ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

২৫০ লেডি বাইকার ঢাকার রাজপথ চষে বেড়াচ্ছেন

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭

২৫০ লেডি বাইকার ঢাকার রাজপথ চষে বেড়াচ্ছেন

একটা সময় ছিল যখন নারীর বাইক চালানোর বিষয়টি কেউ চিন্তা করত না। সময় পাল্টেছে। তাই নারীরা এখন বাইক চালানোকে নিজেদের স্বাধীনতা মনে করছেন। রাজধানীর কর্মজীবী নারীসহ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রীরা গণপরিবহনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু গণপরিবহগুলোতে নারীদের জন্য পর্যাপ্ত সিট বরাদ্দ না থাকায় হরহামেশাই নান ভোগান্তিসহ যৌন নির্যাতনেরও শিকার হতে হয়। এসব ভোগান্তির কারণেই গত ১ বছর আগে প্রবল মনোবল নিয়ে স্কুটি চালানো শিখে সাত দিনের মাথায় রাজপথে বের হই। এরপর থেকে স্কুটিই আমার সঙ্গী। এখন উড়ে উড়ে কর্মস্থলসহ বিভিন্ন গন্তব্যস্থলে পৌঁছায় খুবই কম সময়ে। চ্যালেঞ্জ নিয়ে এভাবেই নারীদের রাজপথে বের হওয়ার পরামর্শ দেন এক কর্মজীবী নারী নাহার পপি। তার মতে, ভয় নয় সাহসিকতার সঙ্গে নিজেকে দক্ষ প্রমাণ করাটা জরুরী। আমরা অনেকেই ভাবি মেয়েরা বাইক চালাতে গিয়ে রাস্তায় দুর্ঘটনার সম্মুখীন হবে হাত-পা ভেঙ্গে ঘরে পড়ে থাকবে। সেটা একজন পুরুষ বাইকারেরও হতে পারে। এসব কুসংস্কারকে পায়ে ঠেলতে হবে তবেই নারী তুমি স্বাধীন।’ শুধু পপি নয় তার মতো অনেক নারী যাতায়াতে ভোগান্তি থেকে বাঁচতে রাজপথে বাইক নিয়ে বের হচ্ছেন। তারা কুসংস্কার, নিষেধাজ্ঞা, কটূক্তি ও প্রতিবন্ধকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে নিজেদের দক্ষতার চিত্র তুলে ধরছেন এভাবেই। প্রতিবেশী ভারতের বিভিন্ন শহরের রাস্তায় এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রচুর তরুণীকে মোটরসাইকেল বা স্কুটার কিংবা বাইক নিয়ে চলাচল করতে দেখা গেলেও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে এটি তেমন নিয়মিত কোন দৃশ্য নয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পপির মতো অনেক নারী স্কুটি নিয়ে চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ওম্যান রাইডার্স ক্লাব (বিডব্লিইআরসি)-এর তথ্যমতে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লেডি বাইকারের সংখ্যা দুই হাজারেরও বেশি। যার ৮০ শতাংশ কর্মজীবী নারী। এ সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। এমনকি এই স্কুটি চালকেরা নানারকম ক্লাবও গড়ে তুলছেন। এগুলোরই একটি বাংলাদেশ ওম্যান রাইডার্স ক্লাব (বিডব্লিইআরসি)। ক্লাবটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইশরাত খান মজলিশ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘২০১৩ সালে আমি নিজ উদ্যোগে এই ক্লাবটি শুরু করি। এ ছাদের নিচে সব লেডি বাইকারদের নিয়ে আসার প্রয়াস এটি। যেন যে কোন লেডি বাইকারের বিপদে আমরা অন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা একে অন্যের আমার এই ক্লাবের প্রায় ২৫০ লেডি বাইকার ঢাকার রাজপথ চষে বেড়াচ্ছেন। ঢাকার বাইরেও আছেন প্রায় শতাধিক। তাদের দেখাদেখি এখন অনেক নারীরা বাইক চালানো শিখছেন। আমাদের কাছ থেকেও অনেক নারীরা ট্রেনিং নিচ্ছেন। সমাজের দিক থেকেও এখন মানসিকতা অনেক পাল্টে যাচ্ছে। আমাদের ক্লাবে অনেক সদস্যরা আছে যাদের স্বামী তাদের স্কুটি কিনে দিয়েছেন, রাস্তাঘাটে যানজট এবং যানবাহন পাওয়ার দুর্ভোগ থেকে বাঁচতে।’ নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ইসরাত বলেন, ‘আমি বিগত সাতবছর ধরে বাইক চালাচ্ছি। প্রথম দিকে, অনেকের বাজে মন্তব্য শুনেছি, রাস্তায় অনেকবার পড়েও গিয়েছি। তারপরও বন্ধ করিনি। পরিবারের উৎসাহে বারবার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি। রাজধানীতে নারীরা প্রতিদিনের চলাফেরায় যানজটসহ গণপরিবহনে বিভিন্ন ঝামেলায় পড়েন। তাদের জন্য একটাই উপদেশ- সাহস করে বাইক চালানো শেখ, দেখবে সবকিছুই কেমন সহজ হয়ে যাবে! এনআরবি ব্যাংকে কর্মরত আলিয়া বেগম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বিগত দুই বছর ধরে আমি বাইক চালাচ্ছি। ছোটবেলা থেকেই বাইক চালানোর ইচ্ছে ছিল। তা আরও প্রবল হলো রাজধানীর পরিবহন সঙ্কটসহ নানা ভোগান্তির কারণে। ঢাকায় কর্মজীবী নারীরা যাতায়াতে বেশি সময় ব্যয় করেন। আমার বাসা মগবাজারে আর অফিস আগারগাঁও এটুকু দূরত্বে আসা-যাওয়া করতে সিএনজি অথবা বাসে লাগে তিন ঘণ্টা। অথচ এখন আমি বাইকে মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিটেই কর্মস্থলে পৌঁছাতে পারি। এমনকি আমার পরিচিতদের মাঝে মাঝে লিফট দেয়। সত্যিই বাইক চালাতে পেরে আমার জীবন আরও সহজ হয়ে গেছে। অন্যদিকে আমার পরিচিত অনেককেই বাইক চালানোর পরামর্শ দেয়। নিত্যদিনের যাতায়াত ভোগান্তি পোহানোর চেয়ে স্বাধীনচেতাভাবে চলাফেরার অধিকার পুরুষের মত নারীরও রয়েছে।’ রাজপথে একজন লেডি বাইকারের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরে এই নারী বলেন, ‘আমাদের সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিকাশ এখনও ঘটেনি। কারণ রাস্তায় অনেক সময় লেডি বাইকারদেরকে আজেবাজে কথা বলে কটূক্তি করা হয়। এছাড়া বাস ড্রাইভারসহ পুরুষ বাইকাররাও প্রতিযোগিতা করার চেষ্টা করে। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে যে ট্রাফিক সার্জেন্টরা লেডি বাইকারদের অনেক সাহায্য করে। কখনও অভিযোগ করলে তারা বিষয়টি আমলে নেয়।’ আলিয়া আরও বলেন, ‘একজন নারীর বাইক চালানো শেখা থেকে শুরু করে বাইক কেনা পর্যন্ত পরিবারের সম্মতি পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। অনেক নারী আছেন যারা শিখেছেন চালানো কিন্তু অর্থের অভাবে বাইক কিনতে পারেন না। এজন্য যদি সরকারী অথবা বেসরকারী উদ্যোগে নারীদের কিস্তিতে ও কম খরচে বাইক কেনার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে অনেক নারীর ক্ষেত্রেই রাজপথে বের হওয়াটা সহজ হত।’ শুধু কর্মজীবী নারীরা নয় বরং ছাত্রীরাও আজকাল শখে কিংবা প্রয়োজনে স্কুটি কিনছেন। সাদিয়া আফরিন একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। যানজট এড়িয়ে সময়মত ক্লাসে পৌঁছানো তার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে গিয়েছিল। একবার তো বাস থেকে নামতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গে যায়। এরপর তিনি অত্যন্ত সাহস নিয়ে বাইক চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়ে রাজপথে নামেন। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, ‘গণপরিবহনে নারীরা নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হন। এছাড়া বাসের ড্রাইভার, কালেক্টররা খুবই আজেবাজে কথা বলে নারীকে অপমান করে-বাসে লেডিস তোলা যাবে না, না আপা সিট নাই, আপনাদের নামাতে গেলে সময় নষ্ট হয় ইত্যাদি। এরপর পরিবারকে বুঝিয়ে আমি স্কুটি কিনে প্রশিক্ষণ নিলাম। গত এক বছর ধরে আমি নিয়মিত স্কুটি চালাচ্ছি। এখনও কোন দুর্ঘটনার সম্মূখীন হয়নি। এ দেশের মেয়েরা এখন ট্রেন, জাহাজ থেকে শুরু করে বিমানও চালাচ্ছেন। কিন্তু বাইক চালাতে গিয়ে দেখছি রাস্তার মানুষগুলো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। শুরুতে এসব নিয়ে বিব্রত হয়েছি, এখন আর বিব্রতবোধ করি না। সাদিয়ার মা রাবেয়া জাহান জনকণ্ঠকে জানালেন, ‘প্রথমে সে যখন স্কুটি কেনার জন্য আবদার করল, তখন বিষয়টিকে উপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু প্রতিদিনের যাতায়াতে নানা ভোগান্তির কারণে তাকে স্কুটি কিনে দিলাম। সে যখন বাইরে বের হয় আমি খুব ভীত থাকি, কখন কি হয়! সত্যিই বলতে কি, এখন সে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছে। আগে বাসে যাওয়া আসা করত। ক্লাস শুরু হওয়ার দুই ঘণ্টা আগে বের হত সময়মত ক্লাসে পৌঁছানোর জন্য। এখন সে মাত্র ১৫-২০ মিনিটেই সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতে পারে।’ তবে বাইকে সুবিধা যেমন হচ্ছে তেমনি অসুবিধাও রয়েছে বলে জানালেন রাজধানীর বিজয় স্মরণী সিগনালের ট্রাফিক সার্জেন্ট রইসুল ইসলাম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘পুরুষদের পাশাপাশি বর্তমানে অনেক নারীরা দুই চাকার মোটরযান চালাচ্ছেন। আমরা তাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে এগিয়ে যাই। তবে পুরুষ কিংবা নারী সবাইকে বাইক চালানোর ক্ষেত্রে আরও সতর্ক ও সচেতনতার সঙ্গে বাইক চালানো উচিত। তারা প্রায়ই দ্রুত যাওয়ার জন্য সিগন্যাল অমান্য করেন। এমনকি ফুটপাথ দিয়েও বাইক চালিয়ে যান। এসব থেকে তাদের বিরত থাকা উচিত। সেইসঙ্গে ভাল করে বাইক চালানো শিখে, লাইসেন্স নিয়ে তবেই বাইক চালাতে হবে। অবশ্যই ট্রাফিক আইন মেনে চালাতে হবে। তাতে সবাই উপকৃত হবে বলে জানান তিনি। রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গত বছর ২২ লেডি পুলিশ সার্জেন্ট স্কুটি নিয়ে রাজপথে নেমেছেন। তাদেরই একজন সার্জেন্ট রাবেয়া আক্তার। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, ‘আমি যখন স্কুটি পেয়েছি তখন আনন্দের সীমা ছিল না। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই স্কুটি চালাতে হয়। নিজেকে স্বাধীন মনে হয়। বর্তমানে দেশের নারীরা স্কুটি চালাচ্ছেন। এখন আর কেউ তাদের বাবা, স্বামী কিংবা ভাইয়ের পিছনে বাইকে বসে যাতায়াত করার ওপর নির্ভরশীল নয়।’ ‘রাস্তায় অনেক নারীরা আমাদের কাছে এসে তাদের সমস্যার কথা বলেন। কেই কোন বিপদে পড়লে আমরা ততক্ষণাৎ তা সমাধানের ব্যবস্থা করি। অনেক পুরুষ বাইকাররা নারী বাইকারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেন অথবা পাশাপাশি যাওয়ার সময় বাজে কথা বলেন এমনকি বাসের ড্রাইভাররা মাঝে মধ্যে নারী বাইকারের পথ রোধ করে ইত্যাদি বিষয়গুলো আমরা পর্যবেক্ষণে রাখি। সেইসঙ্গে নারী বাইকারদের ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ গাড়ির কাগজপত্র ঠিক আছে কি-না এসবও খেয়াল রাখতে হয় আমাদের।’ বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটির (বিআরটিএ) তথ্যমতে, ‘বাংলাদেশে ৩ হাজার ৬৪৬ নারীর ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে লাইসেন্সপ্রাপ্তদের সংখ্যা ১ হাজার ৬৮০।’ বর্তমানে দেশের বাজারে হিরো হোন্ডা, টিভিএস, ইয়ামাহা, মাহেন্দ্র, সুজুকিসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের স্কুটি পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে কথা হয় নিলয় মোটরস লিমিটেডের বিপণন নির্বাহী আবু বকরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নারীরা বাইক হিসেবে স্কুটি বেশি পছন্দ করছেন। বিভিন্ন নির্মাতার অনেক মডেলের স্কুটি রয়েছে। যেমন প্লেজার, উই গো, স্কুটি পেপ, স্কুটি টিনজ, ভেসপা, স্ট্রিক ইত্যাদি।’ তিনি জানান, বর্তমানে অনেক নারীরা স্কুটি কিনছেন। গড়ে দশটি বাইকের মধ্যে চারটি কিনছেন নারীরা। তাদের উপযোগী অধিকাংশ মোটরবাইকেরই ডিজাইন প্রায় কাছাকাছি ধরনের হয়ে থাকে। তবে গতানুগতিক ধারায় রঙের দিক দিয়ে পরিবর্তনটা বেশি চোখে পড়ছে। শুধু ধরাবাঁধা লাল, হলুদ কিংবা গোলাপিই নয়, অন্য রংও দেখা যাচ্ছে স্কুটিতে। কালোর সঙ্গে বেগুনী অথবা গোলাপীর মিশ্রণও ঘটছে। এখন চালকের সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনায় রেখেই তৈরি করা হয় স্কুটি। আবু বকর বলেন, ‘এসব বাইকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ১২০ সিসির ইঞ্জিন থাকে। ফলে এগুলো ওজনে বেশি ভারী হয় না। তাই বাইকটি সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। একইসঙ্গে এতে রয়েছে টিউবলেস টায়ার। যার ফলে চাকা লিক হলেও আরও প্রায় ১০ কিলোমিটার চলা যায়।’ জানা গেছে, বর্তমানে দেশে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের স্কুটি বাজারজাত করা হচ্ছে। আর দরদামটাও নির্ভর করছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ওপর। প্লেসারের ২টি নির্দিষ্ট মডেল রয়েছে। মডেল দুটির দাম পড়বে ১ লাখ ২৯ হাজার ৯৯০ এবং ১ লাখ ৩৪ হাজার ৯৯০ টাকা। এছাড়া টিভিএস, সুজুকি, মাহেন্দ্র ব্র্যান্ডের স্কুটি পাওয়া যাবে ৯০ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকার মধ্যে।
×