ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২

উত্তর-আধুনিক বিশ্ব রাজনীতির রোল মডেল

প্রকাশিত: ০৭:৫৭, ১৪ জুলাই ২০১৬

উত্তর-আধুনিক বিশ্ব রাজনীতির রোল মডেল

Ones upon a time সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। আমাদের এই ভূখ-টি ছিল হাজার নদী খাল বিল জলাভূমি বেষ্টিত এমন এক দেশ যেখানে বাঘে-মোষে এক ঘাটে জল খেত, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান, পাহাড়ী-বাঙালী এক আঙ্গিনায় পাশাপাশি বসবাস করত। প্রত্যুষে ঠাকুর বাড়ির কুলবধূ আয়নার মতো ঝকঝকে পিতলের কলসি কাঁখে দীঘির এক পাড়ের শানবাঁধানো ঘাট থেকে জল ভরে বাড়ি ফিরত, আরেক পাড়ের ঘাট থেকে মিয়াবাড়ির রাঙা বউ মৃৎশিল্পীর নিপুণ হাতে গড়া মাটির কলসিতে পানি ভরে বাড়ি ফিরত। রাতে জোনাকির মিটিমিটি আলোয় ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আর মহাজনী নৌকোর মাঝিদের ভাটিয়ালি গানের সুরে মাঝি বাড়ির ডানপিটে ছেলেটিও ঘুমিয়ে পড়ত এবং রাত শেষে পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙত। প্রভাতী সূর্যের নির্মল আলো মাঠে মাঠে ধান-কাউনের ওপর সোনালি রং ছড়াত এবং কিষান-কিষানিরা সোনালি দিনের স্বপ্ন দেখত। সন্ধ্যায় মিয়াবাড়ির দহলিজে পান-তামাকের আসরে পুঁথি পাঠ জমজমাট অথবা সাউ বাড়ির নাট মন্দিরে কৃষ্ণ-কীর্তন, দূর-দূরান্ত থেকে কুড়ি কুড়ি টাকা বায়নায় নট-নটি কীর্তনীয়ারা আসত। সে সব আমরা শুনেছি। তারপর একদিন ধান ফুরাল পান ফুরাল বর্গি এলো দেশে। ভিন দেশী ভিন ভাষী সাদা চামড়ার অহঙ্কারী ভিক্ষুক- বেনিয়ারা এলো, তাদের এবং তাদের উচ্ছিষ্টভোগীদের চক্রান্তে বাংলা মায়ের বুক দ্বিখ-িত হলো। এলো মিলিটারি আর ধর্মের নামাবলী গায়ে বকধার্মিকরা, তাদের বুটের তলায় পিষ্ট হতে হতে বাংলার পথঘাট মানুষগুলো যেন মেঘলা বিকেল। কিষান-কিষানির হাসি মুখ মলিন হলো; মিয়াবাড়ির দহলিজ আর সাউ বাড়ির নাটমন্দিরে আসর বসে না; মহাজনী নৌকার ভাটিয়ালি, মুরশিদী শোনা যায় না, মারি ও মন্বন্তরে সব নিথর নিশ্চুপ। না, এ অবস্থা চলতে দেয়া হয়নি বেশিদিন। বাঙালির হাজার বছরের কাক্সিক্ষত পুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান গর্জে উঠলেন, না, এ অবস্থা চলতে দেয়া হবে না। বাঙালী বাঁচবে তাঁর নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে অবলম্বন করে। কোন ভিক্ষুক-বেনিয়ার কৌশলী চোখ রাঙানিকে আমরা ভয় করি না। আমাদের আছে নিজস্ব সত্তার অদম্য শক্তি। আমাদের কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না। এ এক সম্মোহনি ডাক। পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা পারের মানুষ এক কাতারে দাঁড়িয়ে গেল। তাদের হাতে হাতে বাংলার প্রকৃতিপ্রেম ও বিদ্রোহের স্কেচ অঙ্কিত প্ল্যাকার্ড ফেস্টুন। আগে আগে শেখ মুজিব পেছনে জয় বাংলা বলে কাতারবন্দী হলেন কালিদাশ, কান্নুপা, চ-িদাশ, বিদ্যাপতি, অতীশ দীপংকর, মাইকেল, আলাওল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, তিতুমীর, ইশা খাঁ, শমসের গাজী, মাস্টার দা, প্রীতিলতা, লালন, সিরাজ, নেতাজী, সোহ্রাওয়ার্দী, শেরে বাংলা, ভাসানী, সৈয়দ নজরুল, তাজ, রোকেয়া সাখাওয়াত, সুফিয়া কামাল, সিরাজ উদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, জয়নাল, জসীম, গাফ্ফার চৌধুরী, শামসুর রাহমান, গুণ, হেলাল হাফিজ, আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফর রহমান, সানজিদা খাতুন, জাহিদুর রহিম, সৈয়দ শামসুল হকরা। দূরে দাঁড়িয়ে হাত তুলে ওয়েভ করতে থাকলেন ইন্দিরা, লেনিন, নাসের, ইয়াসির আরাফাত, ক্যাস্ট্রো, টিটোরা। পরাভূত হলো অহঙ্কারী ভিক্ষুক বেনিয়ার দল, ধর্মের নামাবলী গায়ে মতলববাজ বকধার্মিকরা। বাঙালী শেখ মুজিবুর রহমানকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গ ভূখ-ের অবিসংবাদী নেতার আসনে বসালেন। তাঁর আসনটি হয়ে উঠল পোস্ট মডার্ন বা উত্তর আধুনিক গণতন্ত্র এবং বিশ্ব রাজনীতির আদর্শিক উদাহরণ। বাংলার মানচিত্র, পতাকা, সঙ্গীত, বিশ্বব্যাপী মুক্তিকামী মানুষের আদর্শিক পথের সন্ধান দিল। অন্ধকার বিবরে আশ্রয় নিল গণতন্ত্র ও প্রগতির শত্রুরা। কিন্তু না, আবার কালো ছায়া। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় পরাজিত ভিক্ষুক- বেনিয়ারা বকধার্মিকরা কোণঠাসা বিশ্ব মোড়লদের সঙ্গে চক্রান্ত করে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাংলার আত্মাকে হত্যা করল। শকুন-শকুনির দল আবার আমার পতাকা, সঙ্গীত খামছে ধরল। বাংলাদেশ এখন চড়ংঃ সড়ফবৎহ বা উত্তর আধুনিক যুগে যে নতুন গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হলো এবং যা তৃতীয় বিশ্ব ছাড়িয়ে বৈশ্বিক সংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রবেশ করল শেখ হাসিনা তারই রোল মডেল হিসেব আবির্ভূত হলেন। যারা প্রতিটি মুহূর্ত শেখ হাসিনার খুৎ খুঁজে বেড়ান তাদের মুখে ছাই দিয়ে এখন বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তিনি অন্যতম সাহসী, আপোসহীন ও দূরদর্শী নেতা ঈর্ষণীয় রাষ্ট্রনায়ক। উত্তর আধুনিক যুগের নতুন ধারার গণতন্ত্র তথা রাষ্ট্রের মৌলনীতি ও আদর্শভিত্তিক মৌলিক মানবাধিকার চর্চার পাশাপাশি, সোজা কথায় ভোটের রাজনীতিতে এর সুফল কতখানি জনগণ পেলেন বা দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের আশা-আকাক্সক্ষায় কতখানি প্রভাব সৃষ্টি করতে পারল সেটাই বড় প্রশ্ন। এই ধারায় শেখ হাসিনা আজ বিশ্বের দশ প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়কের অন্যতম ঈর্ষণীয় রাষ্ট্রনায়ক ও রোল মডেল। এই অভিধা এমনি এমনি আসেনি, বরং তাঁর আপোসহীন সাহস ও মানবপ্রেম তাঁকে এ জায়গায় এনেছে। শুরু হয় আবার চক্রান্ত। বর্গি, ভিনদেশী ভিক্ষুক বেনিয়ার দল আবার চক্রান্তের জাল বুনতে শুরু করে। বিশেষ করে জাতির পিতার হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করলে এবং জিয়া এরশাদ-খালেদার পাকি ধারার বিপরীতে চড়ংঃ সড়ফবৎহ গণতন্ত্রের পথে দেশকে এগিয়ে নিতে শুরু করলে রাষ্ট্রবিরোধী অন্ধকারের কীটদের পিলে চমকে ওঠে। ১৯ বার তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয় কিন্তু বিপ্লবী পিতার বিপ্লবী কন্যা আল্লাহর অশেষ কৃপায় জনগণের ম্যান্ডেট ও ভালবাসা নিয়ে নিরন্তর এগিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশ আজ এশিয়ার বিশটি দেশের মধ্যে ৫তম উন্নয়নশীল রাষ্ট্র এবং শেখ হাসিনা ঈর্ষণীয় রাষ্ট্রনায়ক। বৈশ্বিক ও চড়ংঃ সড়ফবৎহ ধারায় গণতন্ত্রিক রাজনীতির রোল মডেল এই জন্য যে : জিয়া-এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্র ও খালেদার হাফ মিলিটারি শাসনের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণ। অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতায়ন এবং বিশেষ করে বেগম রোকেয়ার আদর্শে নারীর ক্ষমতায়ন। অবরোধবাসিনীদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাহসী করে তোলে। নিজে স্বপ্ন দেখেছেন, অন্যকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। উন্নয়নের স্বার্থে গণতন্ত্র অর্থাৎ উন্নয়ন ও গণতন্ত্রকে একে অপরের পরিপূরক এই বাস্তবতাকে জনপ্রিয় করে এক বৈপ্লবিক জাতীয় ঐক্য ও জাগরণ সৃষ্টির ঈর্ষণীয় নেতৃত্ব দিলেন। এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশকে আর্থ-সামাজিক-গণতান্ত্রিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। এককালের মঙ্গা, দুর্ভিক্ষের দুর্নাম ঘুচিয়ে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশে ৪ কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে, শ্রীলঙ্কায় চাল রফতানি করছে বাংলাদেশ। ‘মঙ্গা’ ‘দুর্ভিক্ষ’ ‘কাহাত’ এসব শব্দ এখন আর জনজীবনে নেই, ডিকশনারিতে ঢুকে গেছে। এ মুহূর্তে আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ৭.২% এবং সে তুলনায় মূল্যস্ফীতিও কম, ৮% নিচে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১৪০০ মেগাওয়াট। এখন লোডশেডিংয়ের কথা শুত্রুরাও বলে না, বলার সুযোগ নেই। শিক্ষা, কৃষি ও স্বাস্থ্য খাত উন্নয়ন, স্বাস্থ্য খাতের কমিউনিটি ক্লিনিক আজ বিশ্বব্যাপী অনুকরণীয় ব্যাপার। বিশেষ করে কৃষি খাতে আমাদের বিজ্ঞানীদের গবেষণা প্রতিটি দিন কৃষিপ্রধান বাংলার জনগণের কাছে আশার আলো এনে দিচ্ছে। আঙ্গুর, আপেল, কমলা, স্ট্রবেরি ইত্যাদি এখন আর বিদেশী ফল নয়, বাংলাদেশেই উৎপাদিত হচ্ছে এবং সুস্বাদু। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। মুরগি এখন নাগালের মধ্যে এবং গ্রামের মানুষও এখন মেহমানদারী করে মোরগ-পোলাও বা মোরগ-খিচুড়ি দিয়ে। শেখ হাসিনার গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নমুখী বড় বড় বাজেটের পাশাপাশি মেক্রো-অর্থনীতির ভলিয়মও অবাক করার মতো। বিদেশের কাছে হাত না পেতেও যেমন উর্ধমুখী জিডিপির হার বছরের পর বছর ধরে রেখেও জাতীয় বাজেটের পরিমাণ প্রায় সাড়ে তিন লক্ষাধিক হাজার কোটি টাকা। এখন গড় মাথাপিছু আয় ১৪৬৬ মার্কিন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশে একজন মানুষও এখন না খেয়ে থাকে না। মানুষ কাজ পাচ্ছে। যারা চিরকাল আমাদের বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’, ‘ঝড়-জল-বন্যার দেশ’, ‘মঙ্গা-দুর্ভিক্ষে’র দেশ বলে অপবাদ-অপমান করেছে, তাদেরই একজন বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. কৌশিক বসু বলতে বাধ্য হয়েছেন বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে চীনের পাশাপাশি সমানতালে এগিয়ে চলেছে, অর্থাৎ প্লেনের মতো টেক অফ করে চলেছে। যে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগ এনে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিল। বাংলার প্রধানমন্ত্রী ১৬ কোটি মানুষের অবিসংবাদী নেত্রী শেখ হাসিনা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করেন এবং এরই মধ্যে ৩৩%-এর ওপরে কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অর্থায়নেরও অভাব হচ্ছে না এবং ২০১৯ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন ও বাস, ট্রাক, কার চলাচল শুরু করবে। আমি হলফ করে বলতে পারি এমন সাহসী চ্যালেঞ্জ একমাত্র বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার পক্ষেই নেয়া সম্ভব হয়েছে। আরও অনেকেই ছিল তো, সেই পাকিস্তান আমল থেকে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার মিলিটারি শাসন বা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়া-এরশাদের সামরিক স্বৈরাচার এবং খালেদা জিয়ার শিপন-অর্থনীতি ও ফেসিয়াল-রাজনীতি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ তো দূরের কথা, পুরো সময়টাই বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, রাবেতা আলম ইসলামের পা চেটেছে এবং বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর উদ্দেশ্যে গুলি, বোমা, গোপন বিচার, পেট্রোলবোমা চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। দেশ এগোয়নি, গণতন্ত্র বুটের তলায় পিষ্ট হয়েছে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তলানিতে নামিয়েছে। কূটনৈতিক দিক বা পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়কোচিত সাফল্য নজিরবিহীন : পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান প্রথমবার (১৯৯৬-২০০১) ক্ষমতায় এসেই রাজনৈতিক পথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যম সমাধান করেছেন। একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপকে (প্রায় ১৩০০) আত্মসমর্পণ করিয়ে এবং বিদেশের মাটিতে অবস্থানরত ৬০ হাজার শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে আনেন এবং পুনর্বাসন করেন। আইয়ুব, জিয়া, এরশাদ, খালেদার মতো মিলিটারি নিষ্পেষণ করে নয়, বরং শান্তি চুক্তির মাধ্যমে (১৯৯৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি) সমাধান করেন। মিয়ানমার ও ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব অর্জন এবং জলসীমার দখলিসত্ব প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত সীমান্ত চুক্তি, যা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিনামে খাত, ৪৪ বছর পর ভারতের বর্তমান মোদি সরকারের সঙ্গে বসে সমাধান করেন। অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ছিটমহল সমস্যার সমাধান দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও সমতার ভিত্তিতে। যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে ভিত্তি করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালীর জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। সেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের রক্তঝরা দিন অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে নিয়ে ‘আন্তরিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। জাতিসংঘের সদস্য ১৮৮টি দেশে একুশে ফেব্রুয়ারি ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। এভাবে লিখতে গেলে বড় বড় ভলিয়ম গ্রন্থ রচনা করতে হবে। বিশ্ব স্বীকৃতি এনে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাঙালী জাতিকে সম্মানিত করেছেন, মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। ভারতের বিশ্বভারতী, আমেরিকার বোস্টন, ইংল্যান্ডের মানচেস্টার, জাপানের ওয়াসেদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমনি বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় তার নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ডক্টরেট ডিগ্রীতে ভূষিত করেছেন। যে কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে অপমানিত করেছিলেন সেই কিসিঞ্জারই কৃষি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক উন্নয়নের স্বীকৃতিস্বরূপ সেরেস পুরস্কার শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিয়ে প্রায়শ্চিত্য করেছেন। এমন ইনটেলেকচুয়াল চপেটাঘাত আর কেউ বিশ্ব মোড়লদের দিতে পেরেছে কিনা সন্দেহ। শেখ হাসিনার তুলনা কেবল রাশিয়ার পুতিন, জার্মানির এ্যাঞ্জেলা মার্কেলের সঙ্গেই হতে পারে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করার পর থেকে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের মোড়ল (অবশ্য এখন রাশিয়া সবল প্রতিদ্বন্দ্বী) আমেরিকা, জাতিসংঘসহ পশ্চিমা, দেশগুলো যেভাবে রক্তচক্ষু নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল শেখ হাসিনা সামান্যতম গুরুত্ব না দিয়ে নিজের কাজগুলো করে চলেছেন বিপ্লবী রাষ্ট্রনায়কের মতো এবং তিনি সফল হয়েছেন। এতটা সাহস ও শক্তি কোথায় পেলেন তারও একটা ঐতিহ্য রয়েছে। সে ঐতিহ্য বাংলা ও বাঙালীর শ্রেষ্ঠ পুরুষ বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার এবং গ্রামের মানুষকে চেনার ক্ষমতা। রাজনীতিতে আগমন মে ১৭, ১৯৮১ ইংরেজী। স্থান মানিক মিয়া এ্যাভিনিউ, সংসদ ভবন চত্বর, আশপাশের সড়ক জনপথ জুড়ে অর্ধ কোটি মানুষ। এক কোটি চোখ। চোখে চোখে জল। ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে মশুলধারে বৃষ্টি ছিল। শেখ হাসিনার সঙ্গে মানুষের চোখের জল বৃষ্টির জলে মিশে যেন বাংলার পাপাচার-অনাচার ধুয়ে যাচ্ছিল। পিন পতন নিস্তব্ধতার মাঝে একটি মাত্র কান্নাভেজা কণ্ঠ : আস্সালামু আলাইকুম, মা-বোনেরা, ভায়েরা, মুরব্বিগণ “বাবা-মা ভাই-ভাবি সব হারিয়ে আপনাদের মাঝে এসেছি। আপনাদের মাঝেই বাবা-মা ভাই-ভাবিদের খুঁজে পেতে চাই। আমার বাবা বাংলার মানুষকে বড় ভালবাসতেন। শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য সারাজীবন কাজ করেছেন, অনেক জেল-জুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন, নিজের জীবনটা পর্যন্ত দিয়ে গেলেন। কোন প্রতিহিংসা নয়, আমি এসেছি তাঁর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে। শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাঁর প্রিয় গরিব-দুঃখী মানুষ যাতে দু’বেলা খেয়ে পরে বাঁচতে পারে সে ব্যবস্থা করে হত্যার প্রতিশোধ নিতে চাই, মানুষের সেবা করতে চাই। আপনারা আমাকে দোয়া করবেন। ‘খোদা হাফেজ’, ‘জয়-বাংলা, জয়-বঙ্গবন্ধু’ সেদিন অবিরাম বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ার মধ্যেও বিমানবন্দর থেকে মানিক মিয়া এ্যাভিনিউ পর্যন্ত গোটা অঞ্চল ছিল এক বিশাল জনসমুদ্র - জাতির জনকের কন্যাকে একনজর দেখার জন্যে কেবল রাজধানী ঢাকা নয়, গোটা দেশটাই যেন ভেঙ্গে পড়েছিল। গ্রাম-শহর-বন্দর থেকে প্রবীণরা যেমন এসেছেন তেমনি নবীনরাও। রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র-শিক্ষক, শিল্পী-বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক-কৃষক-জনতা এক কাতারে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে। কত মানুষ নেমেছিল সেদিন রাজপথে-৫০ লাখ ৬০ লাখ? সংখ্যা যাই হোক তা কেবল তুলনা হতে পারে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তির পর ২৩ ফেব্রুয়ারি এবং পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তির পর ১০ জানুয়ারি ১০৭২ সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের (তৎকালীন রেসকোর্স) জনসমুদ্রের সংবর্ধনার সঙ্গেই। সাড়ে ৬টি বছর দুই শিশু সন্তান, স্বামী ও ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে নির্বাসিত ছিলেন। দেশে ফিরে আসার পথেও জিয়া বার বার বাধার সৃষ্টি করেছে, মীর্জা গোলাম হাফিজের নেতৃত্বে ‘শেখ হাসিনার আগমন প্রতিরোধ কমিটি পর্যন্ত করেছে, কিন্তু জাতির পিতার কন্যাকে বাধা দিয়ে আটকানো যায়নি। ১৯৮১-এর ফেব্রুয়ারিতে (১৩-১৪) দলের সভাপতি নির্বাচিত হবার পর সকল বাধার বৃন্দাচল অতিক্রম করে দেশে ফিরেছেন। হতাশাগ্রস্ত জাতি শেখ হাসিনার আগমনের সেই মুহূর্ত থেকে আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। মানুষের এই স্বপ্নের প্রতি সম্মান দিয়ে ১৯৮১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩৫ বছর, অর্থাৎ জীবনের অর্ধেকটা সময়ই দেশের উথাল-পাথাল রাজনীতির মহাসড়কে ক্লান্তিবিহীন দৃপ্ত পথ চলা। তাঁকে বার বার হত্যা করার ষড়যন্ত্র হয়, গ্রেনেড হামলাসহ ১৯ বার তাকে হত্যার জন্য হামলা চালানো হয়, আল্লাহর অশেষ কৃপায় তিনি বেঁচে আছেন। সেই থেকে আজ অবধি মানুষের রাজনীতি করতে গিয়ে মৃত্যু ভয় কিংবা স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু সব উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা আজ রাষ্ট্র নেতৃত্বের যে উচ্চতায় এসে দাঁড়িয়েছেন সেখানে তিনি রাজনীতির লিডার। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে তো বটেই। তাঁকে দেখেছি এরশাদের স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে। মনে পড়ে চারদিকে এরশাদের পুলিশী প্রহরা, অঘোষিত গৃহবন্দী, তখন ৩২ নং বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে ঘোষণা দিলেন তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের সংবাদ সম্মেলনে যাবেন। দলের অনেকেই রাজি হচ্ছিলেন না, দেশী বিদেশী অনেক সাংবাদিক। বললাম, আপনি যাবেন, আমরা অর্ধশতাধিক সাংবাদিক আপনার সঙ্গে থাকব। তিনি বেরিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে, অন্তত দুই প্লাটুন মহিলা পুলিশসহ শতাধিক পুলিশ তাকে ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তিনি দৃপ্ত পদভারে এগিয়ে গেলেন মিরপুর রোডের মুখে। আর এগোতে পারলেন না, সেখানেই একটা রিক্সার ওপর দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশে কিছু বলতে যাবেন এমন সময় সাদা চামড়ার এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, গধফধস, পধহ ুড়ঁ ঃবষষ ঁং ুড়ঁৎ হবীঃ পড়ঁৎংব ড়ভ ধপঃরড়হ? শেখ হাসিনা চমৎকার ইংরেজীতে বললেন, ঋরৎংঃ বি রিষষ পড়সঢ়বষষ ঃযব ধঁঃড়পৎড়ঃরপ সরষরঃধৎু ৎঁষবৎ ঃড় ংঃবঢ় ফড়হি ধহফ ঃযবহ বি রিষষ ংঃধৎঃ ধ ঢ়ৎড়পবংং ভড়ৎ ভৎবব ্ ভধরৎ হধঃরড়হধষ বষবপঃরড়হ. ণড়ঁ শহড়ি ঢ়বধপব ধহফ ভৎববফড়সষড়ারহম ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ইধহমষধফবংয যধাব নববহ ভরমযঃরহম ভড়ৎ ঃযধঃ ভড়ৎ ষড়হম ঃরসব. সেদিন আমরা স্থানীয় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করার কোন সুযোগ পাইনি। এক বিদেশী সাংবাদিককে প্রশ্ন করেছিলাম ডযধঃ রং ুড়ঁৎ রসঢ়ৎংংরড়হ ধনড়ঁঃ ঃযব ষবধফবৎংযরঢ় ড়ভ ংযধরশয ঐধংরহধ? বললেন, ও ঁহফবৎংঃধহফ, ংযব যধং ঃযব পধঢ়ধনরষরঃু ড়ভ পধৎৎুরহম ভড়ৎধিৎফ ঃযব ফৎবধসং ড়ভ যবৎ ভধঃযবৎ. আমরা বাংলাদেশের সাংবাদিকরা অনেকেই তা আবিষ্কার করতে পারিনি, এ জন্য যে কারও মেধার দৈন্য কারও ‘ফির ভি দিল হায় পাকিস্তানী’ বলে। শেখ হাসিনাকে হত্যার যত ষড়যন্ত্র হয়েছে ১৯ বার এটেমড নেয়া হয়েছে যার কোনটিই কোনটার চেয়ে কম ভয়াবহ ছিল না। এখানে গা শিউরে ওঠা দু’-একটি উদাহরণ তুলে ধরছি : ক. শেখ হাসিনা প্রথমবার (১৯৯৬-২০০১) প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। কোটালীপাড়ায় শেখ লুৎফুর রহমান কলেজের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছেন হেলিকপ্টারে। দুটি হেলিকপ্টারের মধ্যে একটিতে তিনি অপরটিতে সফরসঙ্গী আমরা সাংবাদিকরা। শেখ হাসিনাকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি যেখানে অবতরণ করল তার ৫-৬ গজ দূরে একটি এবং হেলিপ্যাড থেকে একটু দূরে কলেজের পাশে যে জায়গাটায় পা রেখে গাড়ি থেকে নামবেন সেখানে দ্বিতীয় বোমাটি পোঁতা ছিল। একেকটির ওজন ৭৬ কেজি, এগুলো রিমোট-কন্ট্রোল ল্যান্ড-মাইন। আগের দিন এক দোকানের টি-বয় খালের পানিতে কাপ-প্রিজ ধোয়ার জন্য গেলে পানিতে তার দেখে মালিককে দেখালে ধরা পড়ে এবং পুলিশ এনে দুটি মাইনই তুলে ডি-পিউজ করা হয়। প্রিয় পাঠক, এই ভয়াবহতা একবার চিন্তা করুন, হেলিপ্রাডে বা গাড়ি থেকে অবতরণস্থলে যে কোন একটির বিস্ফোরণ হলে কি হতো? (আল্লাহ পাক তাঁর হায়াত রক্ষা করেছেন)। এমনকি ৩২ নং বাড়িতেও একাধিকবার গুলি চালানো হয়েছিল। খ. বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউর আওয়ামী লীগ অফিসের সামনের গ্রেনেড হামলার কথা কে না জানে? তৎকালীন খালেদা-নিজামী সরকারের অগণতান্ত্রিক ও নিপীড়নমূলক কর্মকা-ের বিরুদ্ধে গণমিছিলের কর্মসূচী, শেখ হাসিনা নেতৃত্ব দেবেন। হোটেল শেরাটনে সার্ক দেশসমূহের সাংবাদিকদের একটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করছিলাম। ৫টায় মিছিল শুরু হবে তাই সাড়ে ৪টায় নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে বেরিয়ে পড়লাম। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের কাছে এলে আমার এলাকার যুবলীগ নেতা খোকা সেলফোনে বিস্ফোরণের কথা জানাল। দ্রুত গাড়ি চালিয়ে প্রেসক্লাবে রেখে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউর দিকে দৌড়ালাম। আওয়ামী লীগ অফিসের চারপাশে টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় অন্ধকার, কিছু দেখা যাচ্ছিল না, সামনে এগোতেও পারছিলাম না। দেখলাম, এর মধ্যে কর্মীরা হতাহতদের কাঁধে করে রিক্সা-ভ্যানে করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। বীভৎসতার রূপটি দেখলাম পুলিশ টিয়ার শোলিং বন্ধ করে চলে যাওয়ার পর সামনের পুরো চত্বর রক্তে ভাসছে, এখানে ওখানে লাশ, বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমানের নিথর দেহ রক্তে ভাসছে। পরে জেনেছি তা সাধারণ বোমা ছিল না, ছিল সিরিজ অব গ্রেনেডের বিস্ফোরণ। টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করা। আল্লাহ পাকের কৃপায় শেখ হাসিনার জীবন রক্ষা পেলেও একটি কানের শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেদিন নিহত হন ২৩ জন এবং আহত হন তিন শতাধিক, যাদের অনেকেই আজও শরীরে গ্রেনেডের ইসপ্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন। আবদুর রাজ্জাক, মুহম্মদ হানিফ ইসপ্লিন্টার নিয়েই দুনিয়া থেকে চলে গেলেন। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো এই মামলার অনুসন্ধানে জানা গেল এটি ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং তা হয়েছিল হাওয়া ভবনে তারেকের বৈঠকে। কেন হত্যার ষড়যন্ত্র শেখ হাসিনাকে জানতে হলে শৈশবে তাঁর গ্রামীণ জীবন, দক্ষিণ বাংলার এক দুর্গম টুঙ্গিপাড়া গ্রাম, এক পাশে মধুমতি আরেক পাশে বাঘিয়া মাঝখানে বয়ে চলা সংযোগ খালের পাশে শেখ বাড়িতে তাঁর জন্ম। ১৯৪৭ সালে। এখানে বর্ষায় বান ডাকত, ঢেউ উঠত মধুমতি আর বাঘিয়ায়, বানের জলে ভাসত দু’কূল, ঘরবাড়ি, গোয়াল, জনপদ, ফসলের মাঠ, বন-বনানী, গাছ-গাছালি। গ্রামের মাঝ দিয়ে গেছে খালটি, টুঙ্গিপাড়ার হৃৎপি-ে রক্তের যোগান দিতে দিতে। বর্ষার যাতায়াত বলতে নৌকা, লঞ্চ, শুষ্ক মৌসুমের কিছু সময় কিছু কিছু এলাকায় পায়ে চলা পথ ধারে কাছে। আড়াই শ’-তিন শ’ বছরের শেখ বাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই জনপদ ধনী-দরিদ্র, সচ্ছল-অসচ্ছল, ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাত নির্বিশেষে মানুষগুলোর মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন। বাড়ির সামনের বনানী পেরোলে সোনালি ধানের মাঠ, মধুমতি-বাঘিয়ার ঢেউয়ের মতোই অপরূপ তরঙ্গ সৃষ্টি করে মৌসুমে। ক্ষেতের আল দিয়ে ওই যে ছাগল ছানাটির পিছু পিছু ছুটছে কিষান বালিকা, পিঠের ওপর লম্বা এক জোড়া চুলের বেণী বাতাসে উড়ছে, পশ্চিমাকাশে গোধূলির লাল রং, এখন ঘরে ফেরার পালা। ছুটির দিন অফুরন্ত সময়। মকতবের হুজুরের তাড়া নেই, পাঠশালায় প-িত মশাইকে পড়া দিতে হবে না, কেবলই খেলার সাথীদের নিয়ে পাড়া বেড়ানো, পুকুরে সাঁতার কাটা, দল বেধে মাছ ধরা, খালপাড়ের কুল গাছ থেকে পাকা কুলটি পাড়ার সময় পানিতে পড়ে গেলে দুঃখ পাওয়া, (শেখ হাসিনা একদিন আলাপচারিতায় বলছিলেন, টলটলা পানিতে পড়ে পাকা কুলটি যেন তাকিয়ে ব্যঙ্গ করছিল)। ওরা প্রকৃতির সন্তান, ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যময় জীবনের আশীর্বাদ নিয়ে ধরায় এসেছে গ্রামীণ কিষান বালিকারা। এই ছিল পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত গ্রাম বাংলার ছবি। এদেরই সত্যিকার প্রতিনিধি শেখ হাসিনা। দাদা-দাদির অফুরন্ত আদর, মায়ের শাসন-সোহাগ, গ্রামের সবচে অভিজাত বাড়ির সন্তান, অর্থ-প্রাচুর্য সবই হাতের নাগালে, কিন্তু না, শিক্ষার প্রতি অনুরাগ, বাবার রাজনীতি, বারে বারে কারাবরণ, পারিবারিক কালচারের মধ্যে শৈশবেই রাজনীতির সঙ্গে তাঁর পরিচয়। প্রথম প্রথম মনে হতো ভোমা ভোমা মোছওয়ালা দারোগাগুলো কেন তাঁর বাবাকে ধরে নিয়ে যায়? কখনও দাদির কাছে কখনও মায়ের কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেন। তারপর একদিন টুঙ্গিপাড়ার মায়া ত্যাগ করে মায়ের হাত ধরে চোখ মুছতে মুছতে নৌকায় ঢাকার পথে পা রাখলেন, পেছনে পড়ে রইল। ‘হাসু খেলতে যাবি’- খেলার সাথীদের ডাকও এক সময় মিলে যায়, তারা কারও বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ না তুলে নৌকার পাশে পাশে দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় চোখের আড়াল হয়ে গেল। কিন্তু না, টুঙ্গিপাড়া তাঁর মায়া ত্যাগ করেনি, তিনিও না, তাই তো বার বার ছুটে যান। কারণ সেখানে শুয়ে আছে বাংলার হৃদয়। তারপর ঢাকায় ভাড়া বাড়ি, এখান থেকে ওখানে, অবশেষে ১৯৬১ সালে ধানম-ি ৩২ নম্বরের (ঐতিহাসিক) বাসভবনে স্থায়ী বসবাস। সেই সুবাদে আজিমপুর গার্লস হাই স্কুল, ইডেন কলেজ (ভিপি) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ এবং আবদুল হাই, মনির চৌধুরীর মতো স্যারদের সাহচর্য। বাড়িতে রাজনীতিক পিতা এবং সেই সুবাদে বেগম সুফিয়া কামাল, শেরে বাংলা, সোহ্রাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, কবি জসীম উদ্দীন, প্রফেসর ম্যাক, বোস প্রফেসর মতিন চৌধুরী, দার্শনিক জিসি দেব, বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদা, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, মানিক মিয়া, প্রফেসর আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী এবং বৈবাহিক সূত্রে প্রখ্যাত অনুবিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ আলী মিয়ার সান্নিধ্য তাঁর মেধা ও মননকে সমৃদ্ধ করে তোলে। আজিমপুর গার্লস হাই স্কুলে ৮ম শ্রেণীতে পড়াকালে ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে একবার সহপাঠী বন্ধুদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলার ছাত্র সমাবেশে যোগ দেন। সেখান থেকে মিছিল বের করলে পুলিশ হামলা চালায়। তখন বন্ধুরাসহ কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে রোকেয়া হলে আশ্রয়। তারপর ইডেন গার্লস কলেজ ছাত্রী সংসদের নির্বাচিত ভিপি, ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি এবং ৬ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা পালন, তবে কখনও শেখ মুজিবের কন্যা এই দাবিতে কোন সিনিয়র নেতার পদ দখল করেননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা, দুই ভাই কামাল-জামাল প্রথমেই যুদ্ধে চলে যায়। তারপর সংসার জীবন, মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে আটকাবস্থায় প্রথম সন্তান জয়ের জন্ম, এরপর কন্যা পুতুল। এলো ইতিহাসের সেই ভয়াবহ ট্র্যাজেডি ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট। সে সময় ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা স্থল জার্মানিতে থাকায় ঘাতক বুলেট তাদের প্রাণ সংহার করতে পারেনি। কিন্তু জীবনটাকে এলোমেলো করে যায়, না, সাড়ে ৬ বছর প্রবাস জীবন শেষে রাজনীতির বন্ধুর পথ চলা। সেই থেকে ৩৫ বছরে দলীয় সভাপতি বিরোধীদলীয় নেতা, তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। জাতীয়-আন্তর্জাতিক চক্রান্তে পদ্মা সেতুর কাজের শুরুটা বিলম্বিত হলেও দৃষ্টিনন্দন হাতির ঝিল, বকশি বাজার-যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া ফ্লাইওভার, হলি ফ্যামিলি থেকে নাবিস্কো বা শান্তিনগর-বাংলামোটর ফ্লাই ওভার, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে হাত-পা ছড়ানো সিরিজ অব ফ্লাইওভারের স্থাপনা বাংলাদেশের মুখ ঢাকার চেহারা পাল্টে দিয়েছে। তারপর আসছে ঢাকায় মেট্রোরেল, আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কিংবা চট্টগ্রামের কর্ণফুলির তলদেশ দিয়ে যান চলাচলের টানেল। আজ দূর থেকে যখন ভাবি অনেক দুঃখের রজনী পেরিয়ে ৬৯ বছর বয়সে শেখ হাসিনা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন, সেখানে তিনি জননেত্রী এবং চড়ংঃ সড়ফবৎহ রাজনীতির সম্রাজ্ঞী। তার পরও মাঝে-মধ্যে তাকে তাড়া করে ফিরে যখন পেছনে তাকান দেখতে পান টুঙ্গিপাড়ার শেখ বাড়ির নিকানো উঠোন কিংবা ধানম-ি ৩২ নম্বরের চত্বরে ঝরা পাতারা এখনও বাতাসে উড়ে বেড়ায় এখান থেকে ওখানে, এখনও ঘুঘুর ডাক শোনা যায় দূরে কোথাও, শোনা যায় কোকিলের কুহু তান, এখনও দোয়েল নাচে বুকুল গাছে, চড়ই পাখি নিপুণ হাতে বাঁধছে শৈল্পিক বাসা তালগাছে- নেই কেবল মহীয়সী মা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নিসা মুজিবের এখানে ওখানে দৃপ্ত পদভার, এটা ওটা সংসারের কাজ, সূর্যাস্তের আগেই ঘরে ফেরার তাড়া, লাল পেড়ে গরদের শাড়ির আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা পিঠে ঝুলিয়ে এ ঘর ও ঘর করছেন, সন্ধ্যে হয়ে এলো কামাল-জানাল খেলার মাঠ থেকে ফিরল কি-না কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রিয় কবুতরগুলো ঘরে ফিরল কিনা- এমন অস্থিরতা মন ভরে দিত তৃপ্তিতে। লনে ছক্কা মেরে রেহানা আপুকে রানে পেছনে ফেলে সে- কি আনন্দ শিশু রাসেলের- সব কেবলই স্মৃতি আজ। কিন্তু পেছনে তাকাবার সময় কোথায়? তাঁকে যে এখনও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে, ধহফ সরষবং ঃড় মড়. এখনও চক্রান্ত চারদিকে শেখ হাসিনার চলার পথ এখনও নিষ্কণ্টক নয়, বরং আরও ঝুঁকিপূর্ণ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে দেশাভ্যন্তরে একাত্তরের গণহত্যাকারী, নারী ধর্ষণ ও হত্যাকারী, বাড়ি-ঘরে আগুন, ঘরছাড়া করা জামায়াত-শিবির নাশকতা। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে খালেদা জিয়া এবং ফেরারি পুত্র তারেক। তাদের ছত্রছায়ায় জামায়াত-শিবিরের অন্ধকারের কীট হিযবুল মুজাহিদীন, হিযবুল তাহ্রীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হামজা ব্রিগেড প্রভৃতি ঁহফবৎমৎড়ঁহফ টেরোরিস্ট গ্রুপ গড়ে তুলে গুপ্ত হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, মুক্তমনা লেখক, প্রগতিশীল সংস্কৃতি কর্মীদের হত্যা করে চলেছে একের পর এক। শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি শেখ হাসিনার পুত্র প্রখ্যাত আইটি বিজ্ঞানী সজীব ওয়াজেদ জয়কে হত্যার জন্য বিদেশে পর্যন্ত লোক ভাড়া করা হয়েছে। বিএনপির এক নেতার পুত্রের এ জন্য কারাবাসের সাজা পর্যন্ত হয়েছে। এখন তো এক নেতা ঘাতক মোসাদের সঙ্গেও দেখা করেছে। যুদ্ধাপরাধী সাকা-নিজামী-মুজাহিদের মৃত্যুদ- কার্যকর করার মুহূর্তে পাকিস্তান পার্লামেন্ট থেকে প্রতিবাদ জানিয়েছে, মিছিল পর্যন্ত করেছে। এখানে একটা কথা বলা দরকার, বাংলাদেশবিরোধী একটি গ্রুপ বিদেশের মাটিতে বসে চক্রান্তে লিপ্ত। যে পাকিস্তান, তুরস্ক বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, দিয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর- তারাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করছে। কামাল আতাতুর্কের সেই তুরস্ক আর নেই। মুসলিম ব্রাদারহুড দখল করে নিয়েছে। আরেকটি গ্রুপ আছে, বিবিসি, ইকোনমিস্ট, গার্ডিয়ানের মতো গণমাধ্যম এখনও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিচ্ছে, বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে আইএস, আল কায়েদা আছে। লক্ষ্য হলো কোন এক অজুহাতে সাহায্যের নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করা, ঠিক যেভাবে পারমাণবিক বোমার অজুহাত তুলে ইরাকে প্রবেশ করে গণহত্যা চালিয়েছে। ইরাকের নেতা সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসিতে হত্যা করা হলো। ফাঁসির প্রক্রিয়াও ছিল অমানবিক। তার ছেলেদেরও ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। টিভিতে সে সব দৃশ্য দেখে গা শিউরে উঠেছিল, আজও ভাবলে একইভাবে গা শিউরে ওঠে। তারপর বলা হলো ভুল হয়েছে, মানববিধ্বংসী অস্ত্র পাওয়া যায়নি। তবু বিদেশীরা যতখানি হুমকির তারচেয়ে বেশি হুমকি দেশাভ্যন্তরে- এটি শেখ হাসিনা ভাল করেই জানেন বলেই শক্ত হাতে বিষয়টি সুরাহা করে চলেছেন। এখনও ফাঁসির দ- কার্যকর করা হয়নি জামায়াতের অর্থের যোগানদাতা মীর কাশেম আলীর, দেশে আনা যায়নি বিদেশে অবস্থানরত ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আলবদর চৌধুরী মঈনুদ্দিন, আশরাফুজ্জান খানের আনা যায়নি বাচ্চু রাজাকারকেও। প্রধানমন্ত্রী তবু হতাশ নন। তিনি তার মতো করে এগিয়ে চলেছেন। বিদেশের সঙ্কট সমাধানেও প্রশংসিত তার ভূমিকা রয়েছে। প্রথমবার ক্ষমতায় আসার (১৯৯৬ সালে) পরের বছরই পাকিস্তান হঠাৎ করে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। সঙ্গে সঙ্গে সমসক্ষক ভারতও। শেখ হাসিনা প্রথমে দিল্লী এবং তারপর ইসলামাবাদ গিয়ে উভয় দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করে উত্তেজনা প্রশমন করেছিলেন। এই হলেন শেখ হাসিনা। কেউ কেউ প্রশ্ন করেন শেখ হাসিনা এত শক্তি পান কোথায়? এর সোজাসাফটা উত্তর হলো পিতার মতোই তিনিও আল্লাহ ও রসুলের প্রতি সীমাহীন বিশ্বাস এবং বাংলার জনসাধারণের প্রতি আর অকৃত্রিম ভালবাসা। বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতা-বিবতিতে বাংলার ‘গরিব-দুঃখী মানুষ’, ‘আমার মানুষ’ বলতেন। শেখ হাসিনাও ‘গরিব মানুষ’ ‘দুঃখী মানুষ’ ‘আমার মানুষ’-দের বেশি গুরুত্ব দেন। তাঁর রাজনীতির প্রধান শক্তি তারাই। এখানেই তিনি ক্ষান্ত থাকেননি। প্রথমত তিনি একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। এই ক’বছরে প্রায় ৫ কোটি মানুষ মধ্যবিত্ত পর্যায়ে উঠে এসেছে। তারা সংগঠিত একই সঙ্গে সুদীর্ঘ ৩৫ বছরের কর্মপ্রক্রিয়ায় বিশাল সংখ্যক এক তরুণ প্রজন্ম বা তারুণ্যের ঐক্য তাঁর সঙ্গে গড়ে উঠেছে। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ একটি বিস্ফোরণ। এরা দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে, এদের ম
×