ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৬ মে ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

‘আমাদের ম্যান্ডেলা মুহূর্ত’, সত্যিই কী নতুন পথে হাঁটছে বাংলাদেশ: জিল্লুর রহমান

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৬ মে ২০২৫; আপডেট: ০৫:৪১, ১৬ মে ২০২৫

‘আমাদের ম্যান্ডেলা মুহূর্ত’, সত্যিই কী নতুন পথে হাঁটছে বাংলাদেশ: জিল্লুর রহমান

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ কি এবার অতীতের অন্ধকার অধ্যায় পেরিয়ে নতুন এক আলোয় পথচলা শুরু করতে যাচ্ছে? এই প্রশ্ন সামনে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের এক সাহসী ঘোষণার পর। তিনি বলেছেন, দেশে একটি ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’—সত্য ও পুনর্মিলন কমিশন—গঠন করা হবে। লক্ষ্য একটাই—ভাষা, রাজনীতি ও বেদনায় বিভক্ত জাতিকে একটি জাতীয় ঐক্যের সূত্রে বাঁধা বলে মন্তব্য করেছেন সাংবাদিক জিল্লুর রহমান।

তিনি বলেন, এই ঘোষণা এসেছে এমন এক সময়, যখন রাজনৈতিক বাস্তবতা ক্ষতবিক্ষত, মানুষ আস্থাহীন, এবং বহু পরিবার আজও ‘গুম’ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিভীষিকায় জর্জরিত। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের সেই ‘ঘুমের রাজনীতি’ আজও অনেকের জীবনে তীব্র আতঙ্ক। কিন্তু যদি এই অন্ধকার থেকে সত্যিই আলোর দিকে যাত্রা শুরু হয়, তবে তা কেবল আইনি উদ্যোগ নয়, বরং এক নৈতিক বিপ্লব বলেই বিবেচিত হবে।


তিনি আরো বলেন, ঘোষণাটি এসেছে রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে আয়োজিত ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর খসড়া নিয়ে এক খোলামেলা মতবিনিময় সভা থেকে। সভায় শুধু সরকারি উপদেষ্টারাই ছিলেন না—ছিলেন অধিকারকর্মী, আইনজীবী, কবি-অ্যাক্টিভিস্ট, সমাজতাত্ত্বিকসহ নানা চিন্তাশীল মানুষ। আলোচনা যেমন সরাসরি ছিল, তেমনি সাহসীও। উঠে এসেছে বহু প্রশ্ন, সমালোচনা, কিন্তু একটিই নির্ভরযোগ্য সম্ভাবনা—জাতি যদি সত্যকে গ্রহণ করে, তবে পুনর্মিলনের দরজা খুলতে পারে।


তিনি বলেন, আলোচনায় কেউ কেউ স্পষ্ট করে বলেছেন—‘গুম’ কেবল আইনগত নয়, এটি একটি রাজনৈতিক ইস্যু। এর দায় রাষ্ট্রেরই। একজন আলোচক সতর্ক করে বলেন, যদি বাস্তবতা মোকাবেলায় ব্যর্থ হই, তাহলে বাংলাদেশ এক ভয়াবহ অস্থিতিশীলতার দিকে যেতে পারে। এমনকি এই অন্তর্বর্তী সরকার ভবিষ্যতে জনগণের আদালতের মুখোমুখি হতে পারে, যদি স্বচ্ছতা না থাকে।

তিনি জানান, এই প্রসঙ্গে উঠে আসে দক্ষিণ আফ্রিকার উদাহরণ। ১৯৯৪ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে সেদেশে গঠিত হয় ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন, যেখানে বর্ণবাদ-পরবর্তী নিপীড়নের স্মৃতিগুলো প্রকাশ করা হয়, অপরাধীরা ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পায় এবং পুনর্মিলনের পথ রচনা হয়। ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, “আমরা যদি প্রতিশোধ নিই, তাহলে আমরা শ্বেতাঙ্গদের থেকে ভালো হব কীভাবে?”

এই উচ্চতাই তাঁকে বিশ্বনেতায় পরিণত করে। বাংলাদেশ যদি সত্যিই সেই পথ অনুসরণ করে, তবে এটি হয়ে উঠবে এক যুগান্তকারী অধ্যায়।


তিনি আরো আলোচনা করেন, শুধু ঘোষণা নয়, বাস্তবায়নের পথও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গঠনের আগে দরকার নৈতিক স্বীকৃতি—রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বলা, “হ্যাঁ, অতীতে অন্যায় হয়েছে। আমরা সেটা স্বীকার করি।” এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক এবং নৈতিক; কেবল প্রশাসনিক নয়।

দ্বিতীয়ত, কমিশন হতে হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বচ্ছ। যদি এটি কেবল ‘দেখানোর জন্য’ হয়, তাহলে তার কোন অর্থ থাকবে না। তৃতীয়ত, জনগণকে যুক্ত করতে হবে। নিখোঁজদের পরিবারের কথা শুনতে হবে, তাদের মানসিক সহায়তা দিতে হবে, পুনর্বাসনের পথ তৈরি করতে হবে। একজন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট যেমন প্রস্তাব দিয়েছেন, অধ্যাদেশের নাম হওয়া উচিত—“গুম প্রতিরোধ, প্রতিকার ও সুরক্ষা আইন।”


আরো জানান, কমিশনের কাজ বাস্তব ও অর্থবহ করতে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা গ্রহণ জরুরি। দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়াও চিলি, রুয়ান্ডা ও সিয়েরা লিওন–এইসব দেশে ট্রুথ কমিশনের মাধ্যমে নিপীড়নের ইতিহাস উন্মোচন ও পুনর্মিলন সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল শিগগিরই দক্ষিণ আফ্রিকায় যাবে ট্রুথ কমিশনের কাঠামো ও প্রক্রিয়া বোঝার জন্য, যেখানে থাকবেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এটি প্রমাণ করে—এই উদ্যোগ কেবল একদিনের কৌশল নয়, বরং রাষ্ট্র সংস্কারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ। তবে আশঙ্কাও রয়ে গেছে। কারণ গুম ও নিখোঁজের পেছনে যাঁদের সম্পৃক্ততা ছিল, তাঁদের অনেকেই এখনও ক্ষমতার ভেতরে। একজন আলোচক সতর্ক করেছেন, এখন যদি সত্যিকারের বিচার শুরু হয়, তাহলে সরকার টিকবে না। যদিও লেখকের মতে, জনগণের সমর্থন পেলে এবং সরকারের কোনো গোপন এজেন্ডা না থাকলে, জনগণ বিচারের পক্ষেই থাকবে।

তিনি আরো বলেন, আলোচনায় একজন উপদেষ্টা বলেছেন, ফাঁসির বিধান থাকলে অনেক বিচারক পিছিয়ে যান। তাই ন্যায়সংগত ও দ্রুত বিচারের জন্য যাবজ্জীবনই যথেষ্ট। আরেকজন চান আইনে ‘ব্যক্তি’ নয় ‘শৃঙ্খলাবাহিনী’ শব্দটি থাকুক, যাতে দায় গোষ্ঠীগতভাবে চিহ্নিত হয়।

সবশেষে প্রশ্ন—এই উদ্যোগ কি সফল হবে? উত্তর নির্ভর করছে নেতৃত্বের সদিচ্ছা, জনগণের প্রত্যাশা ও রাজনৈতিক পরিপক্বতার ওপর। ইতিহাস বলে, সত্যকে চিরকাল চাপা দিয়ে রাখা যায় না। ক্ষমা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না—তা অর্জিত হয় সাহস ও সম্মানের মাধ্যমে।

নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯৪ সালে তাঁর শপথ ভাষণে বলেছিলেন— এখন আমাদের ক্ষত সারানোর সময়, বিভক্তির খাদ ভরাট করার সময়, এখন আমাদের ঘর বাঁধার সময়।

বাংলাদেশ যদি সত্যিই এই পথে হাঁটে, তাহলে এই মুহূর্তটি আমাদের ‘ম্যান্ডেলা মুহূর্ত’ হয়ে উঠতে পারে।

এসএফ 

আরো পড়ুন  

×