদার লাভের জন্যে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পায়ে হেঁটে, র‌্যাব ও পুলিশ পাহারায় বাস ও ট্রেনে টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে সমবেত হয়েছেন। 

ইজতেমা মাঠে উপস্থিত লাখ লাখ মুসল্লির উদ্দেশে যথারীতি তাবলীগের ছয় উসুল অর্থাৎ কালেমা, নামাজ, এলেম ও জিকির, একরামুল মুসলেমিন, সহীহ নিয়ত ও তাবলীগ বিষয়ে আমবয়ানের মাধ্যমে ইজতেমার প্রথম পর্বের তিন দিনের কার্যক্রমের দ্বিতীয় দিন শনিবার অতিবাহিত করছেন মুসল্লীরা।

এদিকে এবারও তাবলিগের শীর্ষ মুরুব্বীরা রেডিও-টিভিতে আখেরি মোনাজাত সরাসরি সম্প্রচারে অনুমতি দেননি। ক্যামেরাও মুরুব্বীদের ছবি তোলাও বারণ করে দিয়েছে ইজতেমা কর্তৃপক্ষ। তারপরও কিছু কিছু বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ইজতেমা কর্তৃপক্ষের অজ্ঞাতে আখেরি মোনাজাত সম্প্রচার করার উদ্যোগ  নিয়েছেন। 

দ্বিতীয় দিন (শনিবার) যারা বয়ান করলেন ॥ বিশ্ব ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়ক মোঃ হাবিবুল্লা রায়হান জানান, নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় দিন শনিবার মুসুল্লীদের উদ্দেশ্যে বাদ ফজর বয়ান করেন ভারতের (মুম্বাই) মাওলানা আব্দুর রহমান। তার বয়ানের তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা আব্দুল মতিন। এরপর বাদ জোহর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ইসমাইল গোদরা। তার বয়ানের তরজমা করেন মাওলানা নুরুর রহমান। বাদ আছর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা জুহাইরুল হাছান। তাঁর বয়ানের তরজমা করেন মাওলানা জাকারিয়া। আছরের বয়ান শেষে মাওলানা জুহাইরুল হাছান যৌতুক বিহীন বিয়ে পড়ান। এরপর বাদ মাগরিব বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা। এর আগে সকাল ১০টা হতে বয়ানের মিম্বারে আলেমদের উদ্দেশ্যে বিশেষ বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা, নামাজের মিম্বারে বিশেষ বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা আহমেদ হোসাইন। দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি ইজতেমা ময়দানে অবস্থান করে ফজিলতপূর্ন এ বয়ান শুনেন।  

যা বয়ান করলেন ॥ তাবলিগ জামাতের মুরুব্বীগণ ইজতেমার সুবিশাল ময়দানে সমবেত দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লির উদ্দেশ্যে তাবলিগের ছয় উসুল যথা কালিমা, নামাজ, ইলম ও জিকির, ইকরামুল মুসলিমিন, তাসহিয়ে নিয়ত এবং তাবলিগ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেন। বয়ানে তাবলীগ মুরব্বীরা বলেন, যতদিন দ্বীন থাকবে, তত দিন দুনিয়া থাকবে। আর দ্বীন টিকে থাকবে দাওয়াতের মাধ্যমে। যুগে যুগে নবী-রাসুলগণ দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করে গেছেন। ফেরাউনের কাছেও দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিতে আল্লাহ্ হযরত মুসা (আ:) কে পাঠিয়েছিলেন। আল্লাহ যাল্লে জালালুহু নবী-রাসুলদেরকে তাদের নিজের পরিবার ও বিভিন্ন গোত্রের মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা:) কে সারা দুনিয়ায় দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন। আজ তিনি নেই। এ কাজের জিম্মাদারী এখন তার উম্মতের ওপর।

সকালের বয়ানে বলা হয়, পরকালের চিরস্থায়ী সুখ শান্তির জন্য আমাদের প্রত্যেককে দুনিয়াতে জীবিত থাকা অবস্থায় দ্বীনের দাওয়াতের কাজে জানমাল দিয়ে মেহনত করতে হবে। ঈমান আমলের মেহনত ছাড়া কেউ হাশরের ময়দানে কামিয়াব হতে পারবে না। দাওয়াতের মেহনত হলো নবুওয়াতি মেহনত। খুলুসিয়াত ও আজমতের সঙ্গে যারা মেহনত করবে তাদের যেকোনও আমলের ফজিলত বহুগুণ বেড়ে যায়।

বয়ানে আরো বলা হয়, দুনিয়ার জিন্দেগী ক্ষণস্থায়ী, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের দিল থেকে আসবাবের (সম্পদের) এক্বিন বের না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার দিলে কুদরতি এক্বিন পয়দা হবে না। সকলকে দ্বীনের জন্য মেহনত করতে হবে। আল্লাহর কাছে আমল ছাড়া এ দুনিয়ার জিন্দেগীর কোন মূল্য নেই। বয়ানে আরো বলা হয়, দীনের দাওয়াতের মাধ্যমে ঈমান মজবুত হয়। ঈমান মজবুত হলে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর এ সম্পর্ক গড়ে ওঠলে দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াবি হাসিল হয়।  

শেষদিনের আখেরী মোনাজাত ও বয়ান ॥ বিশ্ব তাবলীগ জামাতের প্রথম পর্বের শেষদিন রবিবার শীর্ষ মুরব্বি বাংলাদেশের হাফেজ মাওলানা জুবায়ের আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন বলে জানিয়েছেন আয়োজক কমিটি। এরআগে সকালে হেদায়াতি বয়ান ও বিশেষ নসিহত করা হবে। 

বয়ানের তাৎক্ষণিক অনুবাদ ॥  বিশ্ব ইজতেমায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের তাবলিগ মারকাজের ১৫-২০জন শুরা সদস্য ও বুজর্গ বয়ান পেশ করেন। মূল বয়ান উর্দূতে হলেও বাংলা, ইংরেজী, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসি ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদ হচ্ছে। বিভিন্ন ভাষাভাষি মুসল্লিরা আলাদা আলাদা বসেন এবং তাদের মধ্যে একজন করে মুরুব্বী মূল বয়ানকে তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে শুনান। মূল বক্তা বয়ানের একটি নির্দিষ্ট অংশ শেষ করার পর অনুবাদের জন্য বিরতি দেন। অনুবাদ শেষ হলে তিনি আবার বয়ান শুরু করে। এভাবেই ইজতেমা ময়দানে তাবলীগ জামাতের মুরব্বীদের বয়ান চলে। 

অনুষ্ঠিত হলো যৌতুকবিহীন বিয়ে ॥ বিশ্ব ইজতেমার অন্যতম আকর্ষণ যৌতুক বিহীন বিয়ে। সম্পূর্ণ শরীয়ত মেনে তাবলিগের রেওয়াজ অনুযায়ি ইজতেমার দ্বিতীয় দিন (শনিবার) বাদ আছর ইজতেমার বয়ান মঞ্চের পাশেই বসে যৌতুকবিহীন বিয়ের আসর বসে। অর্ধশতাধিক বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় এ আসরে। ভারতের মাওলানা জুহাইরুল হাসান এসব বিয়ে পড়ান। তাবলিগের রেওয়াজ অনুযায়ী ইজতেমার দ্বিতীয় দিন বাদ আসর বয়ান মঞ্চের পাশে বসে যৌতুকবিহীন বিয়ের আসর। কনের সম্মতিতে ও তার অনুপস্থিতিতে বর এবং কণে পক্ষের লোকজনের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় ওই বিয়ে। বিয়েতে মোহরানা ধার্য করা হতো ‘মোহর ফাতেমী’র নিয়মানুযায়ী। এ নিয়ম অনুযায়ী মোহরানার পরিমান ধরা হয় দেড়শ’ তোলা রুপা বা উহার সমমূল্য অর্থ। বিয়ের পর নব-দম্পতিদের সুখ-সমৃদ্ধিময় জীবন কামনা করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে মোনাজাতের মাধ্যমে দোয়া করা হয়। এসময় মঞ্চের আশপাশের মুসল্লিদের মাঝে খোরমা খেজুর ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়।

তাশকিলের কামরায় চিল্লাভুক্ত মুসুল্লী ॥ ইজতেমার প্যান্ডেলের উত্তর-পশ্চিমে তাশকিলের কামরা স্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন খিত্তা থেকে বিভিন্ন মেয়াদে চিল্লায় অংশ গ্রহনেচ্ছু মুসুল্লীদের এ কামরায় আনা হচ্ছে এবং তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। পরে কাকরাইলের মসজিদের তাবলিগি মুরুব্বীদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ি এলাকা ভাগ করে তাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাবলিগি কাজে পাঠনো হবে। 

আখেরী মোনাজাতের প্রস্তুতি ॥ রবিবার অনুষ্ঠিত হবে ইজতেমার মূল আকর্ষণ আখেরি মোনাজাত। ইজতেমা মাঠের বিদেশি নিবাসের পূর্বপাশে বিশেষ মোনাজাত মঞ্চ থেকে রবিবার সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে আখেরি মোনাজাত শুরু হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ব ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়ক মোঃ হাবিবুল্লা রায়হান। এর আগে হবে হেদায়তি বয়ান। রবিবার আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মুসল্লীদের ঢল অব্যাহত থাকবে। ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে বিপুল সংখ্যক মহিলা টঙ্গীর আশপাশে এসে ইতোমধ্যে অবস্থান নিয়েছেন। অনেকে তাদের আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে উঠেছেন। রবিবার হেদায়তি বয়ান ও আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের বিশ্ব ইজতেমার তিন দিনের প্রথম দফা। এরপর আগামি শুক্রবার শুরু হবে তিনদিনের বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় দফা। 

এবার প্রায় ৬ হাজার জামাত তাবলিগের দাওয়াত নিয়ে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে ॥ ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়ক মোঃ হাবিবুল্লা রায়হান বলেন, তাবলিগের একমাত্র কাজই আল্লাহর পথে মানুষকে ডাকা। রাসূল (সাঃ)-এর বিদায় হজের ভাষণের মূল বাণী হিসেবে আমরা আল্লাহর পথে ডেকে থাকি। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই এর একমাত্র লক্ষ্য। একমাত্র আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের একক আনুক’ল্যে এই ইজতেমা হয়ে থাকে। টঙ্গীর এই ইজতেমা থেকেই বিশ্বের অন্ততঃ ১৫০টি দেশে দাওয়াতের এই কাজ করা হয়। প্রতি বছর টঙ্গী ইজতেমা থেকেই পাঁচ থেকে ছয় হাজার জামাত বিশ্বব্যাপী পাঠানো হয়। আগত বছরের বিশাল কর্মযজ্ঞের পরিকল্পনা টঙ্গী থেকেই হয়। তিনি সকল মুসলমানদের কিছুটা সময় হলেও ইজতেমায় ব্যয় করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, এবারো প্রায় ছয় হাজার জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাবলিগের কাজে বেরিয়ে যাবে। 

আরো ৫ মুসল্লির মৃত্যু ॥ বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে আগত আরো ৫ মুসল্লি মারা গেছেন। এদের মধ্যে শুক্রবার রাত থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত শেরপুর জেলা সদরের জুগনিবাগ গ্রামের মৃত সমশের আলীর ছেলে নওশের আলী (৬৫), ভোলা জেলার পরাগগঞ্জ থানার সামানদার গ্রামের বেলায়েত হোসেনের ছেলে আব্দুল কাদের (৫৫) ও নেত্রকোনা জেলা সদরের কালিয়াঝুড়ি এলাকার হোসেন আহম্মদের ছেলে স্বাধীন (৪৫) মারা যান। শনিবার অপর ২জন আছরের পূর্বে মারা যান। এনিয়ে ইজতেমা ময়দানে আগত মোট ৯ মুসল্লি শনিবার বিকেল পর্যন্ত মারা গেছেন। তাদের প্রায় সবাই হৃদরোগ ও শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে ভুগছিলেন। এছাড়াও ইজতেমা ময়দানে আসার পথে পুলিশের এক এএসআই সহ অপর ৩জন এ পর্যন্ত মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন ইজতেমা ময়দানের জিম্মাদার।  

নিজেদের ‘শুরায়ে নিজাম’ বলার অনুরোধ জোবায়ের পন্থিদের
বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আয়োজনকারী পক্ষের মুরুব্বী মুফতি আমানুল হক তাদেরকে জুবায়ের পন্থি না বলে ‘শুরায়ে নিজাম’ বলার জন্য অনুরোধ করেছেন। টঙ্গীর ইজতেমার শুরুর দিন শুক্রবার বিকেলে ইজতেমার ময়দানে বিদেশি ক্যাম্পের পাশে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ আহ্বান জানান।

তিনি তাবলীগ জামাতের প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে বলেন, তাবলীগ জামাতে বিভক্তির মূল কারণ হলো ওনারা একজন ব্যক্তিকে (সাদ সাহেব) মেনে চলেন। আর আমরা একটা জামাতকে মেনে চলি, যারা সকলে মিলে পরামর্শ করেন এবং সেই পরামর্শকে মেনে চলেন।

তিনি বলেন, আমরা মাওলানা জুবায়ের সাহেবকে ফলো করি না, জোবায়ের সাহেবসহ একটা জামাত আছে, আমারা সেই জামাতকে মেনে চলি, যারা সকলে মিলে কোনো বিষয়ে পরামর্শ করেন। আমরা সেই পরামর্শকে ফলো করি। ব্যক্তি কখনো নিরাপদ নয়, তবে পরামর্শ নিরাপদ। তাই তিনি তাদেরকে ‘জোবায়ের পন্থি’ না বলতে সাংবাদিকদের অনুরোধ করেন। তারা তাদেরকে ‘শুরায়ে নিজাম’ বলার অনুরোধ করেছেন। তারা নিজেদেরকে ‘শুরায়ে নিজাম’ বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

অপরদিকে তাবলীগ জামাতের অপরপক্ষের মুরুব্বী মাওলানা ওয়াসিফুল ইসলাম বলেন, মুফতি আমানুল হকের বক্তব্য সঠিক নয়। সাদ সাহেব নিজেকে নিজে আমীর ঘোষণা করেননি। তাদের একটি পরামর্শক কমিটি আছে, তারাই তাকে আমীর বানিয়েছেন এবং যেকোনো বিষয়ে ওই পরামর্শক কমিটি আমীরকে পরামর্শ দেন। পরে তার বাস্তবায়ন করেন আমীর। প্রতিপক্ষই ইসলাম তথা ধর্ম প্রচার নিয়ে বিতর্ক করছেন।

সংবাদ সম্মেলনে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম, বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান উপস্থিত ছিলেন।

ফ্রি-মেডিক্যাল ক্যাম্পে চিকিৎসা ॥ শনিবার সকাল থেকে ইজতেমা ময়দান সংলগ্ন ফ্রি-মেডিক্যাল ক্যাম্পগুলোতে মুসুল্লিদের চিকিৎসা নিতে ভিড় দেখা গেছে। মুসুল্লীদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য ময়দানের আশপাশে ও মন্নু নগর এলাকায় বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি পরিষদ, র‌্যাব’র ফ্রি-মেডিক্যাল ক্যাম্প, গাজীপুর সিভিল সার্জন অফিস, হামদর্দ ওয়াক্ফ, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিকেলস, টঙ্গী ঔষধ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি, ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক কলেজ, বাংলাদেশ হোমিও প্যাথিক পরিষদ, জাতীয় ইমাম সমিতি, ইসলামি ফাউন্ডেশনের ইসলামি মিশন, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনেরসহ বিভিন্ন ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসকরা সেবা দিচ্ছেন। এলোপ্যাথি ছাড়াও মুসুল্লীরা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিতে তাদের ক্যাম্পে ভিড় করেছেন। অসুস্থ্যদের অধিকাংশই ঠান্ডা, সর্দি, কাশি, আমাশয়, শ্বাসকষ্টের রোগী।   

বিশেষ ট্রেন ॥ বিশ্বইজতেমা উপলক্ষে বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে আখাউড়া, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন রুটে বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া আখেরি মোনাজাতের আগে ও পরে সকল ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে যাত্রা বিরতি করবে। টঙ্গী রেলওয়ে জংশন সূত্রে জানা গেছে, রবিবার আখেরি মোনাজাতের দিন জামালপুর-টঙ্গী একটি, আখাউড়া-টঙ্গী একটি, টঙ্গী-ময়মনসিংহ, লাকসাম-টঙ্গী রুটে বিশেষ ট্রেন যাতায়াত করবে। এছাড়াও আখেরি মোনাজাতের আগে-পরে সব ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে যাত্রা বিরতি করবে বলে জানিয়েছেন টঙ্গীর রেলওয়ে স্টেশনের কর্মকর্তা।

বিশ্ব ইজতেমায় বিদেশি মুসল্লি ॥ গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের এক সূত্র জানায়, শনিবার সকাল পর্যন্ত বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশের কয়েক হাজার সংখ্যক বিদেশী মুসল্লি ইতোমধ্যে ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন। আরো বিদেশী মেহমান টঙ্গীর পথে রয়েছেন। বিভিন্ন ভাষা-ভাষী ও মহাদেশ অনুসারে ইজতেমা ময়দানে বিদেশী মেহমানদের জন্য পৃথক বিদেশী নিবাস নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। 

আখেরী মোনাজাত উপলক্ষে বাড়তি নিরাপত্তা ॥ মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি’র) কমিশনার মোঃ মাহবুব আলম জানান, বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে গাজীপুর পুলিশ প্রশাসন বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে। ট্রাফিক বিভাগও মুসল্লিদের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত ও সুষ্ঠুভাবে যানবাহন চলাচলের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। ঢেলে সাজানো হয়েছে ট্রাফিক বিভাগকে। যানজট নিয়ন্ত্রণে নানা মুখী পরিকল্পনা রয়েছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু রাখতে এবার ডিজিটাল নজরদারী কয়েকগুন বাড়ানো হয়েছে। প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে আজ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, টঙ্গী-কালিগঞ্জ সড়কে দুপুর পর্যন্ত যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যেহেতু আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে দুরদুরান্ত থেকে মুসল্লীরা ইজতেমা ময়দানে আসবেন, সেহেতু শনিবার মধ্যরাত হতে কয়েকটি সড়কে যানবাহন চলাচলে বন্ধ রাখা হবে। 

শনিবার দিবাগত রা ১২টার পর হতে টঙ্গী থেকে ভোগড়া বাইপাস ও মীরের বাজার, আশুলিয়া অর্থাৎ অব্দুল্লাহপুর ব্রিজ থেকে আশুলিয়ার বাইপাইল এবং টঙ্গীর স্টেশন রোড হয়ে কামারপাড়া সড়কে সকল ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। সেক্ষেত্রে ভোগড়া থেকে তিন’শ ফিট পর্যন্ত বাইপাস হয়ে চলে যাবে ঢাকাগামী লোকজন। যেসব মুসল্লি বা লোকজন ময়মনসিংহ বা গাজীপুর যাবে তারা বাইপাইল থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা হয়ে ময়মনসিংহের দিকে চলে যাবে। রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বিধিনিষেধ বলবৎ থাকবে। তবে আখেরি মোনাজাতের দিন রবিবার সকাল থেকে মুসুল্লীদের সুবিধার্থে গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাস মোড় থেকে ইজতেমাস্থল পর্যন্ত বিআরটিসি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রায় একশ’ (ইজতেমার স্টিকার লাগানো) শ্যাটল বাস চলাচল করবে। আমরা ইজতেমা মাঠে অবস্থানরত সূরা সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছি, চেষ্টা করছি যেন আখেরি মোনাজাত বেলা ১১টার মধ্যে শুরু করা যায়। 

ইজতেমা সফল করতে স্থানীয় পর্যায়ের উদ্যোগ
গাজীপুরের এমপি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান ও সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী ইলিয়াস আহমেদ স্থানীয় পর্যায়ে ইজতেমার শীর্ষ মুরুব্বিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন ইজতেমা সফলভাবে অনুষ্ঠানে।
এদিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জায়েদা খাতুন বলেছেন, বিশ্ব ইজতেমার মুসল্লী ও আয়োজকদের ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারনে নারীদের ইজতেমায় আসা বারন থাকায় ধর্মীয় নিয়মকানুন ও মুসল্লীদের অনুভূতির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা রেখে আমি ইজতেমা ময়দানে না এসে আমার ছেলে গাজীপুর সিটির উপদেষ্টা সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে ইজতেমার মুসল্লীদের খেদমত ও দেখভালোর জন্য নিয়োগ করেছি। ইজতেমার শেষ দিন পর্যন্ত আমার ছেলে জাহাঙ্গীর আলম ইজতেমা মাঠে মুসল্লীদের খেদমতে থাকবে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জায়েদা খাতুনের পুত্র সিটির উপদেষ্টা সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম সিটির ইজতেমা ময়দানের কন্ট্রোলরুমে সাংবাদিকদের বলেছেন, গাজীপুর সিটির মেয়র জায়েদা খাতুনের নির্দেশনা বাস্তবায়নে আমি নিজেই সারাক্ষণ ইজতেমা ময়দানে অবস্থান করে সেবাদান নিশ্চিত করছি। দেশবিদেশ থেকে আসা লাখ লাখ তাবলীগ অনুসারী মুসল্লীদের খেদমতে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের জনবলের সেবাদান ২৪ ঘন্টাই নিয়োজিত রাখা হয়েছে। 

আয়োজক সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর কাকরাইল জামে মসজিদে প্রথম বিশ্ব ইজতেমার প্রচলন শুরু হয় ১৯৪৬ সালে। এরপর ১৯৪৮ সালে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামে। ১৯৫৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। ১৯৬৬ সাল থেকে গাজীপুরের শিল্প নগরী টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সব মিলিয়ে ধারবাহিকভাবে বিশ্ব ইজতেমা পরিচালিত হচ্ছে।

 

এস

সম্পর্কিত বিষয়:

×