ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আমিনুল ইসলাম চৌধুরী

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ

প্রকাশিত: ০০:৫৮, ৬ ডিসেম্বর ২০২২

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

আমিনুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজগঞ্জের যমুনাপাড়ের ভাটপিয়ারীতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম এবং সফল যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করা পাকিস্তানি হায়েনাদের গুলিতে আহত হয়েছিলেন তৎকালীন সিরাজগঞ্জ মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য ষাটের দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা আমিনুল ইসলাম চৌধুরী। সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের মধ্যে আমিনুল ইসলাম চৌধুরী এখন বয়সের ভারে শয্যাগত। তবে এখনো তার স্মৃতি শক্তি প্রখর।
শহরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী রোডে বাসায় তিনি অনেকটা একাই থাকেন। তার সহধর্মিণী মুক্তিযোদ্ধা সাফিনা লোহানীর মৃত্যুর পর তার শরীরে রোগ ও শোক আরও বড় আকারে বাসা বেঁধেছে। তার একমাত্র ছেলে ও ছেলে বউ বাসায় তাকে দেখভাল করেন। তার দুই কন্যা স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় বসবাস করেন। পত্র পত্রিকা এবং মোবাইল ফোন তার সারাক্ষণের সঙ্গী।

মুক্তিযুদ্ধ ও সে সময়ের ঘটনাবলী নিয়ে তার বাসায় তিনি কথা বলেছেন জনকণ্ঠের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি দুইটি অংশে ভাগ করেছেন। একটি অংশ হচ্ছে প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং অপর অংশ সশস্ত্র যুদ্ধ। প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সবাই সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেননি। এ কথার উদাহরণসহ ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন। সিরাজগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

সেই নির্দেশনায় সারাদেশের ন্যায় সিরাজগঞ্জের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন। নেতৃত্ব দিয়েছে মহকুমা সংগ্রাম পরিষদ। সিরাজগঞ্জের স্টেডিয়ামে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন আমিনুল এবং মরহুম আমির হোসেন ভুলু।
এরপর ২৫ এপ্রিল সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার ঘাটিনা রেলওয়ে ব্রিজে পাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। সেসময় রেলপথই সিরাজগঞ্জের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল। তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক একে শামসুদ্দিন মুক্তিকামী ছাত্র জনতাকে সার্বিক সহযোগিতা দেন। তৎকালীন ছাত্র নেতা আব্দুল লতিফ মির্জা, মোজাফফর আহমেদ মোজাম (সেনাবাহিনীর বরখাস্ত মেজর), সোহরাব আলী সরকারের নেতৃত্বে ছাত্র জনতা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রতিরোধের মুখে পাকি বাহিনী পিছু হটে।

পরদিন ২৬ এপ্রিল পাকি বাহিনীর আগমন ও আক্রমণের কথা জানিয়ে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে শহরে মাইকযোগে প্রচার করে সাধারণ জনগণকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ঐদিন গভীর রাতে সিরাজগঞ্জ শহরে পাকি হানাদার বাহিনী ট্রেনযোগে অনুপ্রবেশ করে। ২৭ এপ্রিল থেকে শুরু হয় পাকি হানাদার বাহিনীর ইতিহাসের নিষ্ঠুুরতম বর্বরনির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ। দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখা যায় মুক্তিকামী নিরীহ মানুষের বাড়ি ঘর। নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যায় মেতে উঠে হানাদার বাহিনী।

এর পর বিভিন্ন দুর্গমপথ অতিক্রম করে নৌপথে ভারতে চলে যান তিনিসহ তার সতীর্থ ছাত্র নেতারা। ট্রেনিং করেন দেরাদুন ক্যাম্পে। এরপর তাকে পাঠানো হয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুব ছাত্র জনতাকে রিক্রুট করার কাজে। তিনি ফিরে আসেন কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারীতে। এ অঞ্চল ছিল সে সময় মুক্তাঞ্চল। রৌমারীতে স্থাপিত হয় মুক্তিকামী জনতার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প। পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন মহকুমা আওয়ামী লীগ নেতা শহীদুল ইসলাম তালুকদার।

প্রাচী ইসমাইল নামে পরিচিত ছাত্র নেতা ইসমাইল হোসেন প্রশিক্ষণ পরিচালকের দায়িত্বে, গোলাম কিবরিয়া, ইসহাক আলী, বিমল কুমার দাসসহ ৮ জন প্রশিক্ষক মুক্তিকামী দেশপ্রেমিক ৭০/৮০ জন যুব ছাত্র জনতাকে গেরিলা ট্রেনিং দেন। এটা ছিল একাত্তরের আগস্ট মাস।
এদিকে সিরাজগঞ্জে পাকি হায়েনার দলের সঙ্গে আঁতাত করে এ দেশীয় কিছু লোক শান্তি কমিটি গঠন করে রাজাকার, আলবদর বাহিনী গড়ে তোলে। রাজাকার আলদরের সহায়তায় পাকিহানাদার বাহিনী গ্রামাঞ্চলে অনুপ্রবেশ করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়াসহ মা বোনের ইজ্জত লুণ্ঠন ও গণহত্যায় মেতে উঠে। শহর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে সিরাজগঞ্জ সদর থানার ভাটপিয়ারীতে পাকি হায়েনার দল ক্যাম্প স্থাপন করে।

শান্তিকমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় পাকি হায়েনারা গ্রামে অনুপ্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করার নামে পরিবারের সদস্য মা- বোনকে ধরে এনে পাশবিক নির্যাতন শুরু করে। শুধু ভাটপিয়ারী নয় সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলে একই অবস্থা বিরাজ করে। খবর পেয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিব বাহিনীর কমান্ডার মোজাফ্ফর আহম্মদ মোজামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অক্টোবর মাসে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার পিপুলবাড়িয়া এবং তার আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম এবং নিকটবর্তী কাজীপুরের বিভিন্ন গ্রামে আশ্রয় নেয়।

এরপর মধ্য অক্টোবরে প্রশিক্ষিত গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম মেনে রেকি করা হয় ভাটপিয়ারীর পাকি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। শত্রু পক্ষ পাক হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ভাটপিয়ারী স্কুল ভবনের চতুর্মুখী প্রতিরক্ষা দুর্গ গড়ে তোলে। স্কুল ভবনে ঢোকার প্রধান সড়কে এলএমজি পোস্ট স্থাপন করে। স্কুলের ছাদে ছিল আরও একটি এলএমজি পোস্ট। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার দল অনড়। ক্যাম্পে রেড করবেই। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে মোজাফ্ফর হোসেন এবং আমিনুল ইসলাম চৌধুরী পুরো দলকে চারভাগে ভাগ করেন।
 নিজেদের দল সার্বিক দায়িত্ব নেয়। এছাড়াও স্কুল ভবনের পাশে হাবিলদার আজিজের নেতৃত্বে ১৮/২০ জন অবস্থান নেন। স্কুল ভবনের সামনে শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে¡ তার দল অবস্থান নেয়। ফিরোজ ভুইয়ার দল শত্রুর টেলিফোন লাইন কেটে দেওয়ার দায়িত্ব নেয়। কিন্তু শক্রপক্ষের স্কুল ভবনের ছাদে বসানো এলএমজি পোস্ট থেকে মুহুর্মুহ গুলি বর্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা সফল হতে পারছিল না।

তখন সিদ্ধান্ত বদলে স্থানীয় কৌশল অবলম্বন করা হয়। অপর একটি গ্রুপ স্ট্যান্ডবাই ছিল ইসমাইল হোসেন হজ গ্রুপ। এই গ্রুপের সদস্য তোতা, আলতাফ, হালিম দায়িত্ব নিয়ে স্কুল ভবনের লাগোয়া বট গাছে উঠে ছাদে শক্রপক্ষের বাংকারে গ্রেনেড ছুড়ে এলএমজি পোস্ট ধ্বংস করে দেয়। এর পর শত্রুরা দুর্বল হয়ে পড়ে। মোজাফ্ফর হোসেন এবং আমিনুল ইসলাম চৌধুরী কাগজের ঠোঙ্গা দিয়ে চুংগা তৈরি করে পাকি হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। এর পর পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে।

কিন্তু শত্রু বাহিনীর একটি রুমে কয়েকজন অতর্কিতে গুলি চালায়। এ সময় আমিনুল ইসলাম চৌধুরী এবং আব্দুল মোতালেব গুলিবিদ্ধ হয়। এর মধ্যে আমিনুল চৌধুরীর অবস্থা সংকটাপন্ন। পরবর্তীতে তার শরীর থেকে গুলি বের করা হলেও চিকিৎসা ব্যাহত হওয়ায় গুলিবিদ্ধ স্থানে পচন ধরেছিল। প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী চলা এই যুদ্ধে ৩২ জন শত্রু সেনাকে হত্যা করা হয়। হানাদার ক্যাম্প থেকে ২৫টি চাইনিজ রাইফেল, ৫টি এসএমজি, একটি এলএমজি, একুশটি গ্রেনেডসহ অনেক  গোলাবারুদ সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু কোন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হননি।
মুক্তিযুদ্ধে সিরাজগঞ্জের ভাটপিয়ারীর যুদ্ধ ইতিহাসের একটি অংশ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনাসদর শিক্ষা পরিদপ্তর এই যুদ্ধকে মূল্যায়িত করেছেন। সেই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ হয়েছে বলে সেনা শিক্ষা পরিদপ্তর স্বীকৃতি দিয়েছে।

×