ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৪ মার্চ ২০২৩, ৯ চৈত্র ১৪২৯

monarchmart
monarchmart

কুহু কূজনে মুগ্ধতা

প্রকাশিত: ০২:১৩, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

কুহু কূজনে মুগ্ধতা

শীতের মৃদু কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ ধীরে ধীরে কুহু কূজনে জেগে ওঠে

শীতের মৃদু কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ ধীরে ধীরে কুহু কূজনে জেগে ওঠে, হয়ে ওঠে কর্মব্যস্তময়। আলোর হাসি শুরু হয়ে যায় চারদিকে। ঘাষের ওপর শিশির, তার ওপর রোদ। শিশিরের বিন্দু যেন হীরার টুকরোর মতো জ্বল জ্বল করছে। ততক্ষণে লাল শাপলার দীঘিতে অতিথি পাখিরা ডুব সাঁতার কিংবা খুনসুটিতে ব্যস্ত। পাখি ডাকছে কিচিরমিচির, আবার ডুব দিয়ে হারিয়ে যায় শাপলার মাঝে। একদল উড়ছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, এ লেক থেকে ওই লেকে।

বাহারি রঙের এসব অতিথি পাখির খুনসুঁটি আর ছোটাছুটি যে কারও মনকে উদ্বেলিত করে তোলে। এমনই মনোহর প্রকৃতি চোখে পড়ে দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ^বিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিটি পরতে পরতে লুকিয়ে আছে সৌন্দর্য। শীতের মৌসুমে এই ক্যাম্পাসের অপরূপ অলঙ্কার যেন অতিথি পাখি। 
সবুজ বনভূমির ফাঁকে ফাঁকে লাল ইটের তৈরি ইমারতে সজ্জিত অনন্য ভূদৃশ্যাবলীযুক্ত বৈচিত্র্যময় ক্যাম্পাস হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসের উঁচু নিচু বন্ধুর ভূমির মাঝ দিয়ে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা লেকের মাঝে ফুটে আছে নানা রঙের জলজ ফুল, বিশেষ করে লাল শাপলা ও পদ্ম। লেকের ধার ঘেঁষে অতি যতেœ বেড়ে ওঠা সারি সারি গাছ আর তারই মাঝ দিয়ে উঁচু নিচু জালের মতো ছড়িয়ে থাকা রাস্তাগুলো ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যকে করেছে আরও মনোমুগ্ধকর যেন শিল্পীর তুলির ছোয়ায় জীবন্ত কোনো ছবি।

দেশী-বিদেশী প্রায় ১০ লাখ গাছগাছালিতে ভরা সাত শ’ একরের এই ক্যাম্পাসকে দূর থেকে মনে হয় সবুজের সমুদ্র, আর ক্লাস-টিউশনির জন্য ছুটে চলা শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত নাবিক। শিক্ষাজীবনের ব্যস্ততম এই সময়ের ক্লান্তি ভোলাতেই হয়তো কোনো নিমন্ত্রণ ছাড়াই ভালোবাসার বার্তা নিয়ে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে পরিযায়ী পাখিরা ঝাঁক বেঁধে উড়ে আসে লাল ইটের এই ক্যাম্পাসে। 
ভালোবাসার মানুষের এরকম অপ্রত্যাশিত আগমন কার না ভালো লাগে? সেই ভালোবাসার সম্মোহন যদি স্বয়ং প্রকৃতি জানান দিয়ে যায় তা উপভোগ না করে থাকা অসম্ভব। প্রতি শীতেই বিনা বিজ্ঞপ্তিতেই ভালোবাসার দূত হয়ে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে জাহাঙ্গীরনগরে ভালোবাসার বার্তা নিয়ে ছুটে আসে হাজার হাজার অতিথি পাখি। অতিথি পাখিরা ক্যাম্পাসজুড়ে দাপিয়ে বেড়ায় অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকেই। দিন যত গড়ায়, আরও জমে ওঠে তাদের মজলিশ। অতিথি পাখির আগমনে নির্জন ক্যাম্পাসের জলাশয়গুলো শীতের শুরুতেই প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। পাখির কলতানে দিনভর মুখর থাকে এসব জলাশয়। অতিথি পাখির আগমন লেকগুলোতে ছড়ায় মুগ্ধতা। 
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট-বড় মোট ১২টি জলাশয় রয়েছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনের জলাশয়, জাহানারা ইমাম ও প্রীতিলতা হলো সংলগ্ন জলাশয়, ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারের ভেতরের জলাশয়, সুইমিংপুল এলাকার জলাশয়ে অতিথি পাখির আধিক্য দেখা যায়। এই জলাশয়গুলো অতিথি পাখির জন্য উন্মুক্ত করে রাখা হয়। 
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তথ্যমতে, ১৯৮৬ সাল থেকে জাবি ক্যাম্পাসে সর্বপ্রথম অতিথি পাখি আসতে শুরু করে। তখন ক্যাম্পাসে ৯৮ প্রজাতির পাখি দেখা যেত। বর্তমানে ১৯৫ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। এর মধ্যে ১২৬টি দেশীয় প্রজাতির এবং ৬৯টি বিদেশি। এদের বেশির ভাগই হাঁস জাতীয় পাখি। এ ক্যাম্পাসে যেসব পাখি আসে সেসবের মধ্যে ৯৮ শতাংশই ছোট সরালি। আর বাকি ২ শতাংশ অন্য প্রজাতির পাখি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ সূত্রে আরও জানা যায়, মূলত দুই ধরনের পাখির আগমন ঘটে এ ক্যাম্পাসে। এক ধরনের পাখি ডাঙ্গায় বা শুকনো স্থানে বা ডালে বসে থাকে ও বিশ্রাম নেয়। আরেক ধরনের পাখি পানিতে থাকে ও বিশ্রাম নেয়। এদের বেশিরভাগই হাঁসজাতীয় ও পানিতে বসবাস করে। এরাই সবার নজর কাড়ে। এর মধ্যে সরালি, পচার্ড, ফ্লাইফেচার গার্গেনি, ছোট জিরিয়া, পান্তামুখী, পাতারি, মুরগ্যাধি, কোম্বডাক, পাতারি হাঁস, জলকুক্কুট, খয়রা ও কামপাখি অন্যতম। এছাড়া মানিকজোড়, কলাই, ছোট নগ, জলপিপি, নাকতা, খঞ্জনা চিতাটুপি, লাল গুড়গুটি, বামুনিয়া হাঁস, নর্দানপিনটেল ও কাস্তে চাড়া প্রভৃতি পাখিও আসে এই ক্যাম্পাসে। 
সরেজমিনে ক্যাম্পাসের লেকগুলো ঘুরে দেখা যায়, মৌসুমের শুরুতে নভেম্বর মাসে চারটি জলাশয়ে এলেও তিনটি জলাশয় থেকেই পরিযায়ী পাখিরা চলে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় জলাশয় (জয়াপাড়া লেক) এবার বড় বড় কচুরিপানায় ভর্তি। প্রশাসন থেকে জলাশয়টি সময়মতো সংস্কার করা হয়নি। প্রথমদিকে কিছু পাখি সেখানে বসলেও এখন একটিরও দেখা নেই। কচুরিপানার কারণে এই জলাশয়ে পাখির বসার পরিবেশ যেমন নেই, তেমনি তাদের খাদ্যও তৈরি হয়নি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পরিবহন চত্বরের পাশের লেকে অতিরিক্ত লোকসমাগম ও রাতদিন যানবাহনের শব্দে পাখিরা ফিরে গেছে। ক্যাম্পাসের শুধু একটি জলাশয়ে পাখিদের দেখা মিলছে। বিশ^বিদ্যালয়ের ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারের ভেতরের ওই জলাশয়ে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত।
এ বিষয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিরুল হাসান খান জনকণ্ঠকে জানান, সংখ্যাগতভাবে পাখি যতটা না কমেছে তার চয়ে বেশি কমেছে বৈচিত্র্যের দিক থেকে। বেশ কয়েক বছর ধরেই সারা বাংলাদেশেই আশঙ্কাজনকহারেই পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমেছে। পাখির আবাসস্থলের গুণগত অবস্থা দিন দিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনও পরিযায়ী পাখির সংখ্যার ওপর প্রভাব ফেলছে।

monarchmart
monarchmart

শীর্ষ সংবাদ: