ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি 

কালভার্ট উড়িয়ে পাকসেনাদের যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেই

বিকাশ চৌধুরী, পটিয়া

প্রকাশিত: ০০:২০, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

কালভার্ট উড়িয়ে পাকসেনাদের যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেই

খায়ের আহমদ

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। রেডিওতে হঠাৎ শোনা যায়, দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। যে যে অবস্থায় আছে, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানানো হয় রেডিওতে। রেডিওতে যুদ্ধের কথা শুনে উৎসাহিত হয়ে পটিয়া সদরে ছুটে যান পটিয়ার হাইদগাঁও ইউনিয়নের ২১ বছরের যুবক খায়ের আহমদ। তিনি খবর পেলেন পাশের বোয়ালখালী উপজেলার করলডেঙ্গা ও পটিয়ার হাইদগাঁও পাহাড় হয়ে মেজর জিয়াউর রহমান পটিয়ায় আসছেন। এজন্য সেনাবাহিনী পটিয়া সরকারি কলেজে একটি ক্যাম্প করেছে। সেখানেই মেজর জিয়াউর রহমান স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন।

বৈঠক শেষে রেডিও স্টেশন থেকে ট্রান্সমিটার সরিয়ে কালুরঘাট ব্রিজ এলাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের মানুষকে ঝাঁপিয়ে পড়তে জিয়াউর রহমান একটি ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এটি শুনেই তরুণ খায়ের আহমদ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যুদ্ধকালীন সময়ে পটিয়া আল জামেয়া আল ইসলামিয়া মাদ্রাসা (কওমি মাদ্রাসা) ও পটিয়া রাহাত আলী স্কুলে ছিল পাকবাহিনী ও রাজাকার-আলবদরের ঘাঁটি।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা খায়ের বলেন, ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে তিনিসহ বিভিন্ন থানার ৩১৭ জন স্বাধীনচেতা যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আমরা রাঙ্গুনিয়ার রাজারহাট, পদুয়া হয়ে ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য রওনা দেই। দুর্গম পাহাড় হয়ে প্রায় সাতদিন হেঁটে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের জারুলছড়ি পৌঁছি। সেখানে ভারতীয় আর্মি ক্যাম্পের সৈনিকরা আমাদের গ্রহণ করেন। আরও দুদিন হেঁটে পানছড়ি, কচুছড়ি অতিক্রম করে দেমাগ্রী শহরে পৌঁছি।

সেখানে ভারতীয় সেনা ক্যাম্পে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ চলছিল। তখন ওখানে একটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের প্রশিক্ষণ চলছিল। আমাদের মধ্য থেকে ২১ জনকে ট্রেনিং ক্যাম্পে রিক্রুট করার ব্যবস্থা করে নেওয়া হয়। প্রথমে দৌড় প্রতিযোগিতা, তারপর লুসাই নদীতে ঠা-া পানিতে সাঁতার প্রতিযোগিতা ও সর্বোপরি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে রিক্রুট করা হয়। এর মধ্যে দুই গ্রুপে ভাগ করে এক মাস শারীরিক ও অস্ত্রের ট্রেনিং দেওয়ার পর ভারতের অন্য রাজ্য অসমে পাঠানো হয়। সাতদিন পর বগাফায় ফায়ারিং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। রাইফেল, এলএমজি, মাইন, এন্টি ট্যাংক মাইন, গ্রেনেড নিক্ষেপসহ বিভিন্ন বিস্ফোরক চার্জ করার প্রশিক্ষণ নেই।

পরে হরিণা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শেষ করে গ্রুপ কমান্ডার মোহাম্মদ আবু সৈয়দের (প্রয়াত) নেতৃত্বে আরও ছয়জনসহ ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ১৮৯নং গ্রুপ গঠন করা হয়। গ্রুপের প্রত্যেককে অস্ত্র গোলাবারুদ দিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। আমাদের গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন আবু সৈয়দ। সহযোগী ছিলেন দুলাল ঘোষ, মোহাম্মদ আলী, আনোয়ারুল আজিম, মৃদুল কান্তি সর্দার, আবদুস ছালাম, সামশুল আলম, সুনত্ত বড়ুয়া, আবু ছিদ্দিক, শুধাংশু বিমল চৌধুরী, অমূল্য দাস, রনধীর দাশ, আর্সেন্দু দস্তিদার, নুর মোহাম্মদ, সামশুল আলম, মো. ইব্রাহিম, আবদুল খালেক, মাহমুদুল হক, আবদুস ছবুর, রতন ধর, রনজিত কুমার, ডা. মিলকান্তি সেন, আবদুল রহিম। 
তিনি আরও বলেন, ভারতের অসমের হরিণা ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পটিয়া, সাতকানিয়া, বোয়ালখালী, রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া থানার পাঁচটি গ্রুপের ১২৮ জন মুক্তিযোদ্ধা ট্রাকযোগে রাত নয়টার দিকে বাংলাদেশের বৈষ্ণবপুর সীমান্তে পৌঁছি। সীমান্ত অতিক্রম করে হেঁটে সে রাতেই ফটিকছড়ির যুগ্যাছোলা বাজারের পাশে এলে পাহাড়ের টিলার ওপর একটি খামার বাড়িতে শুধু গ্রুপের যোদ্ধারা অবস্থান নেই। পাহাড়ের অন্য একটি স্থানে চারটি গ্রুপ অবস্থান নেয়।

আমি ছিলাম প্রবেশমুখে। কিছু দূরে রাজবাড়ি আর্মি ক্যাম্পে তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা অবস্থান করছিল। পাক সৈন্যদের বিরামহীন গুলিবর্ষণ ও মর্টার শেলের বিকট শব্দে ওইদিন এলাকাটি প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। আমাদের দলের দুজন গুলিবিদ্ধ হয়। এর মধ্যে মৃদুল সর্দার ও আনোয়ারুল আজিম গুরুতর আহত হন। অতিরিক্ত রক্তক্ষণ হওয়ায় তাদের পাহাড়ের ভেতরে মেডিক্যাল ক্যাম্পে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর মধ্যে গ্রুপ কমান্ডার আবু সৈয়দ সিদ্ধান্ত নেন, রাজবাড়ি ক্যাম্পের দক্ষিণের চট্টগ্রাম শহরে যাওয়ার পথে একটি কালভার্ট বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার।

ওইদিন গভীর রাতের দিকে বিরামহীনভাবে পাকিস্তানি আর্মির ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে এবং কালভার্ট উড়িয়ে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে পাক সেনারা খবর পেয়ে গুলিবর্ষণ করে। পরে ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাঙ্গুনিয়া, বোয়ালখালী অতিক্রম করে পটিয়ার কেলিশহরে ফিরে আসি। শুরুতে কেলিশহর পাহাড়ে প্রথম যোগাযোগ করেন আবদুর রশিদ মেম্বার, গণি কাইতং ও আহমদ ছফা। এরপর থেকে একেকদিন একেক জায়গায় অপারেশন শুরু হয়। হাইদগাঁও পানবাজার এলাকায় আলীন নবী ও গোলাম নবী নামে দুই ভাইয়ের তথ্যমতে, ছয় রাজাকারকে আত্মসমর্পণ করাতে সক্ষম হই।
বীর মুক্তিযোদ্ধা খায়ের আহমদ বলেন, প্রশিক্ষণ শেষে পটিয়ায় ফিরলে খবর পাই পটিয়া কওমি মাদ্রাসায় পাকবাহিনী ও রাজাকার-আলবদরের ঘাঁটি হয়েছে। দলবল নিয়ে ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিবাগত ভোরে পটিয়া কওমি মাদ্রাসায় আক্রমণ করি। আমাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে মাদ্রাসা থেকে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা মাদ্রাসা ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরের দিন ১৩ ডিসেম্বর পটিয়া থানা দখলের পরিকল্পনা নেই। গ্রুপ কমান্ডার আবু সৈয়দের নেতৃত্বে আমরা তিন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পটিয়া থানা আক্রমণ করি।

বেলা ১১টার মধ্যে থানা দখল করে নেই। ওই সময় থানায় ছয়জন পুলিশ থাকলেও তারা কোন প্রতিবাদ করেনি। পুলিশ সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এরপরে ওইদিন পটিয়া থানায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে থানাকে শত্রুমুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে পটিয়া কওমি মাদ্রাসা দখল করে এক মাস পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে অবস্থান নেন। 
বীর মুক্তিযোদ্ধা খায়ের আহমদের পিতা দেলা মিয়া (মৃত) ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। পিতা দেলা মিয়া ও মা মোস্তফা খাতুনের অনুপ্রেরণায় খায়ের আহমদ যুদ্ধে অংশ নেন।

×