ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

ক্রিকেট উন্মাদনার দেশে বিশ্বকাপের দামামা

শাকিল আহমেদ মিরাজ   

প্রকাশিত: ০০:৪৬, ৪ অক্টোবর ২০২৩; আপডেট: ১১:৫১, ৪ অক্টোবর ২০২৩

ক্রিকেট উন্মাদনার দেশে বিশ্বকাপের দামামা

ক্রিকেটের জন্ম ইংল্যান্ডে হলেও ক্রিকেটে উন্মাদনা ভারত

ক্রিকেটের জন্ম ইংল্যান্ডে হলেও হালের ক্রিকেটে উন্মাদনার এক জাতিতে পরিণত হয়েছে ভারত। বিশ্বজুড়ে সম্প্রচার কোম্পানিগুলোর মালিকানা, দর্শকে ঠাসা গ্যালারি, ক্রিকেটীয় বাণিজ্যের বড় নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে দেশটি। অন্যরা যেখানে খেলোয়াড়দের ন্যূনতম সুবিধা দিতে গিয়ে হিমশিম, সেখানে এক আইপিএল থেকেই ঢের আয় ইন্ডিয়ার। অর্থ-প্রতিপত্তি, প্রশাসনিক ক্ষমতা, মোড়লিপনা সব বিচারেই বিশ্ব ক্রিকেটে আজ ভারতের দাপট। মাঠের ক্রিকেটেও নয় কী! সম্প্রতি রেকর্ড অষ্টম এশিয়া কাপ জয় করা দলটি তিন ফরম্যাটেই উঠে এসেছে এক নম্বরে। ২০১৫ ও ২০১৯, গত দুই আসরে কেবল বিশ্বকাপটাই পুনরুদ্ধার করতে পারেনি।

২০১১ সালে মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পড়া ভারত ফের ওয়ানডে বিশ্বকাপের আয়োজক। কিংবদন্তি মাহী সেবার ২৮ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়েছিলেন। সেই ঘরের মাঠেই এবার ১২ বছরের অপেক্ষার অবসানে রোহিত শর্মার দিকে তাঁকিয়ে শতকোটি ভারতবাসী। আহমেদাবাদে বৃহস্পতিবার ‘ডিফেন্ডিং’ চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড ও ফাইনালিস্ট নিউজিল্যান্ডের ম্যাচ দিয়ে শুরু শ্রেষ্ঠত্বের আসর। চেন্নাইয়ে রবিবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে শুরু হবে ভারতের মিশন।
দশ দলের ওয়ানডে বিশ্বকাপে অপর ছয় দেশ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, আফগানিস্তান এবং বাছাই পেরিয়ে আসা শ্রীলঙ্কা ও নেদারল্যান্ডস। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য প্রথম দুই আসরের চ্যাম্পিয়ন, এক সময়ের পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। বাদ পড়েছে বাছাই থেকে। জিম্বাবুইয়েও তাই।  গ্রুপ নয়, এবারের বিশ্বকাপ হচ্ছে রাউন্ড-রবিন লিগ পদ্ধতিতে। যেখানে  প্রতিটি দল প্রতিটি দলের মুখোমুখি হবে। অর্থাৎ লিগ পর্বে প্রতিটি দল নয়টি করে ম্যাচ খেলবে। সেখান থেকে পয়েন্টের ভিত্তিতে সেরা চারটি দল উঠবে সেমিফাইনালে (নক-আউট)। ১০ দল, ১০ ভেন্যু।

আহমেদাবাদ, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, দিল্লি, ধর্মশালা, হায়দরাবাদ, কলকাতা, লক্ষ্ণৌ, মুম্বাই ও পুনেতে হবে ম্যাচগুলো। ৪৬ দিনব্যাপী আয়োজনে মোট ম্যাচ ৪৮টি। খেলাগুলো হবে ভারতের ভিন্ন দশ শহরের ভিন্ন দশ স্টেডিয়ামে।  আহমেদাবাদে বিশ্বের সর্বাধিক দর্শক ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী ম্যাচ, এখানেই ফাইনাল আগামী ১৯ নভেম্বর। ভারত গ্রুপপর্বের ৯টি ম্যাচ খেলবে ৯টি ভিন্ন ভিন্ন ভেন্যুতে। সেখানে পাকিস্তান তাদের ম্যাচগুলো খেলবে মাত্র পাঁচটি ভেন্যুতে। বড় কারণ নিরাপত্তা। ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপে চিরশত্রু পাকিদের নিরাপত্তা নিয়ে কম কথা হয়নি। যদিও আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সব দলের জন্যেই থাকবে সমান নিরাপত্তা। সর্বোচ্চ আলোচনায় ১৪ অক্টোবরের ‘ডেড-ম্যাচ’। সেদিন আহমেদাবাদে বিশ্বের সর্বাধিক ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন নরেন্দ্র স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হবে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তান।
শক্তিমত্তা ও বাস্তবতার বিচারে ঘরের মাঠে এবারের বিশ্বকাপের হট-ফেভারিট অবশ্যই ভারত। ২০১১ সালের পর আর শিরোপা জেতা হয়নি। তবে ২০১৫ ও ২০১৯ বিশ্বকাপে বিদায়ের আগে পর্যন্ত রোহিত-কোহলিরা ফেভারিটের মতোই খেলেছে। সদ্য এশিয়া কাপ জিতে উঠে এসেছে ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে। দক্ষিণ আফ্রিকার পর ইতিহাসের মাত্র দ্বিতীয় দল হিসেবে তিন ফরম্যাটেই এখন এক নম্বরে তারা। শুবমান গিল, লোকেশ রাহুল, সূর্যকুমার যাদব, শ্রেয়াস আইয়ারদের নিয়ে দারুণ ব্যাটিং লাইনআপ। পেস আক্রমণে জাসপ্রিত বুমরাহ, মোহাম্মদ শামি, মোহাম্মদ সিরাজ।

স্পিনে রবীন্দ্র জাদেজা, রবিচন্দ্রন আশ্বিন দুজনই তুখোড় অলরাউন্ডার। আছেন পেস-অলরাউন্ডার শার্দুল ঠাকুর। তবে খেলাটা যখন উপমহাদেশে তখন পাকিস্তানও থাকবে শিরোপার রেসে। সৌরভ গাঙ্গুলী থেকে কেভিন পিটারসেন, রিকি পন্টিং থেকে নাসের হুসেইন, প্রত্যেকের মুখে ঘুরে ফিরে যে চারটি নাম উঠে আসছে তার একটি ভারত, আরেকটি পাকিস্তান। বিশ্বকাপ ইতিহাসের সফলতম দল অস্ট্রেলিয়া সব সময়েই ফেভারিট। ‘ডিফেন্ডিং’ চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে হিসাবের বাইরে রাখার মতো বোকামি নিশ্চয়ই কেউ করবেন না। গতবার (২০১৯) ঘরের মাঠে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয় করে ইংলিশরা।

ইয়ন মরগানের নেতৃত্বে যে সাফল্যের রূপকার বেন স্টোকস আচমকাই ওয়ানডে থেকে অবসর নিয়েছিলেন। তবে অধিনায়ক ও  ম্যানেজমেন্টের অনুরোধে ফিরে এসেছেন তুখোড় এ অলরাউন্ডার। যদিও চোটের কারণে বোলিং করতে পারবেন না। খেলবেন কেবল ব্যাটসম্যান হিসেবে। অধিনায়ক জস বাটলারের হাতে আছেন জনি বেয়ারস্টো, মঈন আলি, স্যাম কুরান, ডেভিড মালান, আদিল রশিদ, মার্ক উড, ক্রিস ওকসের মতো পারফর্মার। 

অস্ট্রেলিয়া এবার খেলছে প্যাট কামিন্সের নেতৃত্বে; যা দেশটির ক্রিকেটে একটি বিরল ব্যাপার। কারণ তার আগে কোনো পেসার দলটির দায়িত্ব পাননি। পেস আক্রমণে তিনি পাচ্ছেন জস হ্যাজেলউড, মিচেল স্টার্ক, মার্কাস স্টয়নিসদের। ব্যাটিংয়ে অভিজ্ঞ ডেভিড ওয়ার্নার, স্টিভেন স্মিথের সঙ্গী অ্যালেক্স ক্যারি, ট্রাভিস হেড ও মার্নাস লাবুশেন। স্পিনে অ্যাডাম জাম্পা ও অলরাউন্ডার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। বিশ্বকাপের চির চোকার দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা। ব্যাটিংয়ে অন্যতম ভরসা কুইন্টন ডি কক, এইডেন মার্করাম, হেনরিক ক্লাসেন, ডেভিড মিলার, কাগিসো রাবাদা, লুঙ্গি এনগিদি, কেশভ মহারাজ, তাবারেজ শামসিদের নিয়ে প্রোটিয়া দলটাও আশা জাগানো।

শ্রীলঙ্কাকে নিয়েও বলতে হবে। দাসুন শানাকার নেতৃত্বে গত (২০২২) টি২০ এশিয়া কাপে তরুণ একটা দল বাজিমাত করে। ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়ে শিরোপা জেতে তারা। ঘরের মাঠে এবারও (ওয়ানডে ফরম্যাট) খেলে ফাইনালে। আছেন কুশল মেন্ডিস, পাথু নিশাঙ্কার মতো ব্যাটার। বোলিংয়ে মাহিশ থিকসানা, মাথিশা পাথিরানা, তরুণ দুনিত ভেল্লালাগে।
শেষ মুহূর্তে ভিন্ন কারণে আলোচনায় বাংলাদেশ। প্রকাশ্যে আসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের দ্বন্দ্ব। তামিমকে ছাড়াই ঘোষণা করা হয় চূড়ান্ত স্কোয়াড। যা দলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেই অনেকে মনে করছেন। কিন্তু দলটা যেহেতু বাংলাদেশ, তাই কী হবে, বলা মুশকিল! তাসকিন আহমেদ, মুস্তাফিজুর রহমান, হাসান মাহমুদ, শরিফুল ইসলামদের নিয়ে পেস আক্রমণ দুর্দান্ত। স্পিনে সুপার অলরাউন্ডার সাকিবের সঙ্গী তুখোড় মেহেদী হাসান মিরাজ। ব্যাটিংয়ে চোখ থাকবে ইনফর্ম নাজমুল হোসেন শান্ত ও তৌহিদ হৃদয়ের ওপর। ১৯৭৫, ১৯৭৯, ১৯৮৩ তিন বিশ্বকাপের আয়োজক ইংল্যান্ড। প্রথম দুই আসরের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৯৮৩Ñএ ভারত। ১৯৮৭ সালে ভারত-পাকিস্তানের আয়োজনে চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। 
১৯৯২ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড আসরের চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান। ১৯৯৬Ñএ আয়োজক ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা, চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কা। 
১৯৯৯ সালের চার আয়োজক ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস। শিরোপা যায় অস্ট্রেলিয়ার ঘরে। ২০০৩Ñএ দ. আফ্রিকা, জিম্বাবুইয়ে ও কেনিয়া থেকেও চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফেরে অসিরা। ২০০৭ সালে উইন্ডিজ আসরে শিরোপার হ্যাটট্রিক করে অস্ট্রেলিয়া। ২০১১ সালে ঘরের মাঠে চ্যাম্পিয়ন ভারত, সহ-আয়োজক ছিল বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। ২০১৫ আসরে নিজেদের মাটিতে শিরোপা পুনরুদ্ধার করে অস্ট্রেলিয়া, সহ-আয়োজক নিউজিল্যান্ড। আর সর্বশেষ ২০১৯ সালে ঘরের মাঠে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবার বিশ্বকাপের স্বাদ পায় ইংলিশরা।

×