
রমজান মাস ইসলামের একটি বিশেষ রহমতের সময়,যেখানে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের জন্য অশেষ সুযোগ করে দেন আত্মশুদ্ধি ও নৈকট্য লাভের। রাসুলুল্লাহ (সা.) হাদিসে বলেছেন:"রমজান এলে আকাশের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয়, আর শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়।" (সহিহ বুখারি: ১৮৯৯, সহিহ মুসলিম: ১০৭৯)।
এই হাদিসের ভিত্তিতে মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে, রমজান মাসে শয়তানকে বন্দি রাখা হয় এবং তার প্রভাব মানুষের ওপর কমে যায়। তবে সুফিগণ এই বিষয়টিকে শুধুমাত্র বাহ্যিকভাবে না দেখে গভীর আধ্যাত্মিক অর্থে ব্যাখ্যা করেন।
শয়তান এবং নফসের ভূমিকা নিয়ে বিস্তর আলোচনা রয়েছে। বাহ্যিক শয়তানের পাশাপাশি মানুষের অন্তরে লুকিয়ে থাকা প্রবৃত্তির (নফস) মাধ্যমেও মানুষ পাপের দিকে ধাবিত হয়। মুসলিম মণিষীগণ এই হাদিসের ব্যাখ্যায় এই দিকগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন:
শয়তান কি সত্যিই সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়?অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, "যদি শয়তানকে সত্যিই বেঁধে রাখা হয়, তাহলে কেন রমজানেও মানুষ পাপ করে?"
মুসলিম মনিষীগণ বলেন, শয়তানকে বন্দি করা মানে এই নয় যে, সে সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে যায়, বরং তার প্রভাব সীমিত হয়ে যায়। মানুষ যদি রোজা ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ফিরে আসে, তাহলে শয়তানের প্রবল প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া সহজ হয়। তবে যারা অভ্যাসগতভাবে পাপের পথে চলে, তারা নিজের অভ্যন্তরীণ প্রবৃত্তির (নফস) কারণে পাপে লিপ্ত থাকে।
ইমাম আল-গাজালি (রহ.) বলেন:"শয়তানের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো মানুষের প্রবৃত্তি (নফস)। সে মানুষের হৃদয়ে ওয়াসওয়াসা (কুমন্ত্রণা) দিতে থাকে। কিন্তু রোজার মাধ্যমে যখন নফস দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন শয়তানের কাজ করাটা কঠিন হয়ে যায়।" (ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, খণ্ড ৩)
এ থেকে বোঝা যায়, শয়তানকে বন্দি রাখা হলেও মানুষের নিজের প্রবৃত্তি তাকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে।
মুসলিম মনিষীগণ মনে করেন, মানুষের প্রবৃত্তি (নফস) ও শয়তানের মধ্যে গভীর সংযোগ রয়েছে। যদি শয়তান বাইরে থেকে মানুষকে প্ররোচিত করে, তাহলে নফস তাকে ভেতর থেকে প্রলুব্ধ করে।ইমাম ইবনু আতাআল্লাহ আস-সাকান্দারি (রহ.) বলেন:"তুমি যদি তোমার নফসের উপর বিজয়ী হতে পারো, তাহলে শয়তান তোমার ওপর শক্তি খাটাতে পারবে না।"
সুফি শেখ আব্দুল কাদের জিলানি (রহ.) বলেন:"রোজা হলো এমন একটি ঢাল, যা শয়তান ও নফসের ষড়যন্ত্র থেকে আত্মাকে মুক্ত রাখে। যখন তুমি ক্ষুধার্ত থাকো, তখন নফস দুর্বল হয়ে পড়ে, আর তখন শয়তানের ফাঁদ দুর্বল হয়ে যায়।" (আল-ফতহুর রব্বানি)রমজানে যখন মানুষ সারাদিন উপোস থাকে, তখন তার নফস ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে। ফলে শয়তান নিজের স্বাভাবিক ক্ষমতা হারায়, কারণ তার অন্যতম হাতিয়ার-নফস তখন দুর্বল।
রমজানে শয়তানের প্রভাব কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে মনিষীগণ বলেন:রোজা মানুষের আত্মাকে পবিত্র করে।রোজার মাধ্যমে আত্মাকে শুদ্ধ করা যায়, আর শয়তান শুধুমাত্র অপবিত্র আত্মার ওপরই কাজ করতে পারে।বেশি ইবাদত করলে শয়তানের শক্তি কমে যায়।রমজানে মানুষ বেশি কোরআন তিলাওয়াত করে, বেশি সালাত আদায় করে, বেশি জিকির করে। এতে আত্মিক আলো বৃদ্ধি পায়, যা শয়তানের জন্য বাধা সৃষ্টি করে।
রহমতের পরিবেশ সৃষ্টি হয়:রমজান মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়, রহমত ও নূরের আধিক্য ঘটে। এটি শয়তানের কাজের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করে।
তাহলে রমজানেও মানুষ পাপ কেন করে?মনিষীগণ বলেন, রমজানে পাপ করা আসলে শয়তানের কুমন্ত্রণা নয়, বরং নফসের দুর্বলতার কারণে ঘটে।মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী (রহ.) বলেন:"যদি তুমি রমজানে শয়তানের অনুপস্থিতিতেও পাপ করতে থাকো, তাহলে বুঝবে শয়তান শুধু বাহ্যিক দুশমন, কিন্তু তোমার নফস তোমার সবচেয়ে বড় দুশমন।" (মাসনভী-ই-মানভী)
তাই রমজান আমাদের জন্য সুযোগ, আমাদের নিজের নফসের দুর্বলতার বিরুদ্ধে জিহাদ করার, এবং সত্যিকারের আত্মশুদ্ধি অর্জন করার।
শয়তানকে পরাজিত করতে সুফিদের মতে, রমজানে শয়তানকে পরাজিত করতে হলে কিছু নির্দিষ্ট কাজ করা উচিত:রোজার মূল ভাবনা বুঝতে হবে।শুধু না খেয়ে থাকাই রোজা নয়, বরং অন্তরের সকল পাপ চিন্তা থেকেও বিরত থাকা রোজার আসল উদ্দেশ্য।
নফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে,নিজের প্রবৃত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ না আনতে পারলে শয়তানকে হারানো সম্ভব নয়।জিকির ও ইবাদত বাড়াতে হবে,আল্লাহর নাম বেশি করে নিলে শয়তানের প্রবেশের পথ সংকুচিত হয়ে যায়। অহংকার ও কৃপণতা থেকে মুক্ত থাকতে হবে।সুফিগণ বলেন, শয়তান অহংকার ও কৃপণতাকে ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে হিংসা ও হানাহানি ছড়ায়।
সুফিদের দৃষ্টিকোণ থেকে "শয়তানকে বেঁধে রাখা" মানে শুধুমাত্র বাহ্যিক শয়তানের নিষ্ক্রিয় হওয়া নয়, বরং এটি মানুষের আত্মশুদ্ধির একটি বিশেষ সময়। রমজানে আত্মিক উন্নতির ফলে শয়তানের প্রভাব কমে যায় এবং আল্লাহর রহমতের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। কিন্তু যারা তাদের নফসের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে না, তারা শয়তানের অনুপস্থিতিতেও পাপের দিকে ধাবিত হয়।
সুতরাং, রমজান আমাদের সুযোগ দেয় শুধু শয়তান থেকে বাঁচার নয়, বরং নিজেদের নফসকে শুদ্ধ করে প্রকৃত মুক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়ার। সুফিদের মতে, আসল জিহাদ বাহ্যিক শয়তানের বিরুদ্ধে নয়, বরং নিজের ভেতরের দুর্বলতা ও নফসের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে।
আফরোজা