ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন পাজল: খণ্ডিত প্রাচীন ২০ দেয়ালচিত্র আবার জীবন্ত

প্রকাশিত: ১১:১৯, ২৪ জুন ২০২৫

বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন পাজল: খণ্ডিত প্রাচীন ২০ দেয়ালচিত্র আবার জীবন্ত

ছবি: সংগৃহীত

আধুনিক লন্ডনের বুকে প্রাচীন রোমান ঐতিহ্যের আরেক বিস্ময় উন্মোচিত হলো। ১ হাজার ৮০০ বছর আগে ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি বিলাসবহুল রোমান ভিলার দেয়ালজুড়ে থাকা বিশালাকৃতির চিত্রকর্মগুলো খণ্ড খণ্ড অবস্থায় মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল এতোকাল। এবার সেই টুকরোগুলোকে জিগস পাজলের মতো জোড়া লাগিয়ে ফের জীবন্ত করে তুলেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা।

লন্ডনের মিউজিয়াম অফ আর্কিওলজি (MOLA)-এর গবেষকরা দক্ষিণ লন্ডনের সাউথওয়ার্কে খননকাজ চালিয়ে একটি বড় গর্তের মধ্যে মাটির নিচে চাপা পড়া হাজার হাজার রঙিন প্লাস্টার বা দেয়ালচিত্রের টুকরো খুঁজে পান। ধারণা করা হচ্ছে, খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালের আগে কোনো রোমান ধ্বংসযজ্ঞের সময় এগুলো ধ্বংসস্তূপ হিসেবে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

প্রথমে এই প্লাস্টারের গুরুত্ব স্পষ্ট বোঝা যায়নি। কিন্তু পরে বিশ্লেষণে দেখা যায়, এগুলো দিয়ে অন্তত ২০টি অভ্যন্তরীণ দেয়ালজুড়ে চিত্রিত এক বিশাল চিত্রমালার অস্তিত্ব ছিল।

MOLA-এর সিনিয়র বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াল স্পেশালিস্ট হান লি এই দেয়ালচিত্রগুলোর টুকরো জোড়া লাগানোর কাজে তিন মাস সময় ব্যয় করেন। তিনি বলেন, ‘এই কাজটি ছিল জীবনের একবারই ঘটে এমন মুহূর্ত। অনেক টুকরো অত্যন্ত ভঙ্গুর ছিল, আবার ধ্বংসের সময় এক দেয়ালের সঙ্গে আরেক দেয়ালের টুকরো মিশে গিয়েছিল। এটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন জিগস পাজল।’

দেয়ালচিত্রে ফলমূল, ফুল, পাখি, ঝাড়বাতি ও তন্ত্রীযুক্ত বাদ্যযন্ত্রের ছবি দেখা যাচ্ছে, যেগুলো সেই সময়ের রোমান ধনিক শ্রেণির বাড়িতে খুবই জনপ্রিয় ছিল। এক টুকরোয় দেখা যায় কান্নারত এক নারীর মুখ, যার চুলের স্টাইল ফ্লেভিয়ান শাসনামলের (৬৯-৯৬ খ্রিষ্টাব্দ)।

যদিও এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যায়নি, ভিলাটি কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতো, তবে খননের অন্যান্য নিদর্শন দেখে প্রত্নতত্ত্ববিদরা বলছেন এটি ছিল এক ধনিক পাড়া। MOLA একে বলেছে, ‘রোমান ব্রিটেনের বেভারলি হিলস’।

প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, এসব দেয়ালচিত্র রোমান সাম্রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলের ডিজাইন অনুকরণ করে আঁকা হয়েছিল। কিছু টুকরোয় দেখা গেছে, এগুলোতে লাল রঙের মিশরীয় আগ্নেয়শিলা এবং আফ্রিকার হলুদ মার্বেলের শিরার অনুকরণ রয়েছে—যা মূলত রাজকীয় বা উচ্চবিত্তদের দেওয়াল টাইলসের ছাপ বহন করে। এ ধরনের শৈলী লন্ডিনিয়াম, কলচেস্টার, জার্মানি এবং পম্পেইয়েও দেখা গেছে।

একটি প্লাস্টারের টুকরোয় পাওয়া গেছে ‘ট্যাবুলা আনসাটা’ নামের এক ধরনের চৌকো খোদাই, যেখানে চিত্রশিল্পীরা নিজেদের নাম লেখার জায়গা রাখতেন। সেখানে লাতিন ভাষায় ‘FECIT’ লেখা আছে, যার অর্থ—‘এটি তৈরি করেছে’। তবে দুঃখজনকভাবে শিল্পীর নামসংবলিত অংশটি পাওয়া যায়নি।

আরেক জায়গায় গবেষকরা আবিষ্কার করেন গ্রীক বর্ণমালার একটি প্রায় পূর্ণাঙ্গ খোদাই, যেটি অত্যন্ত নিপুণভাবে লেখা হয়েছে। এটি রোমান ব্রিটেন থেকে পাওয়া একমাত্র উদাহরণ, যদিও একই ধরনের উদাহরণ ইতালিতে পাওয়া গেছে।

জায়গাটি বর্তমানে ‘দ্য লিবার্টি অব সাউথওয়ার্ক’ নামের একটি নতুন আবাসিক-ব্যবসায়িক প্রকল্পের উন্নয়নাধীন এলাকা। ২০২২ সালে এখান থেকেই আবিষ্কৃত হয় একটি দৃষ্টিনন্দন রোমান মোজাইক এবং ২০২৩ সালে খুঁজে পাওয়া যায় একটি বিরল রোমান সমাধি।

৪৩ খ্রিষ্টাব্দে রোমানদের ব্রিটেন আগ্রাসনের পর ‘লন্ডিনিয়াম’ নামে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন শহর, যার ভিত্তিতেই আজকের লন্ডন। রোমান শাসন ৪১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল।

দক্ষিণ লন্ডনের মাটির নিচে এত বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা এই বিস্ময়কর দেয়ালচিত্র এখন ইতিহাসের পাতায় নয়, উঠে এসেছে দৃশ্যমান বাস্তবতায়—একটি প্রাচীন শহরের শিল্প-সংস্কৃতিকে নতুন করে আবিষ্কারের বার্তা নিয়ে।

 

সূত্র: সিএনএন।

রাকিব

×