ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সিরাজগঞ্জ-৬

এক ডজন মনোনয়নপ্রত্যাশী

বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ / সৈয়দ হুমায়ুন পারভেজ শাব্বির, শাহজাদপুর

প্রকাশিত: ২৩:৩৬, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

এক ডজন মনোনয়নপ্রত্যাশী

ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প ও গো-সম্পদে ভরপুর আসন সিরাজগঞ্জ-৬ (শাহজাদপুর)

ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প ও গো-সম্পদে ভরপুর আসন সিরাজগঞ্জ-৬ (শাহজাদপুর)। এ নির্বাচনী এলাকায় হযরত মখদুম শাহদৌলা শহীদ ইয়ামেনি (রহ.) এর মাজার, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারিবাড়ি, উত্তরবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ প্রথম শ্রেণির বাঘাবাড়ী নৌ-বন্দর, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের তেল ডিপো, মিল্কভিটাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সমৃদ্ধ সিরাজগঞ্জের এই আসনটি।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এ আসনেও বইতে শুরু করেছে ভোটের হাওয়া। মনোনয়ন প্রত্যাশী আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্যান্য দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রচারও ধীরে ধীরে জোরালো হচ্ছে। এক সময়ের বিএনপির আসন বলা হলেও সময়ের ব্যবধানে আসনটি এখন আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই আসনটিতে প্রতিনিধিত্ব করছেন নৌকা নিয়ে বিজয়ী আওয়ামী লীগ।

আগামী নির্বাচনেও বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে পুরোদমে কাজ শুরু করেছে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। অন্যদিকে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে ভেতরে ভেতরে কাজ শুরু করেছে বিএনপিও। তবে বড় দুই দলেরই একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীর ভিড়ে কোন্দল, বিভেদও স্পষ্ট। 
স্থানীয় ভোটারদের মত হচ্ছে, দলগুলোতে সৃষ্ট কোন্দল নিরসন না করে প্রার্থিতা ঘোষণা করলে বিজয়ের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবে দেখা দিতে পারে। ১৯৮৬ সালের নির্বাচন থেকে শুরু করে এ আসনটি সংসদীয় এলাকা ৬৭- সিরাজগঞ্জ-৭ নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে সিরাজগঞ্জ-৬ (শাহজাদপুর) নামে পরিচিত। এই আসনটি একটি প্রথম শ্রেণির পৌরসভা ও ১৩টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এ আসনে ভোটারের সংখ্যা চার লাখ ২০ হাজার ৭শ’ ৮০ জন। মূলত এ আসন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে ভোটাররা মনে করছেন। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এ আসন থেকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনাই বেশি বলে এলাকাবাসী মনে করেন।
স্থানীয় ভোটার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ আসনটি বিগত সময়ে বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত থাকলেও বর্তমানে আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এ আসনে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সরব উপস্থিতি ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের কারণে একদিকে যেমন ভোটব্যাংক ও জনসমর্থন বেড়েছে অন্যদিকে, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল উপজেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দের নিষ্ক্রিয়তার কারণে আগের তুলনায় বিএনপি অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে অনেকেরই নাম শোনা যাচ্ছে। 
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য প্রফেসর মেরিনা জাহান কবিতা, সাবেক এমপি ও শাহজাদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি চয়ন ইসলাম, শাহজাদপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক হালিমুল হক মিরু, শাহজাদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতের স্পেশাল পিপি অ্যাড. শেখ মো. আব্দুল হামিদ লাবলু, শাহজাদপুর পৌরসভার বর্তমান মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মনির আক্তার খান তরু লোদী এবং এ আসনের প্রয়াত এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসিবুর রহমান স্বপনের মেয়ে ও শাহজাদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ফেরদৌসী রহমান শান্তা। 
অন্যদিকে, এ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির উপদেষ্টা, শাহজাদপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক প্রফেসর ডা. এম এ মুহিত, শাহজাদপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি হুসেইন শহীদ মাহমুদ গ্যাদন, জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি গোলাম সরোয়ার ও অ্যাড. হুমায়ুন কবিরের নাম শোনা যাচ্ছে।

এ ছাড়া জাতীয় পার্টি (এরশাদ)’র সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মোক্তার হোসেন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) শাহজাদপুর উপজেলা কমিটির সভাপতি শফিকুজ্জামান শফি ও সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক,  উপজেলা বাসদের সদস্য আব্দুল আলিম ফকির ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মিসবাহ উদ্দিনের নাম শোনা যাচ্ছে।
১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে কামরুদ্দিন এহিয়া খান মজলিস সরোয়ার বিএনপি দলীয় প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে বিজয়ী হন জাতীয় পার্টির হাসিবুর রহমান স্বপন। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে ৪ দলীয় জোটের প্রার্থী অধ্যাপক ডা. এম এ মতিন বিজয়ী হন। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী চয়ন ইসলাম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। 
২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হাসিবুর রহমান স্বপন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হাসিবুর রহমান স্বপন আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর হাসিবুর রহমান স্বপনের মৃত্যুতে এ আসনটি শূন্য হলে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী প্রফেসর মেরিনা জাহান কবিতা নির্বাচিত হন। শাহজাদপুরের আসনটি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকেই প্রার্থী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দখলে রয়েছে। 
বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী মেরিনা জাহান কবিতা আগামী নির্বাচনেও মনোনয়ন পাবেন বলে দৃঢ় আশাবাদী। তিনি বলেন, আমি নির্বাচিত হবার পর স্বল্প সময়ের মধ্যে শাহজাদপুরকে মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত করার প্রয়াস চালিয়েছি। নারীর মর্যাদা ও স্বাবলম্বী করার কর্মসূচি বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছি। শেখ কামাল আইসিটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টার ও শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ ও রবীন্দ্র অডিটোরিয়ামকে আধুনিকায়নের প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমি শুধু এমপি নই, আমি দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে আমার একটাই লক্ষ্য, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবারও দেশের প্রধানমন্ত্রী বানাতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে। 
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী শাহজাদপুর পৌরসভার মেয়র মনির আক্তার খান তরু লোদী বলেন, মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর জনগণের সেবায় অনেক কাজ করেছি। তৃণমূল নেতাকর্মীদের দলীয় কর্মকা-ে সম্পৃক্ত করে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে কাজ করে যাচ্ছি। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের আরও সেবা করতে নৌকার প্রার্থী হতে চাই।
দলের মুখপাত্র জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু জনকণ্ঠকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি জনগণের কোনো আস্থা নেই। তাই নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। যদিও শাহজাদপুরে বিএনপি সুসংগঠিত রয়েছে। নির্বাচনের পরিবেশ ফিরে পেলে এবং জনগণ ভোট দেবার সুযোগ পেলে  এ আসন থেকে বিএনপি প্রার্থী বিজয় লাভ করবে এবং আসনটি পুনরুদ্ধার হবে।

আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী শাহজাদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিরাজগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতের স্পেশাল পিপি অ্যাড. শেখ মো. আব্দুল হামিদ লাবলু বলেন, আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শের একজন সৈনিক হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে শাহজাদপুরে এলে উপজেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে ২০ বছর দায়িত্ব পালন করেছি।

বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ২০০১ সালে নির্বাচনের পর উল্লাপাড়ায় চারদলীয় জোটভুক্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের বর্বর হামলা ও ধর্ষণের শিকার দেশব্যাপী আলোচিত পূর্ণিমা রাণী শীলের মামলার সকল আসামিকে সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করেছি। আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের একজন কর্মী হিসেবে কাজ করব।
জাসদের মনোনয়ন প্রত্যাশী শফিকুজ্জামান শফি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে আশা করি। এই নির্বাচনে আমার দল আমাকে মনোনয়ন দিলে এবং জনগণ ভোট দেবার সুযোগ পেলে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকব।
গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী এলাকা শাহজাদপুরের মানুষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কেমন প্রার্থী চান প্রশ্নে পৌর এলাকার শেরখালির নিজাম উদ্দিন, মনিরামপুরের ডা. শাহ আলম এবং দ্বারিয়াপুরের নান্নু সরকারসহ অনেকেই বলেছেন, মর্যাদাপূর্ণ এ আসনে শিক্ষিত, মার্জিত, সৎ এবং চৌকস রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেই অভিভাবকত্বের আসনে বসাতে চাই। ভোটারদের কথা, ‘ভোট দেবার আগে ভালোভাবে জেনে নেব, কে ঋণখেলাপি আর কে বিলখেলাপি। যিনি দুঃখী মেহনতি গণমানুষের কল্যাণে কাজ করবেন, এলাকার উন্নয়ন করবেন, তেমন নেতাকেই আমরা খুঁজে নেব।

×