ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

সাত লাখে ৪৮ লাখ টাকা সুদ

অপ্রতিরোধ্য সুদ কারবারি

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল

প্রকাশিত: ১২:৫২, ৫ জুলাই ২০২২; আপডেট: ১৫:২৪, ৫ জুলাই ২০২২

অপ্রতিরোধ্য সুদ কারবারি

সুদের টাকার জন্য এক নারীকে শ্লীলতাহানি, বিষপানে আত্মহত্যাকারী কামাল ও বিমল

 থ্রি-হুইলার চালক কালাম সেরনিয়াবাত নিজেই চারটি মাহেন্দ্রা গাড়ির মালিক। আর্থিক দৈন্যতার কারণে বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নেন জেলার গৌরনদী উপজেলার বার্থী ইউনিয়নের উত্তর মাদ্রা গ্রামের মৃত হাসেম সেরনিয়াবাতের ছেলে কালাম।

প্রায় ছয়মাস পূর্বে উপজেলার লাখেরাজ কসবা গ্রামের সুদ কারবারি আহাদুল হাওলাদারের কাছ থেকে সুদে ৫০ হাজার টাকা নেন। প্রতিদিন এক হাজার টাকা করে সুদ দিয়ে ইতোমধ্যে লক্ষাধিক টাকা পরিশোধ করা হয়। কিন্তু আহাদুল সুদাসলসহ কালামের কাছে আরও ৯৫ হাজার টাকা দাবি করে। এ টাকা দিতে না পারায় সুদি মহাজন আহাদুল ও তার স্ত্রী সালমা আক্তার ছবি তাদের সহযোগীদের নিয়ে টরকী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বসে কালামকে মারধর করে জোরপূর্বক সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর আদায় করে নেয়।

অপর সুদ ব্যবসায়ী গৌরনদীর পার্শ্ববর্তী মাদারীপুরের ডাসার থানার নবগ্রাম এলাকার কালাম সরদারও প্রতিসপ্তাহে ১৬শ’ টাকা সুদে ২০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন কালাম সেরনিয়াবাতকে। সকল টাকা পরিশোধের পরেও সুদাসল মিলে আরও ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন কালাম সরদার। এ টাকার জন্য তাকে (কালাম) মারধর করে সুদি মহাজন। এমনকি সুদের টাকার জন্য কালাম সেরনিয়াবাতের মালিকাধীন চারটি মাহেন্দ্রা জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে যায় সুদি মহাজনরা। পরবর্তীতে প্রতিনিময় সুদি মহাজনদের চাঁপ সহ্য করতে না পেরে অবশেষে অতিসম্প্রতি আত্মহত্যার পথ বেঁছে নিয়েছেন কালাম সেরনিয়াবাত। এ ঘটনায় সুদি মহাজনদের বিরুদ্ধে থানায় আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা দায়ের করা হয়েছে।

এরপূর্বে একই উপজেলার উত্তর ধানডোবা গ্রামে সুদের টাকার জন্য তিন সন্তানের জনক এক দিনমজুরের পিটিয়ে মুখ বিষ ঢেলে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিহত বিমল বাছারের (৪২) স্ত্রী জানিয়েছেন, আসল পাঁচ হাজার টাকায় বিশ হাজার টাকা সুদ নেয়ার পরেও তার স্বামীর কাছে আরো পাঁচ হাজার টাকা দাবী করে গ্রাম্য সুদী মহাজন সোহেল হাওলাদার ওরফে বিচ্ছু সোহেল। তার (সোহেল) দাবীকৃত টাকা দিতে অস্বীকার করায় সুদি মহাজন তার সহযোগিদের নিয়ে বিমলকে মারধর করে মুখে বিষ ঢেলে হত্যা করে।

শুধুমাত্র কালাম ও বিমলই নয়; গ্রাম্য সুদি মহাজনদের চাঁপে পথে বসেছেন অসংখ্য মানুষ। নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অনেকে। এরপরেও সুদ ব্যবসায়ী এবং সুদি কারবারিদের লাগাম টানতে এগিয়ে আসছে না কোন মহল। এমনকি অবৈধ সুদ ব্যবসায়ীদের দায়ভার বা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না সরকারের কোন দপ্তর। যে কারণে নিয়ন্ত্রণহীন ভাবেই সুদি কারবারিরা অসহায় মানুষদের নিঃস্ব করে দিচ্ছে।

প্রশাসনের নিরবতার সুযোগে কোন কোন সময় সুদের টাকা আদায়ে গৃহবধূর শ্লীলতাহানীর ঘটনাও ঘটাচ্ছে। এমন একটি ঘটনার নজির মিলেছে গৌরনদীর বাটাজোর গ্রামে। ওই গ্রামের পান ব্যবসায়ী অজিত দাস চার লাখ টাকা নিয়ে সুদাসল মিলিয়ে ১২ লাখ টাকা পরিশোধ করেন সুদি ব্যবসায়ী উপজেলার পূর্ব লক্ষণকাঠী গ্রামের সুদি কারবারি দাদন সরদারকে। এরপরেও আরও পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেন তিনি। এ টাকা আদায়ে অজিত দাসকে ঘরে না পেয়ে তার স্ত্রীর হাত ধরে টানা হেচড়া এবং শ্লীলতাহানীর পাশাপাশি তার বৃদ্ধা মাকে মারধর করা হয়।

অপরদিকে বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচর গ্রামের কালাম বেপারী ওরফে সুদি ভাষাইর কাছ থেকে রাসেল নামের এক যুবক প্রবাসে যাওয়ার জন্য সাত লাখ টাকা সুদে নিয়েছেন। গত কয়েক বছরে সুদাসল মিলিয়ে ১৬ লাখ টাকা পরিশোধ করেন প্রবাসী রাসেল। এরপরেও সুদাসলসহ আরও ৪৮ লাখ টাকা দাবি করেন সুদ কারবারি কালাম বেপারী। উপজেলার রাহুতকাঠি বাজারের ব্যবসায়ী মোস্তফা প্যাদা বলেন, সুদিকারবারি কালাম বেপারী বাহেরচর আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সদ্যঘোষিত এডহক কমিটির সভাপতি সুজন আহমেদের বাবা।

বাবুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আমিনুল ইসলাম বলেন, সুদ ব্যবসায়ীরা যাতে কাউকে চাঁপ সৃষ্টি করতে না পারে এবং অবৈধভাবে যাতে সুদের ব্যবসা করতে না পারে সেজন্য ইউপি চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। সুদের ব্যবসাকে অবৈধ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ভূক্তভোগীরা চাইলে এ বিষয়ে থানায় নিয়মিত মামলা দায়ের করতে পারবেন।

সুদি কারবারিদের চাঁপে আত্মহত্যার ঘটনায় মামলা দায়েরের সত্যতা স্বীকার করে গৌরনদী মডেল থানার ওসি আফজাল হোসেন বলেন, আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

জেলা সমবায় কর্মকর্তা মোহাম্মদ খোরশেদ আলম বলেন, কেউ ব্যক্তিগতভাবে সুদের ব্যবসা করলে সেটা দেখভালের দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনের। কোন ভুক্তভোগী থেকে থাকলে তারা থানায় অভিযোগ করলে পুলিশ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তবে এ ধরনের সুদ ব্যবসার বৈধতা নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

 

 

 

 

 

×