ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

আলোর নিচে অন্ধকার

মালিবাগেও একই অবস্থা ॥ ফ্লাইওভার ও দুর্ভোগ ৪

ফজলুর রহমান

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩

মালিবাগেও একই অবস্থা ॥ ফ্লাইওভার ও দুর্ভোগ ৪

মালিবাগ ফ্লাইওভারের নিচে এভাবেই ফাঁকা জায়গা দখল করে চলছে জমজমাট ব্যবসা

মৌচাক থেকে শান্তিনগর পর্যন্ত ফ্লাইওভারের নিচের ফাঁকা জায়গা, পাশে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ দুটি ইউনিট সিআইডি ও এসবির সদর দপ্তর। দুই অফিসের গেট বরাবর ফুটপাতের ডিভাইডারে আস্তানা গেড়েছে ভবঘুরেরা। ডিভাইডারের নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরে উঠতি বয়সী এসব ভবঘুরে দিনরাত অবস্থান করছে। প্রকাশ্যে ছেলেমেয়েরা একত্রিত হয়ে মাদক সেবন করছে। সাধারণ পথচারী, ওখানকার কর্মকর্তাদের চোখের সামনে এসব ঘটলেও তারা দেখেও যেন দেখছে না। ফলে নিরাপদভাবে অপরাধ কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে এরা। তা সত্ত্বেও এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব কার, সেটি নিয়ে পুলিশ ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ভিন্ন ভিন্ন যুক্তি দেখাচ্ছেন। 
বিষয়টি নজরে এনে জানতে চাইলে সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, বিষয়টি তাদের জানা নেই। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব ডিএমপির। তার পরও তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। রমনা থানা পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশ বলছে, ভাসমান ভবঘুরে ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে, তাদের চাইলেও পুলিশ আটক করতে পারে না। আটক করলেও মামলা দায়ের করা সম্ভব হয় না। তখন সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে শিশু-কিশোর সংশোধনাগারে প্রেরণ করা হয়। আর সমাজসেবা অধিদপ্তর বলছে, এদের আটক করার দায়িত্ব পুলিশের। তারা আটক করে হস্তান্তর করলে তখন আশ্রয়ণ কেন্দ্রে রেখে প্রশিক্ষণসহ মোটিভেশন করা হয়।  
বেশ কয়েক দিন মৌচাক থেকে শান্তিনগর পর্যন্ত ফ্লাইওভারের নিচের সড়কটি সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, সিআইডি-এসবি অফিসের গেট বরাবর উত্তর পাশে ডিভাইডারের ভেতরে ১৩/১৪ জন ভবঘুরে শুয়ে-বসে নিয়মিত আড্ডা দিচ্ছে। এদের বয়স ১০ থেকে ১৫ এর মধ্যে। গত ২৯ আগস্ট বেলা ৩টার দিকে দেখা যায়, কিশোরদের মধ্যে দুজনে বসে সিগারেটের ভেতর গাঁজা ঢুকাচ্ছে। পাশ থেকে আরও দুজনে গাঁজা বানিয়ে দিচ্ছে। এরই মধ্যে আরেকজন ডিভাইডার টপকিয়ে ভেতরে ঢুকে। হাফপ্যান্টের ভাঁজ থেকে মোড়ানো সাদা কাগজ বের করে। সেটির ভেতরেও গাঁজা। মোড়ানো কাগজ থেকে গাঁজা বের করে সিগারেটের শুকার সঙ্গে মেশায়।

এর পর সিগারেটের ভেতরে ঢুকিয়ে সেখানে বসেই দিব্যি সেবন করে ওই সময় উপস্থিত থাকা ৮ জন। পাশে থাকা অন্যদের পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব থাকলেও তারা যে যার মতো আড্ডা দিচ্ছিল। তিনজন কিশোরী একে অন্যের মাথায় উকুন বেছে দিচ্ছে। পরবর্তীতে গাঁজা সেবনকারীদের দলে যোগ দিয়ে তারাও গাঁজা সেবন করে। অথচ জনবহুল এই সড়কে পেয়ে হেঁটে, যানবাহনে চড়ে পাশ দিয়ে যাচ্ছিল মানুষজন। এ সময় কৌশলে তাদের এমন কর্মকা- মোবাইল ফোনে ধারণ করে রাখে এই প্রতিবেদক। কিছুক্ষণ পর কথা হয় এদের কয়েকজনের সঙ্গে। তবে ভালো-মন্দ কোনো ধরনের কথাই বলতে নারাজ তারা। 
এক কিশোরের নাম জানতে চাইলে সে উল্টা প্রতিবেদকের নাম জানতে চায়। পড়ালেখা করবে? পরবর্তীতে প্রশ্নের জবাবে সে তার পাশের কিশোরকে দেখিয়ে বলে, আমারে বলে লাভ  নেই। ওরে বলেন। তোমাদের বাড়ি  নেই? উত্তরে আরেকজন বলে, এটাই আমাদের বাড়িঘর। খাবার পাও কোথায়? উত্তরে সে বলে- চাইয়া খাই, যে যা দেয় তা-ই খাই। এসময় পাশ থেকে এদের টিম লিডার টাইপের একজন প্রতিবেদকের সঙ্গে কিশোরদের কথা বলতে নিষেধ করে এবং প্রতিবেদককে বলে, এই ভাই আপনি যান তো। তবে এদের দ্বারা আরও বড় ধরনের অপরাধ কর্মকা- সংঘটিত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। 
ফ্লাইভারটি শান্তিনগরে শেষ হওয়ার অংশ বরাবর নিচের ডিভাইডারে ভবঘুরে না থাকলেও কার্টনের ওপর বসে আশপাশে থাকা অফিসের স্টাফদের মাদক সেবন করতে দেখা গেছে। রিক্সা চালকসহ বয়স্ক অনেকে সেখানে আড্ডা জমিয়ে মাদক সেবন করে। অথচ এর পাশেই শান্তিনগর ট্রাফিক পুলিশ বক্স। তার পরও ওই স্থানে নির্বিঘেœ মাদক সেবন করা হয়। শান্তিনগর ট্রাফিক সিগন্যালের উত্তর পাশে অর্থাৎ ফ্লাইওভারে ওঠার আগে ডিভাইডারে ছিন্নমূল কয়েকজনকে ব্যাগ, কাপড়-চোপড় নিয়ে শুয়ে থাকতে দেখা গেছে। তবে এদের অনেকে প্রতিবন্ধী। পায়ে পচন ধরেছে এমন লোকও রয়েছে। শান্তিনগর থেকে সিআইড-এসবি অফিসের সামনের সড়ক হয়ে মৌচাক পর্যন্ত অংশের টিআই (ট্রাফিক ইন্সপেক্টর) হলেন মো. শফিকুল ইসলাম। ট্রাফিক মতিঝিল বিভাগের সবুজবাগ জোনে কর্মরত তিনি। 
জানতে চাইলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ওই সড়ক ধরে সিআইডি ও এসবির ঊর্ধ্বতন স্যাররা দৈনিক একাধিকবার যাতায়াত করেন। বিষয়টি মাথায় রেখেই আমি ওখানকার সড়ক ক্লিয়ার রাখার চেষ্টা করি। যে সকল ভবঘুরের কথা বলা হয়েছে, তারা অপ্রাপ্ত বয়স্ক। তাদের আটক করে আমি কি করব! একাধিকবার সমাজসেবা অধিদপ্তরকে বিষয়টি বলেছি। কিন্তু তারা সহায়তা করেনি। তাদের বলেন, তারা আসুক, আমি ধরে দেই। তারা (সমাজসেবা অধিদপ্তর) চাইলেই আমি ধরে দেব। এই কাজটা মূলত সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন কর্মকর্তার, এমনটি জানিয়ে টিআই আরও বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তরের থানাভিত্তিক প্রবেশন কর্মকর্তা থাকে। তারাই মূলত এই কাজটি করে। বয়স অনুযায়ী কাউকে শিশু-কিশোর সংশোধনাগারে, কাউকে আশ্রমে প্রেরণ করে। চাকরি জীবনে ঢাকার বাইরে এমনটি দেখলেও ঢাকায় কখনো চোখে পড়েনি। 
জানতে চাইলে রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করি। ওখানেও অভিযান চালানো হবে। ওখানে যারা আস্তানা গেড়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ শাখা) আদিল মোত্তাকীন জনকণ্ঠকে বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট কাউকে ভবঘুরে ঘোষণা করলে তাকে অধিদপ্তরের অধীনে আশ্রয়ণে রেখে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, মোটিভেশন করা হয়। এদের মধ্যে যাদের ঠিকানা ও অভিভাবক খুঁজে পাওয়া যায়, তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু পরিবারের আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় অনেকে আবার চলে আসে। এক্ষেত্রে পরিবারেরই উচিত- এদের ভরণ-পোষণ করা।

পরিবার সেই ব্যবস্থা করলে এবং সচ্ছল করে তুললে এদের ফুটপাতে মাথার নিচে ইট দিয়ে ঘুমাতে হতো না। কিন্তু অনেক পরিবার আর্থিক অভাব-অনটনের কারণে সন্তানের খোঁজ রাখে না, সন্তান কোথায় চলে গেল, কি করে, কার সঙ্গে মিশে। মিরপুরসহ সারাদেশে তাদের ৬টি আশ্রয়ণ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ৬টি আশ্রয়ণে প্রায় ৬ শতাধিক ভাসমান ভবঘুরে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অধীনে তাদের ৯টি কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রের কর্মকর্তারা এসব দেখভাল করে থাকেন। 
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। দুই সিটি করপোরেশনের সমাজসেবা অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এসব বিষয়ে মাথাই ঘামাচ্ছে না। শুধু তাই নয়; ঢাকা শহরে ভবঘুরে বা ভাসমান মানুষের সংখ্যা কত তার সঠিক হিসাব নেই সমাজসেবা অধিদপ্তরের কাছে। পুলিশ বা আদালতের মাধ্যমে কোনো ভাসমান মানুষকে সমাজসেবা অধিদপ্তরে হস্তান্তর করা হলে তখনই থাকার জায়গা, চিকিৎসাসহ খাদ্যের ব্যবস্থা করে সংস্থাটি। আশ্রয়ণে প্রায় ৬ শতাধিক ভবঘুরে রাখার ব্যবস্থার কথা কর্মকর্তা জানালেও বাস্তবে একসঙ্গে ১৭০০ ভবঘুরে মানুষকে শেল্টার দেওয়ার সক্ষমতা আছে সমাজসেবা অধিদপ্তরের।  
বিষয়টি নজরে এনে জানতে চাইলে সিআইডি সদর দপ্তরের এক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, এটি তো ডিএমপির কাজ। থানা পুলিশ চাইলে ভবঘুরেরা এখানে কিভাবে থাকে। তাদের তো নলেজে থাকা উচিত। তবে সিআইডিও এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। এটা সামান্য ব্যাপারে। ভবঘুরেরা এভাবে অবস্থান নিয়ে মাদক সেবনের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করার কথাও জানান তিনি। 
তবে ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন, ২০১১ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদ-মর্যাদার নিচে নয় এমন কর্মকর্তা অথবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা, কোনো ব্যক্তিকে ভবঘুরে বলে গণ্য করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে মর্মে নিশ্চিত হলে তিনি ওই ব্যক্তিকে যে কোন স্থান থেকে যে কোনো সময় আটক করতে পারবেন। আটককৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করতে হবে।

আটককৃত ব্যক্তিকে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থিত করা হলে তিনি আটক করার কারণ, তারিখ, সময়, ঘটনার বিবরণ, বয়স, শারীরিক ও মানসিক অবস্থা সংক্রান্ত তথ্যাবলি নথিতে লিপিবদ্ধ করে রেজিস্টারে সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি সংরক্ষণ করবেন এবং প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট যদি যুক্তিসঙ্গত কারণে প্রতীয়মান হয় যে, আটক কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে অধিকতর অনুসন্ধান বা তথ্য প্রয়োজন, তা হলে কারণ লিপিবদ্ধ করে তিনি ওই ব্যক্তিকে, অন্য আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন প্রধান ব্যবস্থাপকের তত্ত্বাবধানে নিকটস্থ অভ্যর্থনা কেন্দ্রে সাময়িক হেফাজতে রেখে তার সম্পর্কে অনধিক ৭ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধানপূর্বক বা নির্দিষ্টকৃত তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য নিকটস্থ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, প্রবেশন কর্মকর্তা বা অন্য কোনো উপযুক্ত ব্যক্তিকে নির্দেশ প্রদান করতে পারবেন।

পরবর্তীতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয়, আটককৃত ব্যক্তি ভবঘুরে নয়, তা হলে কারণ লিপিবদ্ধ করে তিনি ওই ব্যক্তিকে বিনাশর্তে বা ক্ষেত্রমত, প্রয়োজনীয় মুচলেকা গ্রহণপূর্বক, তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তিদানের আদেশ প্রদান করবেন অথবা একজন ভবঘুরে হলে কারণ লিপিবদ্ধ করে ওই ব্যক্তিকে ভবঘুরে ঘোষণাপূর্বক এই আইনের অন্যান্য বিধান সাপেক্ষে, যে কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে অনধিক ২ বৎসরের জন্য আটক রাখার নিমিত্ত অভ্যর্থনা কেন্দ্রে প্রেরণের আদেশ প্রদান করবেন। আইনে এমনটি উল্লেখ থাকলেও ঢাকা শহরের যেখানে-যেখানে ছিন্নমূল, ভাসমান ভবঘুরে চোখে পড়ার মতো। এদের পুনর্বাসনের সংখ্যা হাতেগোনা।

×