ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

পঞ্চগড়-১

জোট-মহাজোটের নেতারা মাঠে

এ রহমান মুকুল, পঞ্চগড়

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ১৪ জানুয়ারি ২০২৩

জোট-মহাজোটের নেতারা মাঠে

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে আরও এক বছর বাকি

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে আরও এক বছর বাকি থাকলেও এরই মধ্যে শুরু হয়েছে মাঠ পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দৌড়ঝাঁপ। যোগাযোগ বেড়েছে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রথম সারির নেতাদের এমনকি কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতারাও মাঝে মধ্যে এলাকায় এসে গণসংযোগ করছেন। সভা-সমাবেশ না করলেও নির্বাচনী মাঠ সাজাতে নেমেছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ জোট-মহাজোটের নেতাকর্মীরা।

রাজনীতির ময়দানে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জোট-মহাজোটের দলীয় মনোনয়ন কে পাচ্ছেন এমন নানা গুঞ্জনও চলছে মাঠে-ময়দানে। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক মেরুকরণে কী হতে পারে ও কে কোন দল থেকে নির্বাচনী মনোনয়ন পেতে পারেন এ নিয়ে চায়ের আড্ডায় সচেতন সমাজের প্রতিনিধি ও রাজনীতি নিয়ে ভাবেন এমন লোকজনের মধ্যে মিশ্র ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও শোনা যাচ্ছে দেশের সর্ব উত্তরের সীমান্তঘেঁষা জেলা পঞ্চগড়ে। 
দেশের সর্ব উত্তরের হিমালয়কন্যা জেলা পঞ্চগড়। পাঁচ উপজেলা নিয়ে পঞ্চগড় জেলায় সংসদীয় আসন দুটি। পঞ্চগড় সদর, তেঁতুলিয়া ও আটোয়ারী উপজেলা নিয়ে পঞ্চগড়-১ আসন। আয়তনে ছোট হলেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে শুরু করে আজকে পর্যন্ত কেন্দ্রীয় রাজনীতির শীর্ষে থেকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, জাতীয় সংসদ ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন জেলার কয়েকজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ।

১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির বর্ষীয়ান নেতা মরহুম মির্জা গোলাম হাফিজ পঞ্চগড়-১ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হলে এবং বিএনপি সরকার গঠন করলে মির্জা গোলাম হাফিজকে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারকে শিক্ষামন্ত্রী করা হয়। পরবর্তীতে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট পুনরায় ক্ষমতায় এলে ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার স্পিকার নির্বাচিত হন এবং কিছুদিনের জন্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বও পালন করেন।  
পঞ্চগড়-০১ ॥ পঞ্চগড় সদর, আটোয়ারী ও তেঁতুলিয়া উপজেলা নিয়ে পঞ্চগড়-১ আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মজাহারুল হক প্রধান দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী তৎকালীন জাতীয় সংসদের স্পিকার ব্যারিস্টার মুহম্মদ জমিরউদ্দীন সরকারকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

পরে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটের কারণে আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া হলেও আসনটিতে জয়ী হন জাসদ প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল হক প্রধান। এ নির্বাচনে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় কোনো প্রার্থী তাদের জোট থেকে ছিল না। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মজাহারুল হক প্রধান তৃতীয়বারের মতো আসনটি থেকে নির্বাচন করবেন বলে শোনা যাচ্ছে।

রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদ্য বিদায়ী জেলা পরিষদ প্রশাসক আনোয়ার সাদাত সম্রাট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের সাবেক জনপ্রেক্ষিত বিশেষজ্ঞ ও জেলা আওয়াম লীগের সহসভাপতি নাঈমুজ্জামান মুক্তা, কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল লতিফ তারিন দলীয় মনোনয়নের দৌড়ে প্রতিযোগিতা করছেন। নাঈমুজ্জামান মুক্তা নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে উঠান বৈঠক, কর্মী সমাবেশসহ গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। এই আসনটিতে আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য কোনো কোন্দল নেই।
জেলা পরিষদ নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী আবু তোয়াবুর রহমানের নামও শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়া মহাজোটের সঙ্গে থাকার অংশ হিসেবে পঞ্চগড়ের সাবেক সংসদ সদস্য জাসদের একাংশের সাধারণ সম্পাদক ডাকসু নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল হক প্রধান ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা আবু সালেক আসনটি থেকে জোটগত মনোনয়ন দাবি করবেন বলে জানা গেছে। 
ইতোমধ্যে তারা সকলেই পৃথকভাবে স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সুসম্পর্ক তৈরি করছেন। প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তেমন গ্রুপিং চোখে না পড়লেও ভেতরে ভেতরে বেশ কয়েকটি দলীয় গ্রুপিং আছে বলে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন জেলা পরিষদ প্রশাসক আনোয়ার সাদাত স¤্রাটকে দলীয় মনোনয়ন না দিয়ে দলীয় ত্যাগী নেতা আবু তোয়াবুর রহমানকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার পর দলের ভেতরে আভ্যন্তরীণ কোন্দল ও গ্রুপিংয়ের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী আবু তোয়াবুর রহমান পরাজিত হন। এ ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যের বেশকিছু অভিযোগও রয়েছে প্রথম সারির বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে।

নির্বাচন বিশ্লেষক ও স্থানীয় দলীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সঠিক প্রার্থী বাছাইয়ে কোনো ভুল করলে এর কঠিন মাশুল গুনতে হবে দলটিকে। এর আগেও বিভিন্ন সময় সাংগঠনিক কর্মকা-েও পৃথক কর্মসূচি পালন করছেন দলের নেতাকর্মীরা। ঘটেছে বেশ কয়েকটি ছোটখাটো কোন্দলের ঘটনাও। রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, নিজের দলের নেতাকর্মীরাই প্রকাশ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন। এতে দলীয় অস্থিরতা বিরাজ করলে নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থীদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

নির্বাচনের আগেই দলীয় দ্বন্দ্ব মেটাতে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে আগামী নির্বাচনে ফল বিপর্যয় হতে পারে বলেও তারা আশঙ্কা করছেন। অপরদিকে মনোনয়ন নিয়ে জোট-মহাজোটের শরিক দলগুলোও কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিতে দুই দলেরই প্রধান অন্তরায় শরিক দল। জোট-মহাজোটের হিসাব-নিকাশও করতে হচ্ছে প্রধান দল দুটিকে। আগামী নির্বাচনে উভয়দলের শরিক দলগুলো নিয়েও হযবরল অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। মহাজোটের শরিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টি, জাসদ মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বদ্বিতা করতে মুখিয়ে আছে। দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশনায় তারাও স্ব স্ব জায়গা থেকে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন।
এ দিকে, বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে রাজপথের আন্দোলনে থাকলেও ভেতরে ভেতরে তারাও আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মাঠের রাজনীতি এবং স্থানীয় দলীয় নেতা-কর্মীদের উজ্জিবিত করতে বিভাগীয় পর্যায়ে গণসমাবেশ করেছেন। ইতোমধ্যে ৯টি বিভাগীয় গণসমাবেশে ব্যাপক জনসমাগম ঘটায় এই দলটির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও বেশ চাঙ্গা। এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে কেন্দ্রীয় নেতারা মাঝে মধ্যে এলাকায় এসে গণসংযোগ করছেন।

অন্যদিকে জেলার রাজনীতিতে বেশ ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে বিএনপি। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকায় দলীয় তেমন কোনো কোন্দল নেই দলটিতে। নেতাকর্মীদের মিছিল মিটিং বা দলীয় সভা-সমাবেশ তেমন একটা না থাকলেও ভেতরে ভেতরে নির্বাচনী মাঠে যোগাযোগ রক্ষা করছেন দলীয় প্রথম সারির নেতারা। বিএনপির দুর্গ’খ্যাত সংসদীয় আসন দুটি পুনরুদ্ধার করতে তারা দলীয় ভাবে সংগঠিত হচ্ছে। জামায়াতের রাজনীতি বাতিল হওয়ার পরও ভোটের রাজনীতিতে দলটি জামায়াতের সমর্থন ও ভোট দুটোই পাবে শতভাগ। 
বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে অবশ্য বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী সাবেক ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার। বিএনপি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারেন এমন আলোচনা রয়েছে দলের ভেতরে-বাইরে। সেক্ষেত্রে এই আসনে ব্যারিস্টার নওশাদ জমিরই তার উত্তরসূরি। নেতাকর্মীরাও নওশাদ জমিরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন।

তিনি বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আশীর্বাদপুষ্ট। ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার কোনো কারণে নির্বাচনে অংশ না নিলে ছেলে এ আসন থেকে লড়বেন এমনটাই মনে করছেন বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। 
এদিকে পঞ্চগড় পৌরসভার সাবেক মেয়র তৌহিদুল ইসলাম বিএনপির মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। তবে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। আবার এই আসনে গত নির্বাচনে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন ২০-দলীয় জোটের শরিক জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি জাগপার সদ্য প্রয়াত সভাপতি শফিউল আলম প্রধানের মেয়ে ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান। দুজনই তরুণ ব্যারিস্টার। এ ছাড়া বিএনপির সঙ্গে জোটে থাকা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর দলীয় শক্তি তেমন একটা না থাকায় এখানে তারা বিএনপির কোনো জোট থেকে মনোনয়নের দৌড়ে এগোবেন না বলে জানা গেছে।

ফিরে দেখা ॥ ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে পঞ্চগড়-১ আসনে জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক, বর্তমান জেলা কমিটির সহসভাপতি মজাহারুল হক প্রধান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৯১ সালে সাবেক স্পিকার ও সাবেক আইনমন্ত্রী মির্জা গোলাম হাফিজ, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার জয়লাভ করলেও বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত আসনটি ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের দখলে চলে যায়।

২০১৪ সালের নির্বাচনে জোটের প্রাথী হিসেবে জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবু সালেক লাঙল প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। ওই নির্বাচনে অবিভক্ত জাসদের প্রার্থী বর্তমানে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদের (একাংশ) সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল হক প্রধান মশাল প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অবশ্য বিএনপি নির্বাচনে না আসায় এ আসনে একাধিকবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী নাজমুল হক প্রধান প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

জেলা থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চলা নেতাকর্মীদের ধারণা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বর্তমান সংসদ সদস্য মজাহরুল হক প্রধান, আনোয়ার সাদাত স¤্রাট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের সাবেক জনপ্রেক্ষিত বিশেষজ্ঞ নাঈমুজ্জামান মুক্তা, জাসদের সাবেক সংসদ সদস্য নাজমুল হক প্রধান, জাপা’র আবু সালেক নাকি অন্য কেউ আসছে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে। জোটের প্রার্থীরা ছাড় না দিলে এ আসনে মনোনয়নকে কেন্দ্র করে নানা  মেরুকরণ সৃষ্টি হতে পারে। আসতে পারে দলের ত্যাগী কোনো নতুন মুখ।

×