ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২

বিচিত্র চাপে বিপর্যস্ত ঢাকা

ড. আলা উদ্দিন

প্রকাশিত: ১৮:০৬, ২৭ জুলাই ২০২৫

বিচিত্র চাপে বিপর্যস্ত ঢাকা

ঢাকা, বাংলাদেশের রাজধানী, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়নের এক চরম দৃষ্টান্ত হিসেবে দৃষ্টিগোচর। দুই কোটির বেশি মানুষের বসবাসে শহরটি এক বিশৃঙ্খল কুকারে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রতিদিনের জীবন যুদ্ধ যেন অসহনীয় হয়ে উঠছে। প্রতিটি সকাল শুরু হয় যানজট, ধূলি-দূষণ, অপ্রতুল গণপরিবহন এবং নাগরিক সেবার চরম অভাব নিয়ে। নগরীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অপ্রতুল রাস্তাঘাট, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গলদ এবং অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থার ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েই চলেছে। রাজধানীজুড়ে প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ঘটে যাচ্ছে দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, অথবা অপরাধের ঘটনা- যা নাগরিক নিরাপত্তার ঘাটতি নির্দেশ করে। গত সপ্তাহে আবাসিক এলাকার মধ্যে একটি স্কুলের ওপর মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনা এর সাম্প্রতিক শোকাবহ উদাহরণ।  
ঢাকার অনিয়ন্ত্রিত সম্প্রসারণ আশপাশের কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ এলাকাগুলোকে গ্রাস করে ফেলছে। ভূমি দখল, জলাধার ভরাট এবং অপরিকল্পিত শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠার ফলে পরিবেশগত ভারসাম্য মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। জনসংখ্যার চাপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আবাসন সংকট, ট্রাফিক জট, বিদ্যুৎ ও পানির ঘাটতি এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার ওপর চাপ। শহরটি যেন এক দানবীয় কংক্রিটের জঙ্গল, যেখানে মানবিকতা, সামাজিক সম্পর্ক ও বাসযোগ্যতার ধারণা প্রতিনিয়ত সংকুচিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি শুধু নাগরিক দুর্ভোগই নয়, জাতীয় অর্থনীতি ও পরিবেশের জন্যও এক গুরুতর হুমকি। তাই ঢাকার উন্নয়নে এখনই একটি দীর্ঘমেয়াদি, পরিবেশসম্মত ও জনকেন্দ্রিক পরিকল্পনা প্রয়োজন, যা নগরটিকে টেকসই ও বাসযোগ্য করে গড়ে তুলবে।
ঢাকায় প্রতিবছর শত শত মানুষ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন- রাস্তাঘাটে ট্রাফিক দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, ভবন ধসে পড়া কিংবা নির্মাণ সাইটে নিরাপত্তাহীন পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে। এই মৃত্যুগুলো কেবল পরিসংখ্যান নয়, প্রতিটি পরিবারে শোক, অসহায়ত্ব ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির গল্প। সংকীর্ণ ও অপরিকল্পিত রাস্তা, এলোমেলোভাবে গড়ে ওঠা ভবন, এবং অনিয়ন্ত্রিত যান চলাচলের কারণে জরুরি সেবা যেমন ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স কিংবা পুলিশ সময়মতো দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারে না। অনেক পুরানো এলাকায় অ্যাম্বুলেন্স ঢোকার মতো পর্যাপ্ত জায়গাই নেই, ফলে অসুস্থ রোগীও সময়মতো চিকিৎসা পায় না।
রাস্তাগুলোতে বাস, ট্রাক, সিএনজি, রিকশা, প্রাইভেট গাড়ি ও মোটরসাইকেলের অসহনীয় ভিড় শুধু যানজটই সৃষ্টি করছে না, বরং প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়ায় পথচারীরা সড়কে হাঁটতে বাধ্য হয়, ফলে দুর্ঘটনার হার বেড়ে চলেছে। নির্মাণসাইটে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকায় শ্রমিকদের জীবনে সর্বদা ঝুঁকি লেগে থাকে। অনেক সময় নির্মাণাধীন ভবন বা ক্রেন থেকে পড়ে গিয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে। ঢাকার এই অনিরাপদ নগর বাস্তবতা উন্নয়নের নামে মানুষের জীবনের মূল্যকে অবহেলা করারই প্রমাণ। পরিকল্পিত নগরায়ন ও নিরাপত্তা নীতির বাস্তবায়ন ছাড়া এই মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হবে না। এই অব্যবস্থাপনার জন্য নাগরিক জীবনের মূল্য চূড়ান্তভাবে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
বায়ু দূষণে বিশ্বের শীর্ষ শহরগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা। যানবাহন, ইটভাটা, নির্মাণ কার্যক্রম ও কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া ও ধুলাবালি ফুসফুসে জমে গিয়ে শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা সৃষ্টি করে। শব্দ দূষণ বাড়ায় মানসিক চাপ, ঘুমের ব্যাঘাত ও শ্রবণ সমস্যা। অপর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও শিল্পবর্জ্যে দূষিত পানিতে জলবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। শহরের তাপমাত্রাও আশপাশের অঞ্চলগুলোর তুলনায় বেশি, যা নগর তাপদ্বীপ (ঁৎনধহ যবধঃ রংষধহফ) পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। শীতলীকরণের সুযোগ না থাকায় গরমকাল আরও প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে, বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য।
বাংলাদেশের প্রায় সব প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো ঢাকাকেন্দ্রিকভাবে গড়ে উঠেছে, যা একদিকে যেমন রাজধানীর গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, অন্যদিকে তেমনি বৈষম্য ও অসম উন্নয়নের শিকড়ও গেঁথে দিয়েছে। রাষ্ট্রপতির বাসভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় সংসদ ভবন, সর্বোচ্চ আদালত, প্রধান মন্ত্রণালয়সমূহ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বৃহৎ হাসপাতাল ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর- সবকিছুই ঢাকায় কেন্দ্রীভূত। ফলে দেশের প্রতিটি জেলা থেকে শিক্ষার্থী, চাকরিপ্রার্থী, ব্যবসায়ী, চিকিৎসা-প্রত্যাশী, এমনকি সাংস্কৃতিক কর্মীরাও বাধ্য হচ্ছেন রাজধানীমুখী হতে। এই অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত অবকাঠামো ঢাকায় জনসংখ্যার ভার অতিরিক্ত করে তুলছে, নাগরিক সেবার ওপর অচিন্তনীয় চাপ সৃষ্টি করছে, এবং বসবাসকে করে তুলছে দুর্বিষহ।
ঢাকাকেন্দ্রিক এই উন্নয়ন মডেল দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম, বরিশাল বা রংপুরের মতো এলাকাগুলো অবহেলিত থেকে যাচ্ছে, যেখানে আলাদা করে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিশাল সুযোগ রয়েছে। আরও ভয়াবহ দিক হলো, এই এককেন্দ্রিকতা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। ঢাকায় কোনো বড় দুর্যোগ বা সন্ত্রাসী হামলা হলে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র অচল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই টেকসই উন্নয়নের জন্য ঢাকাকেন্দ্রিকতা কমিয়ে বিকেন্দ্রীকরণমূলক নীতি গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
ঢাকাই দেশের প্রধান অর্থনৈতিক চুম্বক। গার্মেন্টস শিল্প, করপোরেট অফিস, ব্যাংক, বীমা, আন্তর্জাতিক সংস্থা, দূতাবাস- সব ঢাকায় কেন্দ্রীভূত। গ্রামীণ নারীরা পোশাক কারখানায় কাজ করতে ঢাকায় আসে, আর অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন লাখো দিনমজুর, রিকশাচালক, হকার ও ছোট ব্যবসায়ী। এই অর্থনৈতিক কেন্দ্রিকতা ঢাকায় আয় এবং জীবিকার সুযোগ তৈরি করলেও শহরের কাঠামোকে অতিমাত্রায় চাপের মুখে ফেলেছে। অন্যদিকে, ঢাকার বাইরের অর্থনীতি থেকে জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে, যা আরও জনস্রোতকে ঢাকার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
চরম কেন্দ্রীভূত ঢাকার কেন্দ্রীয় চরিত্র এমন যে এই রাজধানী শহরে প্রতিদিন সারা দেশের লাখো মানুষকে যাতায়াত করতে হয়। তবে গণপরিবহন ব্যবস্থা নিরাপদ বা পর্যাপ্ত নয়। বাসগুলোতে অতিরিক্ত ভিড়, দুর্ঘটনার আশঙ্কা ও দেরি- সব মিলিয়ে মানুষের যাতায়াত এক বিভীষিকায় পরিণত হয়েছে। ফলে অনেকে প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার করেন, যা যানজট আরও বাড়িয়ে তোলে। ট্রেন ও লঞ্চ সার্ভিস অপ্রতুল ও অনিয়মিত। পিক আওয়ারে ঢাকা প্রবেশ বা বের হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই যাত্রীদের জন্য শহরের পানি, স্যানিটেশন, সড়ক ও স্বাস্থ্যসেবার ওপর আলাদা চাপ তৈরি হয়।
ঢাকার অতিচাপ শুধু নগর ব্যবস্থাপনাকে নয়, জাতীয় অর্থনীতিকেও দুর্বল করছে। যানজট ও বিলম্বিত কার্যক্রমে উৎপাদনশীল সময় হারিয়ে যাচ্ছে, যার আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হাজার কোটি টাকা। গ্রামীণ এলাকা থেকে শিক্ষিত জনশক্তি ঢাকায় চলে আসছে, ফলে স্থানীয় উন্নয়ন থমকে যাচ্ছে। তীব্র পরিবেশ দূষণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, মানসিক চাপ ও অসুস্থতা। এককেন্দ্রীকতার কারণে দেশের সামাজিক ভারসাম্য ও পরিবার কাঠামো দুর্বল হচ্ছে। অব্যবস্থাপনা দীর্ঘস্থায়ী হলে এটি একটি জাতীয় সংকটে পরিণত হতে পারে।
ঢাকার সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ে সুস্পষ্ট বিকেন্দ্রীকরণ নীতি। প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে হবে। চট্টগ্রাম হতে পারে বিকল্প প্রশাসনিক কেন্দ্র, যেখানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় স্থানান্তর করা যায়। রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটকে আঞ্চলিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ঢাকার বাইরে স্থাপন করলে শিক্ষার্থীদের ঢাকামুখী হওয়া কমবে। একইভাবে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ঢাকার বাইরে বিস্তৃত করতে হবে।
স্মার্ট সিটি উদ্যোগের মাধ্যমে ডিজিটাল সেবা নিশ্চিত করলে মানুষকে ঢাকায় এসে কাজ করতে হবে না। ই-গভর্ন্যান্স, অনলাইন শিক্ষা ও টেলিমেডিসিনের সম্প্রসারণ গুরুত্বপূর্ণ। শহর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে জোনিং আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, সবুজ স্থাপত্যের প্রণোদনা ও পরিবেশ রক্ষার জন্য কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। গণপরিবহনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং নৌ ও রেল যোগাযোগ উন্নয়নের মাধ্যমেও চাপ হ্রাস করা সম্ভব।
ঢাকার বাইরে শিল্পাঞ্চল, আইটি পার্ক, এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে হবে। এগুলোর সঙ্গে কর ছাড়, অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রণোদনা দিতে হবে। ঢাকায় নতুন শিল্প স্থাপনে নিরুৎসাহ প্রদান এবং বিকল্প শহরে তা স্থানান্তর করাই হতে পারে সঠিক পথ। সরকারি প্রকল্পগুলোতে আঞ্চলিক ভারসাম্যকে গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে ঢাকামুখী প্রবণতা কমে।
দক্ষিণ কোরিয়া তাদের প্রশাসনিক কেন্দ্র সিউল থেকে সেজং-এ স্থানান্তর করেছে। ব্রাজিল ব্রাসিলিয়া গড়ে তুলেছে নতুন রাজধানী হিসেবে। নাইজেরিয়া ও তুরস্কও সফলভাবে বিকেন্দ্রীকরণ করেছে। বাংলাদেশকেও একই কৌশল নিতে হবে। নতুন রাজধানী তৈরি না করেও প্রশাসনিক কার্যক্রম দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।
ঢাকার অতিচাপ রোধে এখনই সময় জাতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার। বিকেন্দ্রীকরণ কেবল ঢাকার সমস্যা সমাধান নয়, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। একটি সময়সূচিভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দপ্তর ও সামরিক স্থাপনা স্থানান্তর করতে হবে। ঢাকার বাইরে উচ্চমানের শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। নাগরিকদের সুযোগ ও নিরাপত্তা সমানভাবে বিতরণ না করলে ঢাকাকে একদিন অচল শহর হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে- অন্যথায় একটি শহরের অতিভারে পুরো জাতি নুয়ে পড়বে।
 লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানেল/মো.

×