
নতুন সন্ধান পাওয়া লৌহ খনি খনন উদ্বোধন করা হচ্ছে
‘খনির জেলা’ হিসেবে পরিচিত দিনাজপুরে এবার তিনটি লোহার খনির সন্ধান মিলেছে। দেশের প্রথম লোহার খনির সন্ধান পাওয়া যায় হাকিমপুর উপজেলার ইসবপুর গ্রামে। এরপর চিরিরবন্দর উপজেলার কেশবপুর গ্রামে। সর্বশেষ পার্বতীপুর উপজেলার মোস্তাপুর গ্রামে। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর (জিএসবি) এসব খনির সন্ধান পেয়েছে।
জিএসবি জানিয়েছে, এই তিনটি খনিতে উন্নতমানের লোহার আকরিক (ম্যাগনেটাইট) রয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জিএসবির উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মাসুম। লোহার পাশাপাশি এসব খনিতে মূল্যবান কপার, নিকেল ও ক্রোমিয়ামেরও উপস্থিতি রয়েছে বলে জানান জিএসবি কর্মকর্তারা।
জিএসবির কর্মকর্তারা জানান, ভূগর্ভের ১ হাজার ৩০০ ফুট থেকে ১ হাজার ৬৫০ ফুটের মধ্যে হাকিমপুর উপজেলার ইসবপুর গ্রামে লোহার একটি স্তর পাওয়া গেছে। খনিটির আয়তন প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার। খনিতে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন টন লোহাসহ মূল্যবান পদার্থ রয়েছে। এটি বাংলাদেশের প্রথম লোহার খনি। উপজেলা সদর থেকে ১১ কিলোমিটার পূর্বে ইসবপুর গ্রাম। এই গ্রামের ৫০ শতক জমিতে খনিজ পদার্থের সন্ধানে কূপ খনন করেছে ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর।
খননকাজে নিয়োজিত জিএসবির কর্মকর্তারা বলেন, বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে লোহার খনির সন্ধান পাওয়া গেছে, সেগুলোর অধিকাংশে লোহার গুণগত মান ৫০ শতাংশের নিচে। তবে এই খনিতে লোহার মান ৬০ শতাংশের ওপর। জয়পুরহাট ও ঢাকায় জিএসবির পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
জিএসবির উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মাসুম বলেন, এর আগে ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর ২০১৩ সালে একই এলাকার মুশিদপুরে কূপ খনন করে খনিজ পদার্থের সন্ধান পেয়েছিল। সেই গবেষণার সূত্র ধরে ৬ বছর পর চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল থেকে ইসবপুরে কূপ খনন শুরু হয়। এর আগে জিএসবির মহাপরিচালক জিল্লুর রহমান চৌধুরীসহ উর্ধতন কয়েক কর্মকর্তা ইসবপুর পরিদর্শন করেন। লোহার খনি আবিষ্কার হতে চলেছে, এমন ইঙ্গিত ওই সময় মিলেছিল।
জিএসবির উপ-পরিচালক (ড্রিলিং ইঞ্জিনিয়ার) মাসুদ রানা বলেন, ইসবপুর গ্রামের খনন এলাকায় ৩০ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল তিন শিফটে কাজ করছে। দিনাজপুর-৬ আসনের এমপি শিবলী সাদিক বলেন, লোহার খনির পাশে নতুন করে দীঘিপাড়া কয়লাখনির কাজ চলছে। এসব খনি থেকে পুরোদমে উত্তোলন শুরু হলে উত্তরাঞ্চলসহ সারাদেশের মানুষের জীবনমান পাল্টে যাবে। কর্মসংস্থান হবে এখানকার মানুষের। দেশেরও লাভ হবে।
অপরদিকে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার পুনট্টি ইউনিয়নের কেশবপুরে আরও একটি লোহার খনির সন্ধান পাওয়া গেছে। পুনট্টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর-এ-কামাল জানান, বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের (ভূতত্ত্ব) পরিচালক আবদুল আজিজ পাটোয়ারী স্বাক্ষরিত দিনাজপুর জেলা প্রশাসককে দেয়া একটি চিঠির অনুলিপি তিনি পেয়েছেন। চিঠিতে কেশবপুর এলাকায় জিডিএইচ-৭৬/২১ কূপ খনন কার্যক্রমে বহিরাঙ্গনে অবস্থানকালীন সময়ে কর্মকর্তাদের আনুষঙ্গিক সহায়তা, নিরাপত্তা, তথ্য ও উপাত্ত সরবরাহ, যাতায়াত, পথ প্রদর্শন প্রদানে সহযোগিতা করার অনুরোধ করা হয়েছে।
এই চিঠি পুলিশ সুপার, চিরিরবন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, চিরিরবন্দর থানাকেও প্রদান করা হয়েছে। এরই মধ্যে খনন কার্যক্রমসহ যাবতীয় কাজে সহযোগিতার জন্য দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক, চিরিরবন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছে বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন শাখা।
এ বছরের ২ এপ্রিল এই লোহার খনির আনুষ্ঠানিকভাবে খনন কার্যক্রমের উদ্বোধন করে ভূতাত্বিক জরিপ অধিদফতর (জিএসবি)। কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন জিএসবির মহাপরিচালক (ডিজি, অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. মহঃ শের আলী। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, এই ড্রিলিংয়ের মাধ্যমে কেশবপুর গ্রামের মাটির নিচে লোহা ছাড়াও আর কী কী সম্পদ আছে তা দেখা হবে। আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার তথ্যগুলো সরকারকে সরবরাহ করব। পরে সরকার যাতে সেগুলো কাজে লাগাতে পারে।
‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার নতুন নতুন খনির আবিষ্কার’ উল্লেখ করে জিএসবির মহাপরিচালক বলেন, ‘বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর মুজিববর্ষে দেশের মানুষকে নতুন খনি উপহার দেয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে পাঁচটি কয়লা খনির সন্ধান আমরা পেয়েছি। খনিগুলোর কয়লা দিয়ে প্রায় ৫০ বছর পুরো বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এই বিপুল পরিমাণ সম্পদ মাটি থেকে উত্তোলন করতে গেলে দেশের বহু মানুষের জমি নষ্ট হবে। বর্তমান সরকার দেশের মানুষের কথা বিবেচনা করে বাইরে থেকে কয়লা আমদানি করছে।
হয়ত এক সময় মানুষের ক্ষতি হবে না, এমন প্রযুক্তি এলে তখন সরকার এই সম্পদ উত্তোলন করবে। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন চিরিরবন্দর উপজেলা চেয়ারম্যান তারিকুল ইসলাম তারিক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আয়েশা সিদ্দিকা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইসতিয়াক হাসান, পুনট্রি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ নুর-এ-কামাল।
চলতি বছরের ২৫ মার্চ দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলায় লোহার খনির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কূপ খনন কাজের উদ্বোধন করা হয়। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের উপ-মহাপরিচালক আব্দুল বাকী খান মজলিশ কূপ খনন কাজের উদ্বোধন করেন। ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের কর্মকর্তার দাবি, এই খনিতে লোহার কাঁচামাল আকরিকের পুরুত্ব অনেক বেশি।
তাই লোহার সঙ্গে তামাসহ অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ পাওয়ার আশা করছেন তারা। পার্বতীপুর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নের কুতুবপুর গ্রামে রাস্তার পাশে খনিটির অবস্থান চিহ্নিত করেছে ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর।
সরেজমিনে পার্বতীপুরের মোস্তফাপুর ইউনিয়নের কুতুবপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, দিনাজপুর-ফুলবাড়ি মহাসড়কের পাশে আমবাড়ি বাজারের রাস্তার পাশেই খনিটির অবস্থান। এরই মধ্যে ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর খনির অবস্থান চিহ্নিত করে, তা সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। খনন কাজের জন্য সেখানে কিছু লোহার পাইপ আনা হয়েছে। বসানো হয়েছে বড় বড় যন্ত্র।
সংরক্ষিত এলাকার ভেতরে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সেখানে কয়েকটি কূপ খনন করা হয়েছে। শ্রমিকদের থাকার জন্য তৈরি করা হয়েছে টিনের চালাঘর। খনির স্থানের জমির মালিক ইব্রাহীম আলী ম-ল বলেন, আমরা এলাকাবাসী খুবই খুশি। এটি চালু হলে এই এলাকার বেশ কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হবে। খনিটির প্রাথমিক জরিপ আমার ৬৬ শতাংশ জমি থেকেই শুরু হয়েছে। এ জন্য আমি খুব খুশি।
মোস্তফাপুর ইউপি চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান প্রামানিক বলেন, লোহার খনি পাওয়া গেলে এই এলাকার বেশ কিছু মানুষের কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা হবে। এলাকার মানুষের উন্নতি হবে। খনিকে কেন্দ্র করে এলাকায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। এটা আমাদের জন্য আনন্দের বিষয়।
খনিতে কাজ করতে যে শ্রমিক নেয়া হবে, বাইরে থেকে না এনে তা যেন স্থানীয় শ্রমিকদের নেয়া হয়। ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের পরিচালক আলী আকবর বলেন, নতুন খনিতে লোহার কাঁচামাল আকরিকের পুরুত্ব অনেক বেশি। তাই লোহার সঙ্গে তামাসহ অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ পাওয়ার আশা করছি। প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ নিয়ে এসেছি। আমাদের অনুসন্ধান শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিস্তারিত কিছু বলা যাচ্ছে না।
খনির কূপ খনন দলের প্রধান হিসেবে রয়েছেন ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (ড্রিলিং প্রকৌশলী) শহিরুল ইসলাম। ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালক আব্দুল বাকী খান মজলিশ বলেন, বাংলাদেশ খনিসমৃদ্ধ দেশ নয়, এদেশে খনিজ সম্পদের সম্ভাবনাও কম। সম্ভাবনা যাই থাকুক না কেন আমরা আশাবাদী থাকব। আমাদের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের কাজই হচ্ছে আশা ও সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করা। তাই এখন শুধু আমাদের সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। খনন কাজ শেষ করে আমরা বিস্তারিত বলতে পারব।
সাজেদুর রহমান শিলু, দিনাজপুর