ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সেই হাতুরুতেই আস্থা বিসিবির!

শাকিল আহমেদ মিরাজ

প্রকাশিত: ০০:১৪, ২৫ জানুয়ারি ২০২৩

সেই হাতুরুতেই আস্থা বিসিবির!

চন্দ্রিকা হাতুরু সিংহে

বাংলাদেশের ক্রিকেটে জোর আলোচনা, আবার কোচ হয়ে ফিরছেন চন্দ্রিকা হাতুরু সিংহে। খালেদ মাহমুদ সুজন বলেছেন, ‘হাতুরুর ব্যাপারটা আমি নিশ্চিত বলতে পারব না। তবে যদি আসে, অবশ্যই ভালো। এখন হয়ত ও আরও বেশি পরিণত, আসলে ভালোই হবে।’ দেশের ক্রিকেটে অন্যতম প্রভাবশীল ব্যক্তি সুজন বর্তমানে টিম ডিরেক্টর। সুতরাং তার বক্তব্যের ইঙ্গিত থেকেই অনুমান করা যায় হাতুরু ফিরলে কেমন হবে! সন্দেহ নেই, তার আগের কোচিং অধ্যায় ছিল সাফল্যে মোড়ানো।

কিন্তু বিদায়টা সুখকর ছিল না। স্বভাবে অন্তর্মুখী ও চরম একরোখা। সিনিয়রদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে মেয়াদ শেষের আগেই চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। খেলোয়াড়দের কাছে তিনি ছিলেন কড়া হেড মাস্টার। সবকিছু করতেন নিজের মতো। নির্বাচক, কোচিং স্টাফ, এমন কি ক্রিকেট প্রশাসনের কাউকেও তেমন পাত্তা দিতেন না। সুসম্পর্ক ছিল কেবল বিসিবি বস্ নাজমুল হাসানের সঙ্গে। সুজন নিজেও ভালো করেই বুঝতে পারছেন হাতুরুর মতো এমন একজনের মাথার ওপরু‘ডিরেক্টর গিরি’ ফলানোটা সহজ হবে না! কাজ করতে হলে তার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই করতে হবে। তাই হয়ত এমন আগাম সম্ভাষণ!  
ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাতুরু সিংহের ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব ছিল নিয়মিত ঘটনা। মুমিনুল হককে প্রথমে ওয়ানডে এবং পরে  টেস্ট থেকেও নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সাকিব আল হাসানের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সংঘাত ছিল নিয়মিত ঘটনা! নির্বাচক কমিটির সদস্য, এমনকি অনেক সময় বোর্ড কর্মকর্তাদেরও তাঁর আচরণে মনঃক্ষুণœ হতে দেখা গেছে। দলের সঙ্গে হাতুরু সিংহের মন জুগিয়ে চলাটাও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিসিবির জন্য। বিসিবির সঙ্গে হাতুরু সিংহের চুক্তি ছিল ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত।

কিন্তু ২০১৭ সালের অক্টোবরেই তিনি জানিয়ে দেন, বাংলাদেশ দলের কোচ আর থাকবেন না। একদিকে শ্রীলঙ্কার কোচ হওয়ার প্রস্তাব, অন্যদিকে  বেতন বাড়ানোর দাবিতে বিসিবির নির্লিপ্ততাÑসব মিলিয়ে হুট করে কোচের চাকরি ছেড়ে দেন হাতুরু। ৫৪ বছর বয়সী শ্রীলঙ্কান কোচ ছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে আলোচিত-সমালোচিত এক ব্যক্তি। তাঁর ক্রিকেট প্রজ্ঞা নিয়ে কখনোই সন্দেহ ছিল না। তবে দল নিয়ে অতিরিক্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা কিংবা হস্তক্ষেপ বরাবরই দিয়েছে আলোচনার  খোরাক।

২০১৪ সালে বাংলাদেশ জাতীয় দলের দায়িত্ব যখন  নেন, দেশের ক্রিকেটের অবস্থা বেশ নাজুক। তাঁর প্রথম দুই অ্যাসাইনমেন্ট ভারত সিরিজ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে দলও হয় ব্যর্থ। তবে নিজেদের মাঠে জিম্বাবুইয়ে সিরিজ দিয়ে বদলে যাওয়ার শুরু। ২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে কিংবা ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে খেলা। হাথুরু সিংহের অধীনে শুধু দ্বিপাক্ষিক সিরিজেই না বৈশ্বিক ইভেন্টগুলোতে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ছিল ঈর্ষণীয়।

বরাবরই যার কৃতিত্বের একটা বড় অংশ পেয়েছেন হাতুরু। কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠে, এই লঙ্কানকে নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। বিশ্বকাপের পর, দেশের মাটিতে টানা তিন সিরিজে সফলতার পরেই বেড়ে যায় তার কর্তৃত্ব।
দল নির্বাচনসহ দলের নানা বিষয়ে হস্তক্ষেপ শুরু করেন। তার সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণেই প্রধান নির্বাচক পদ থেকে সরে দাঁড়ান ফারুক আহমেদ। ক্রিকেট অপারেশন্স  চেয়ারম্যান পদেও  বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেননি নাঈমুর রহমান দুর্জয়। জাতীয় দলের অ্যাসাইনমেন্ট না থাকলে, বাংলাদেশে থাকতেন না তিনি। শুধু বোর্ড কর্তা কিংবা নির্বাচকই না, ক্রিকেটারদের সঙ্গেও তার সম্পর্কটা মধুর ছিল না।

কোচের নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্রিকেটাররা বোর্ড সভাপতির দ্বারস্থ হয়েছেন বেশ ক’বার। কিন্তু তাতেও কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। চান্দ্রিকা চলেছেন নিজের মতোই। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গেও তার মতবিরোধের কথা আসে গণমাধ্যমে।
দায়িত্বকালে একাধিকবার সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন হাতুরু। বিদায়টাও সুখকর হয়নি। চুক্তির মেয়াদ পূরণ হবার আগেই দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সিরিজ চলাকালীনই তৎকালীন অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে তাঁর কোন্দল ছিল প্রকাশ্য। এরপরেই সেই সিরিজের রিপোর্ট বোর্ডকে জমা না দিয়েই পদত্যাগ করেন তিনি। এরপর নিজ দেশ শ্রীলংকার দায়িত্ব নিলেও চুক্তির অর্ধেক মেয়াদও শেষ করতে পারেননি তিনি। বিভিন্ন বিতর্কের জের ধরে তাকে বরখাস্ত করে লংকান ক্রিকেট  বোর্ড।

আর সেই হাথুরু সিংহকেই কোচ হিসেবে পেতে এবার উঠে পড়ে লেগেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। হাতুরু কোচ হয়ে আসা এখন অনেকটাই নিশ্চিত বলেই জানাচ্ছে বিভিন্ন সূত্র। যদিও শ্রীলঙ্কার দায়িত্ব থেকে পদচ্যুত হওয়ার পর শীর্ষ পর্যায়ে আর কোচিং করাচ্ছেন না তিনি। বোর্ড কর্তাদের সঙ্গে আগের মেয়াদে সম্পর্ক খুব একটা মধুর ছিল না হাতুরু সিংহের। দলে একক কতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী হাথুরাসিংহে কোচ হয়ে এলে বর্তমান দলের টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজনের ভূমিকা কি হবে এসব এখনো পরিষ্কার না। সুজন নিজে অবশ্য জানিয়েছেন, এ নিয়ে তেমন কোনো ভাবনা নেই তার। দেশের স্বার্থই আগে। অন্যদিকে, টি২০ ফরম্যাটের জন্য বিসিবির পছন্দ শ্রীধরন শ্রীরামকে কিভাবে কাজে লাগাবে বিসিবি সেটিও দেখার বিষয়। 
রাসেল ডমিঙ্গো ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের প্রধান  কোচ হিসেবে নিয়োগ পান। ওই বছর ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর স্টিভ রোডসকে সরিয়ে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। রোডসের জায়গায় দায়িত্ব পেয়ে বাংলাদেশকে বেশ কিছু সাফল্য এনে দেন ডোমিঙ্গো। এ বছর অক্টোবর-নবেম্বরে ওয়ানডে বিশ্বকাপ পর্যন্ত ছিল চুক্তির মেয়াদ। কিন্তু প্রায় ১১ মাস আগেই দায়িত্ব ছাড়লেন।

দলের অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের সঙ্গে তার বোঝাপাড়ার অভাবের মতো মাঠের বাইরের ঘটনা নিয়ে যেমন তাকে পড়তে হয়েছে দেশবাসীর রোষানলের মুখে, তেমনই মাঠেও অভাবনীয় কিছু ব্যর্থতা তাকে ডুবিয়েছে গ্লানিতে। ডমিঙ্গোর সরে যাওয়ার পর থেকেই সবার মনে প্রশ্ন একটাই। কে হতে যাচ্ছেন ডমিঙ্গোর উত্তরসূরি? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, হাতুরুকেই ফেরাতে যাচ্ছে বিসিবি। হাতুরুর আমালে মাঠের ক্রিকেটে বেশ সাফল্য পায় টাইগাররা।

২০১৪  সলের মে থেকে ২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ২১ টেস্টের ৬টিতে জয় পায় বাংলাদেশ, ড্র করে ৪টি। ৫২ ওয়ানডের ২৫টি জিতে সাফল্য প্রায় ৫০ শতাংশ। ২৯টি টি২০ খেলে টাইগারদের জয় ১০টি। বড় দলগুলোর বিপক্ষে জয়ের মানসিকতা তৈরি করতেই হাতুরুর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।  
বাংলাদেশের ক্রিকেটে অবদান রাখার পিছনে খেলোয়াড়দের পাশাপাশি সমসময়ই কোচদের প্রধান ভূমিকা ছিল। সেই ১৯৯৬ থেকে ২০২২, গর্ডন গ্রিনিজ থেকে রাসেল ডমিঙ্গো-  কোচ হয়ে এমন অনেকেই দায়িত্ব নিয়েছিলেন যারা বাংলাদেশের ক্রিকেটকে মন থেকে ভালোবাসতেন। যারা  চেয়েছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দুনিয়ায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। আবার এমন কোচও এসেছেন যারা শুধু প্রফেশনাল জায়গা থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে কোচিং করিয়ে গিয়েছেন। বাংলাদেশের কোচের ইতিহাস শব্দের তরঙ্গের মতোই উঠানামা করেছে। 
কখনো এসেছে ভালো সময়। কখনো দীর্ঘ সময় চলেছে খারাপ সময়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিদায়টা সুখকর ছিল না। অনেক আলোচনা-সমালোচনা সঙ্গী করে কড়া হেড মাস্টার হাতুরু ফিরলে কেমন হবে? সেটিই এখন দেখার অপেক্ষা।

×