
.
প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বিদ্যুতের চাহিদা। বর্তমানে বিদ্যুৎ ছাড়া কোনো কিছু কল্পনাই করা যায় না। বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং আবিষ্কার ছিল মানব সভ্যতার এক অভূতপূর্ব সফলতা। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কত পদ্ধতিই না আবিষ্কৃত হয়েছে! কিন্তু এর মধ্যে অন্যতম আজব এবং মজার পদ্ধতি হলো বায়ুকল বা উইন্ডমিল। প্রথমে বাতাসের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন কৃষিকাজ করা হতো। আবিষ্কারের পর অনেক বছর পর্যন্তু উইন্ডমিল এসব কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে ১৮৫০ সালের দিকে এই একই ধরনের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জেনারেটর ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। আজকে আমরা জানব আজব এই বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে।
সাধারণত বায়ুপ্রবাহজনিত কারণে উৎপন্ন হয় গতিশক্তি। আর এই গতিশক্তিকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে যন্ত্র বা মেশিন ব্যবহার করা হয় তাকে বলা হয় উইন্ডমিল বা বায়ুকল। উইন্ডমিল সাধারণত বিভিন্ন ধরনের পাখা দ্বারা তৈরি করা হয়। এই পাখাগুলো উল্লম্ব বা আনুভূমিক যে কোনো ধরনের হতে পারে। তবে বাতাসের প্রবাহকে সহজেই কাজে লাগানোর জন্য আনুভূমিক পাখার উইন্ডমিল সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়। এ ধরনের পাখার সাহায্যে প্রবাহিত বায়ুশক্তিকে সহজেই কাজে লাগিয়ে জেনারেটর দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
বর্তমানে উইন্ডমিলের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলেও উইন্ডমিল আবিষ্কারের প্রথম পর্যায়ে এটা ব্যবহার হতো অন্য কাজে। প্রথম পর্যায়ে সাধারণত বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে যান্ত্রিকশক্তিতে রূপান্তরের মাধ্যমে পানি তোলা সেচকাজ, কাঠ কাটা এবং পাথর কাটার মতো কঠিন কাজগুলো করা হতো। বর্তমানে একইভাবে এই শক্তির মাধ্যমে জেনারেটর ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। যেসব উইন্ডমিল ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, সেগুলোকে বলা হয় এরোজেনারেটর।
মূলত পাহাড়ি এলাকা কিংবা সমুদ্রপাড়ে সবচেয়ে উইন্ডমিল বেশি দেখা যায়। কারণ, ঐ সমস্ত এলাকায় তুলনামূলকভাবে বায়ু প্রবাহের পরিমাণ বেশি থাকে। উইন্ডমিল পরিচালনার প্রথম শর্ত হলো, তীব্র বায়ুপ্রবাহ থাকতে হবে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, উইন্ডমিলের পাখা যতভাবেই তৈরি করা হোক না কেন, কখনোই শতভাগ বায়ুশক্তিকে কাজে লাগানো সম্ভব নয়। ১৯১৯ সালে জার্মান পদার্থবিদ আলবার্ট বেট্জ গবেষণা করে দেখেছেন যে, উইন্ডমিল ব্যবহার করে বায়ুশক্তির সর্বোচ্চ ৫৯.৩ শতাংশ ব্যবহার করা সম্ভব। কোনো স্থানে যদি বায়ুর গতিবেগ ঘণ্টায় ৭ থেকে ১০ মাইল হয়ে থাকে, তাহলে সেখানে উইন্ডমিল ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। বাতাসের প্রবাহ যখন টারবাইনগুলোর মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, তখন বাতাসের টানে যে লিফট তৈরি হয়, তাতেই এগুলো ঘুরতে থাকে।
সহজভাবে বলতে গেলে, বাতাস যখন টারবাইনের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, তখন বাতাসের ধাক্কার ফলে টারবাইন ঘুরতে থাকে। ওই টারবাইনের ব্লেডগুলোর সঙ্গে জেনারেটর রোটর সংযুক্ত থাকে। বাতাসের ধাক্কায় যখন টারবাইন ঘুরতে শুরু করে, তখন জেনারেটর ঘুরতে থাকে। আর এই জেনারেটর রোটর ঘূর্ণনের ফলে উৎপাদন হয় বিদ্যুৎ। এ টারবাইন বা পাখাগুলো সাধারণত একটি মিনার বা উঁচু টাওয়ারের ওপর স্থাপন করা হয়। যাতে করে বায়ুশক্তির প্রায় পুরোটাই কাজে লাগানো যায়। সাধারণত ভূপৃষ্ঠ থেকে যত বেশি উচ্চতায় উঠে যায়, বাতাসের প্রবাহ কিছুটা বাড়তে থাকে। কারণ, গাছপালার কারণে ওপরে বায়ু প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয় না। এজন্যই এ প্রক্রিয়ায় টারবাইন উঁচু স্থানে স্থাপন করা হয়।
উইন্ডমিলের সুবিধা হলো, কয়েকটি পরিবার কিংবা একটি গ্রামের জন্য একটি উইন্ডমিলই যথেষ্ট। এতে করে জাতীয় বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ওপর চাপ কমে। অন্যদিকে নিজের প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ নিজেই উৎপাদন করার মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংক্রান্ত খরচ কমিয়ে আনা যায়। যদিও প্রাথমিকভাবে উইন্ডমিল স্থাপন করতে মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হয়। উইন্ডমিল বা বায়ু টারবাইন সম্পূর্ণ নবায়নযোগ্য বৈদ্যুতিক উৎস। এতে করে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না। কারণ, বায়ুশক্তিকে কাজে লাগানোর কারণে এতে কোনো ধোঁয়া, গ্যাস বা কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হয় না। এজন্য পরিবেশের ভারসাম্যের ওপর কোনো প্রকার প্রভাব ফেলে না।
যেহেতু, পৃথিবীতে বায়ুপ্রবাহ থেমে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাই এই নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস শেষ হয়ে যাওয়ারও কোনো ভয় নেই। পৃথিবীতে তেল-গ্যাস কিংবা কয়লার মজুত সীমিত। যদি কখনও এগুলো শেষ হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের একমাত্র মাধ্যম হবে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার। তার মধ্যে বায়ু-বিদ্যুৎ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
উইন্ডমিলের প্রথম আবিষ্কার ঘটে ইসলামি স্বর্ণালি যুগে। সে সময় আধুনিক নগর ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কাজের পরিসরকে সহজ করে আনার দরকার ছিল। শুরু হয়ে যায় চিন্তা-ভাবনা। মুসলমানদের হাত ধরেই বিশ্বে সর্বপ্রথম উইন্ডমিলের আবিষ্কার ঘটে। পৃথিবীর প্রথম উইন্ডমিলটি ঘুরেছিল নবম শতাব্দীতে পূর্ব পারস্যে। ধারণা করা হয়, এরও আগে সিস্তানে ৬৪৪ সালে বায়ুকল আবিষ্কৃত হয়েছিল। তবে ৯১৫ সালের পারস্যের আবিষ্কৃত উইন্ডমিলকেই পৃথিবীর প্রথম উইন্ডমিল বলে বিবেচনা করা হয়। তখন অবশ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উইন্ডমিল ব্যবহার হতো না। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উইন্ডমিল রয়েছে ইউরোপে।
চার্লস ফ্রান্সিস ব্রুস নামক এক বিজ্ঞানী সর্বপ্রথম ১৮৮৮ সালে একটি বায়ু টারবাইন নির্মাণ করেন, যা একটি ব্যাটারির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জেনারেটরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ১৮৯১ সালে ডেনিশ পদার্থবিজ্ঞানী এবং উদ্ভাবক পল লা চউর প্রথম ‘বায়ুু ঘূর্ণনযন্ত্র’ পরীক্ষা করেন। ১৯০০ সালের কাছাকাছি তিনি বায়ুুচালিত বিদ্যুৎ প্লান্ট নির্মাণ শুরু করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন কয়লা এবং তেলের ব্যাপক সংকট দেখা দিল, তখন এফ এল স্মিথ নামক একটি কোম্পানি ৭০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক টারবাইন নির্মাণ করে। পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর এ প্রযুক্তি বিলীন হয়ে যায়। ১৯৭০ সালের দিকে ডেনমার্কে ১৫ মিটার উচ্চতায় প্রায় ২০ মিটার ব্যাসবিশিষ্ট টারবাইন সমৃদ্ধ ২,০০০ বায়ুচালিত জেনারেটর নির্মাণ করা হয়, যা প্রায় ২০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম ছিল।
১৮৫০ সালের দিকে পুরো নেদারল্যান্ডস জুড়ে প্রায় ১০ হাজার উইন্ডমিল নির্মাণ করা হয়েছিল। নেদারল্যান্ডস জুড়ে এখনও প্রায় ১ হাজার উইন্ডমিল রয়েছে। এগুলো যেমন পর্যটক আকৃষ্ট করছে, দর্শনার্থীদের মনোরঞ্জন করছে, তেমনি প্রায় সবটাতেই এখনও কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
বর্তমান বিশ্বে বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এগিয়ে রয়েছে চীন। চীন বর্তমানে ১৪৫ হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে, যা সে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ৩৩.৬ শতাংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ১৭.২ শতাংশ। এছাড়া স্পেন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ভারতসহ অনেক দেশ উইন্ডমিল কিংবা বায়ুকলের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এগিয়ে রয়েছে।
সমসাময়িককালে বায়ু শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার প্রয়াসে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক করছে, যা মূলত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে অনেকখানি বৃদ্ধি করেছে। যদিও ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকারের একটি চমৎকার উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার সর্বাধিক ৫টি স্থানে এক বছরব্যাপী বায়ুশক্তির সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, পরিশেষে এই পরিকল্পনাটির সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশে বায়ু প্রবাহের মাত্রার হিসেবে মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ হাতিয়ার মতো সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলসমূহ উয়িন্ডমিল টারবাইনের মাধ্যমে বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য বেশ উপযুক্ত। বায়ুশক্তির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি শক্তির একটি অফুরন্ত উৎস। প্রকৃতি তার অমোঘ বিধানে আমাদের বাতাস দিয়ে চলেছে অনন্তকাল ধরে। এর কোনো শেষ নেই। তাছাড়া আমাদের দেশ মূলত গ্যাস বিদ্যুত প্রকল্পের ওপর বেশি নির্ভরশীল। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে বিদ্যুত উৎপাদনের প্রায় ৮৬ শতাংশ জ্বালানি চাহিদা মেটানো হয় গ্যাস দিয়ে। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান। কেননা, গ্যাস হচ্ছে অনবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ। ফলে, যদি আমরা বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য বায়ুশক্তির বিকল্প উৎসের কথা না চিন্তা করি, তবে একটা সময় আমাদের বিরাট সমস্যার মুখে পতিত হতে হবে। তাছাড়া, বায়ুশক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ শক্তির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলসমূহে বসবাসরত মানুষের জীবনমানও উন্নত করা সম্ভব। এসব এলাকার মানুষের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মাধ্যম হলো মৎস্য আহরণ। কিন্তু মৎস্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় সুবিধা থাকার অভাবে তাদের কষ্টার্জিত মৎস্য অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়।
যদি উইন্ডমিল প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুত উৎপাদন করে উপকূলীয় মানুষদের দোরগোড়ায় বিদ্যুত পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়, তবে উপকূলীয় অঞ্চলের এ মানুষদের সমস্যা বহুলাংশে সমাধান করা সম্ভব। এটি শুধু উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন সাধন করবে না, বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে। বায়ু টারবাইন জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে বিরতিহীনভাবে। শহর বা শহরতলিতে অধিক ভোল্টেজ এবং ফ্রিকোয়েন্সির যথেষ্ট পরিমাণ বিদ্যুত উৎপাদন করা সম্ভব হবে। ছোট বায়ু টারবাইন গ্রিড সিস্টেম ছাড়া ব্যবহার করা হয় এবং চাহিদা অনুযায়ী বায়ু বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে পরিবর্তিত ব্যাটারি ব্যবহার করা যেতে পারে। এখানে বাতাসের গতি দ্বারা একটি বিদ্যুৎ উৎপাদিত বায়ুঘূর্ণনযন্ত্র আউটপুট ওয়াট উৎপাদিত হবে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনে সহায়তা করবে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ বোর্ড আশা করছে, ভবিষ্যতের দিনগুলোতে এই উইন্ডমিল আমাদের দেশের বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা পূরণে সহায়তা করবে। তাই এটি বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদার সম্ভাব্য সমাধান। বাংলাদেশ হয়ে উঠবে বিদ্যুতে স্বনির্ভর একটি উন্নত দেশ।