ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিল্পীদের দুর্দিন

যাত্রা-নাটকের বাজার মন্দা

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

যাত্রা-নাটকের বাজার মন্দা

বিশ্বখ্যাত মহুয়া-মলুয়ার কাহিনী বিজড়িত নেত্রকোনায় এক সময় যাত্রাশিল্পের ব্যাপক কদর ছিল। বিশ শতকের শুরু থেকে আশির দশক পর্যন্ত যাত্রাশিল্প চরম উৎকর্ষ লাভ করে। গড়ে উঠেছিল বেশকিছু পেশাদার যাত্রাদল। উল্লেখযোগ্য যাত্রাদলের মধ্যে ছিল মোহনগঞ্জের নিউ গণেশ অপেরা, নবযুগ অপেরা, নেত্রকোনা সদরের কৃষ্ণাকলি অপেরা, মহুয়া নাট্য সংস্থা, লক্ষ্মীপুর যাত্রা ইউনিট, শ্যামগঞ্জের সবুজ অপেরা, কলমাকান্দার পলাশ অপেরা, রংছতির রিপন যাত্রা ইউনিট, বারহাট্টার রকি অপেরা ও বন্ধন অপেরা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় সারা বছর যাত্রাপালা করে বেড়িয়েছে এসব দল। এছাড়াও জেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই ছিল এ্যামেচার (শৌখিন) যাত্রা দল। এমন কোন গ্রাম নেইÑ যেখানে বছরে অন্তত দু-একটি যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হয়নি। এখানকার ডাকসাইটে যাত্রাভিনেতা আশ্রব আলী, যাত্রা সম্রাট নয়ন মিয়া, মুখলেছ উদ্দিন, খমির উদ্দিন, হরেন সরকার, রমেশ আদিত্য, শরীফ এ মুখলেছ, পঞ্চানন বিশ্বাস, হরিপদ সরকার, অমূল্য শর্মা, আব্দুর রহিম, মোসলেম উদ্দিন, আব্দুর রব, আফাজ উদ্দিন, আব্দুল হাই প্রমুখের নাম এখনও মানুষের মুখে মুখে। বিবেক চরিত্রের গান ও অভিনয়ের জন্য গৌরাঙ্গ আদিত্যের নাম এখনও সারাদেশে ছড়িয়ে আছে। এছাড়া বিবেকের অভিনয় করে খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন অশ্বিনী সরকার, মদন সরকার, গোপাল দত্ত প্রমুখ। স্বাধীনতার আগে পর্যন্তও এ অঞ্চলের যাত্রা গানে নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন পুরুষ শিল্পীরা। স্বাধীনতার পর নারী শিল্পীদের আগমনে যাত্রাশিল্প আরও জনপ্রিয় এবং প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এ সময় যাত্রাশিল্পের বাণিজ্যিক প্রসারের কারণে নেত্রকোনা শহরের সাতপাই রেলক্রসিং এলাকায় গড়ে ওঠে যাত্রাপল্লী। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নারী শিল্পীরা এখানে এসে বসতি গড়ে তোলে। এছাড়া যাত্রাশিল্পকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে ওঠে ‘সাজঘর’। আগের মতো বাণিজ্যিক প্রসার না থাকায় কৃষ্ণা ড্রেস হাউস, দ্বীনা ড্রেস হাউস, একতা ড্রেস হাউস, বিউটি ড্রেস হাউস, শিল্পী সাজঘর, পলাশ পোশাকঘর, লাকি সাজঘরসহ বেশ কয়টি সাজঘর এখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই করছে। যারা যাত্রার আয়োজন করেÑ তারা এসব সাজঘর থেকে টাকার বিনিময়ে নারী শিল্পী, বাদ্যযন্ত্রী, বাদ্যযন্ত্র, মেকাপ ম্যান, পোশাক প্রভৃতি ভাড়া করে। বলাবাহুল্য, যাত্রার ঐতিহ্য আজ আর নেই। নানা বাস্তবতায় শিল্পটি দিন দিনই তার ঐতিহ্য হারাচ্ছে। যাত্রার মঞ্চ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে দর্শক। গ্রামগঞ্জে এখন খুব কমই যাত্রার আয়োজন দেখা যায়। এর কারণ ব্যখ্যা করে স্থানীয় পেশাদার যাত্রাশিল্পী দ্বীন ইসলাম বলেন, রমরমা বাণিজ্যের কারণে যাত্রাশিল্পে এক সময় অপ-সংস্কৃতির ‘আছর’ পড়ে। বিশেষ করে আশি ও নব্বইয়ের দশকে এক শ্রেণীর প্রভাবশালী রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় যাত্রার সঙ্গে জুয়া, হাউজি ও অশ্লীল নৃত্যসহ নানা অপসংস্কৃতিকে যুক্ত করে। তখন থেকেই সুস্থ সমাজ যাত্রার আসর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। এছাড়াও আইনী বাধ্যবাধকতা, নিষেধাজ্ঞা, প্রশাসনিক বেড়াজাল ও মৌলবাদীদের রক্তচক্ষুর কারণে শিল্পটি আজ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন। এ কারণে অনেকে পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। নেত্রকোনার প্রখ্যাত নারী শিল্পী কৃষ্ণা চক্রবর্তী, বেবী, আঞ্জুসহ আরও কয়েকজন জানান, যাত্রাপালার সঙ্গে মূলত জুয়া, হাউজি ও অশ্লীল নৃত্যের সম্পর্ক নেই। আয়োজকরা ব্যবসায়িক দিক বিবেচনা করে যাত্রার সঙ্গে এসব অপসংস্কৃতি যুক্ত করে। আর যখনই জুয়া-হাউজি বন্ধের কথা ওঠে, তখন এসবের সঙ্গে যাত্রা প্রদর্শনীও বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে যাত্রা অপসাংস্কৃতিক কর্মকা- বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু জুয়া-হাউজি বন্ধ হলে কেউ না খেয়ে মরে না। পক্ষান্তরে যাত্রা বন্ধ হলে হাজার হাজার শিল্পী-কলাকুশলী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সব অসামাজিক কর্মকা- বন্ধ করে যাত্রাশিল্পের বিকাশে সদূরপ্রসারী উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান শিল্পীরা। Ñসঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা থেকে
×