ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৯ মে ২০২৫, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কোরবানির আগে চুল-নখ কাটায় নিষেধ: কেন এই বিধান, কীভাবে মানবেন শরিয়াহর নির্দেশনা?

প্রকাশিত: ০৭:৫৭, ২৭ মে ২০২৫; আপডেট: ০৭:৫৮, ২৭ মে ২০২৫

কোরবানির আগে চুল-নখ কাটায় নিষেধ: কেন এই বিধান, কীভাবে মানবেন শরিয়াহর নির্দেশনা?

ছবি: প্রতীকী

কোরবানির ঈদ মানেই ত্যাগ ও নিবেদনের এক মহামিলন। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের পূর্ণতা পেতে চাইলে কিছু শরিয়াহভিত্তিক নিয়ম-নির্দেশনা মেনে চলা জরুরি। তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলোযিনি কোরবানি দিতে চান, তাঁর জন্য জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনে চুল, নখ বা ত্বকের কোনো অংশ না কাটা।

বিশেষজ্ঞ আলেমরা বলছেন, এটি কোনো ফরজ বা ওয়াজিব নয়, বরং মুস্তাহাব (উত্তম ও পছন্দনীয় আমল)। এর মাধ্যমে কোরবানির গুরুত্ব ও আত্মত্যাগের আত্মিক চেতনা আরও গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়।

হাদিস কী বলে?

হজরত উম্মে সালামা (রা.)-এর বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা যদি জিলহজ মাসের চাঁদ দেখতে পাও এবং তোমাদের মধ্যে কেউ কোরবানি দেওয়ার নিয়ত করে, তবে সে যেন তার চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে।’ ((সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৯৭৭; মুসনাদে আহমাদ; হাদিস: ২৬,৬৬১)

মুসনাদে আহমাদের অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, ‘তার চুল বা ত্বকের কিছুই স্পর্শ করা উচিত নয়।

কে এই বিধানের আওতায়?

যে ব্যক্তি কোরবানি করবে না, তার জন্য এ হুকুম প্রযোজ্য কি নাএ ব্যাপারে কেউ কেউ বলেছেন, কোরবানি যারা করবে না, তাদের জন্যও এ আমল রয়েছে। আবদুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস (রা.)-এর বর্ণিত একটি হাদিসে আছে, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমাকে কোরবানির দিবসে ঈদ পালনের আদেশ করা হয়েছে, যা আল্লাহ এ উম্মতের জন্য নির্ধারণ করেছেন।’ এক সাহাবি বললেন, ‘আল্লাহর রাসুল, যদি আমার কাছে শুধু এমন একটি পশু থাকে যা দুধ পানের জন্য কাউকে দেওয়া হয়েছে, আমি কি তা কোরবানি করব?’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘না, তবে (দশ দিন পরে) তুমি চুল, নখ ও গোঁফ কাটবে এবং অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর দরবারে তোমার পূর্ণ কোরবানি বলে গণ্য হবে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ২,৭৮৯; সুনানে নাসাঈ, হাদিস: ৪,৩৬৫)

এই নিষেধ শুধু সেই ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য যিনি নিজে কোরবানি জবাই করবেন। যাদের পক্ষ থেকে কোরবানি দেওয়া হচ্ছে, যেমন পরিবারের সদস্য বা অন্য কেউ, তাদের ওপর এই নিষেধ প্রযোজ্য নয়। হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে কোরবানি দিতে চায়’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৯৭৭)। এখানে ‘যে কোরবানি দিতে চায়’ বলতে জবাইকারী ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে, যার পক্ষে কোরবানি দেওয়া হচ্ছে তাদের নয়। রাসুল (সা.) নিজে তাঁর পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে কোরবানি দিতেন, কিন্তু তাদের চুল বা নখ কাটা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, এমন কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। তাই কোরবানিকারীর পরিবারের সদস্যরা জিলহজের প্রথম দশ দিনে চুল, নখ বা ত্বক কাটতে পারেন।

না জানলে বা ভুলে কাটলে?

যদি কেউ এই বিধান না জেনে বা ভুল করে চুল-নখ কেটে ফেলেন, তবে তার কোরবানি বাতিল হবে না। আল্লাহর কাছে তওবা করাই যথেষ্ট। কোনো কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত) দিতে হবে না। শায়খ ইবনে বাজ (রহ.) বলেন, এতে কোরবানির বৈধতায় প্রভাব পড়ে না, বরং এটি সুন্নাহ পরিপালনের একটি বিষয়।

কেন এই বিধান?

এই নিষেধের পেছনে একটি গভীর তাৎপর্য রয়েছে। যে ব্যক্তি কোরবানি দেয়, সে হজের কিছু আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নেয়, যেমন কোরবানি করা হজের অংশ। এই সময়ে চুল-নখ কাটা থেকে বিরত থাকা ইহরামের কিছু বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, যা হজ পালনকারীরা মেনে থাকেন। এটি কোরবানিকারীর ইবাদতের প্রতি নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধার প্রকাশ।

তবে এই বিধান তখনই প্রযোজ্য হবে, যখন অবাঞ্ছিত পশম ও নখ না কাটার সময় ৪০ দিন থেকে বেশি না হয়। কেননা, হাদিসে আছে, আনাস (রা.) বলেন, গোঁফ কর্তন করা, নখ কাটা, বগল পরিষ্কার করা ও নাভির নিচের পশম পরিষ্কার করার বিষয়ে আমাদের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল যে আমরা যেন ৪০ দিনের বেশি বিলম্ব না করি। (সহিহ মুসলিম ১/১২৯; হাশিয়াতুত তাহতাবি আলালমারাকি ২৮৭; আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৯৬)

কখন থেকে চুল-নখ কাটা নিষেধ?

সুন্নাহ পালন করতে চাইলে জিলকদ মাসেই চুল-নখ কেটে জিলহজের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত। যাতে তা বেশি লম্বা হয়ে না যায়, যা সুন্নাত পরিপন্থী। আর যদি কেউ জিলহজের প্রথম ১০ দিনের মধ্যে কোনো দিন কোরবানি দেওয়ার নিয়ত করে, তবে নিয়ত করার মুহূর্ত থেকে তার চুল, নখ বা ত্বক কাটা থেকে বিরত থাকা উচিত। এই ঈদে আমরা যেন শরিয়াহর নির্দেশনা মেনে কোরবানি সম্পন্ন করি এবং ত্যাগের এই মহান ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করি।

 

 

 

রাকিব

×