ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২

প্রযুক্তির হাতে বন্দি শৈশব

মো. শামীম মিয়া

প্রকাশিত: ১৮:২৪, ২৭ জুলাই ২০২৫

প্রযুক্তির হাতে বন্দি শৈশব

স্মার্টফোন নিঃসন্দেহে প্রযুক্তির চমৎকার সৃষ্টি। তথ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ-সব কিছুই এতে হাতের মুঠোয়। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় যখন এটি বয়স, সময় ও পরিবেশ বিবেচনা না করে ব্যবহৃত হয়। শিশুরা হাঁটতে শেখার আগেই স্ক্রিনে অভ্যস্ত হচ্ছে, প্রকৃতি দেখা বা খেলাধুলার চেয়ে তারা বেশি সময় কাটাচ্ছে ভার্চুয়াল দুনিয়ায়। কল্পনার বদলে রঙিন কার্টুন, গল্পের বদলে ইউটিউবের ভিডিও- এই পরিবর্তন যেন আমাদের সামাজিক কাঠামোকেই কাঁপিয়ে তুলছে। 
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ২০২০ সালে জানায়, ২ বছরের নিচে শিশুদের স্ক্রিন একেবারেই নিষিদ্ধ, আর ২৫ বছরের মধ্যে দিনে সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা স্ক্রিন টাইম গ্রহণযোগ্য। Academy of Pediatrics বলছে, স্ক্রিন ব্যবহার হলেও তা যেন মানসম্মত ও অভিভাবকের উপস্থিতিতে হয়। কিন্তু বাস্তবতা কী বলছে? বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিশুরা প্রতিদিন গড়ে ৩-৫ ঘণ্টা মোবাইল স্ক্রিনে কাটায়, যা শিশুদের মানসিক, স্নায়বিক ও সামাজিক বিকাশে মারাত্মক বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। 
চোখের আলো নিভে যাচ্ছে অজান্তেই : স্মার্টফোনের সবচেয়ে প্রাথমিক ও দৃশ্যমান ক্ষতি হয় চোখে। Vision Council of America জানায়- ৮ বছরের নিচে শিশুদের প্রায় ৭০ শতাংশ দৈনিক ২ ঘণ্টার বেশি স্ক্রিন দেখে, ফলে ড্রাই আই, চোখের ক্লান্তি, মায়োপিয়া, এমনকি স্থায়ী চোখের ক্ষতির ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। বাংলাদেশেও শহুরে শিশুদের মধ্যে চোখের সমস্যা এবং চশমার ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলেছে। যারা খেলাধুলার মাঠে থাকার কথা, তারা চশমা পরে ঘরে বসে অনলাইন গেম খেলছে। 
মস্তিষ্কে কল্পনার বদলে কোডের ঘোর : শূন্য থেকে ৬ বছর বয়স শিশুর মস্তিষ্কের সবচেয়ে দ্রুত বিকাশের সময়। এই সময় শিশুকে গল্প শোনানো, খেলতে দেওয়া, প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত করা- এসবই আবশ্যক। অথচ এখন শিশুরা বসে থাকে পর্দার সামনে।
Harvard Medical School-এর ২০১৯ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম শিশুদের মস্তিষ্কের কর্টেক্স স্তরকে পাতলা করে দেয়, যা মনোযোগ ও ভাষাগত দক্ষতা হ্রাস করে (Journal of the American Medical Association- Pediatrics)।
National Institutes of Health (NIH) পরিচালিত ৪৫০০ শিশুর ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় (২০১৮) দেখা গেছে, দিনে ২ ঘণ্টার বেশি স্ক্রিন টাইম শিশুদের ভাষা বিকাশে দেরি ঘটায় এবং মানসিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত করে। 
শিশুদের আচরণে প্রযুক্তির বিষক্রিয়া : শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, এখনকার শিশুরা আগের মতো মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না, ক্লাসে সহজে বিরক্ত হয়, সহপাঠীদের সঙ্গে খেলায় ঝগড়া করে, খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ কমে গেছে। মোবাইল ছাড়া তারা যেন কিছুতেই স্বস্তি খুঁজে পায় না।
Journal of Behavioral Addictions (২০১৯) এ প্রকাশিত এক সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতি ৪ জন শিশুর মধ্যে ১ জন মোবাইল আসক্তির লক্ষণ দেখায়- যেমন বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্নতা, বিরক্তি, অস্থিরতা ও সংবেদনশীল আচরণ। 
শহর কিংবা গ্রাম কোথাও রেহাই নেই : শুধু শহরেই নয়, এখন গ্রামেও মোবাইল আসক্তি বাড়ছে। মাঠে খেলার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শিশুরা ঘরে বসে গেম খেলছে, ইউটিউব দেখছে। অভিভাবকরা সময়ের অভাবে কিংবা কৌশলের অভাবে মোবাইল দিয়ে শান্ত করছেন শিশুদের। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (BTRC) অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে প্রায় ৮ কোটি স্মার্টফোন ব্যবহারকারী রয়েছে এবং এর মধ্যে প্রায় ২ কোটির বেশি শিশু-কিশোর এই যন্ত্র ব্যবহার করছে। 
বিশ্বজুড়ে সতর্কতা ও প্রতিরোধ : World Economic Forum তাদের ২০২৩ সালের বার্ষিক Global Risks Report: এ শিশুদের ডিজিটাল আসক্তিকে ভবিষ্যতের অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছে: By 2030, digital addiction will be one of the top five global childhood disorders if current trends continue. (WEF Report 2023, Page 41)
সফল দেশগুলো ইতোমধ্যে 
উদ্যোগ নিয়েছে
ফ্রান্স: ১৫ বছরের নিচে স্কুলে মোবাইল নিষিদ্ধ, চীন: TikTok–এর শিশু ভার্সনে দিনে মাত্র ৪০ মিনিট সীমা, ফিনল্যান্ড: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোবাইল পুরোপুরি নিষিদ্ধ, জাপান: ডিজিটাল কারফিউ। অথচ বাংলাদেশে এখনো জাতীয় পর্যায়ে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা নেই। এ ক্ষেত্রে জরুরি রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক হস্তক্ষেপ।
করণীয়
ঘর থেকেই শুরু হোক মুক্তি। নিজে মোবাইল আসক্তি কমিয়ে শিশুর সামনে ভালো উদাহরণ তৈরি করা, ‘নো ফোন জোন’ চালু (খাবার টেবিল, শোবার ঘর) শিশুর হাতে গল্পের বই, রঙিন খাতা, খেলনা তুলে দেওয়া, প্রতি সপ্তাহে একদিন ‘ডিজিটাল ডিটক্স ডে’ পালন, প্রকৃতির কাছে নিয়ে যাওয়া, গল্প শোনানো, পরিবারে সময় দেওয়া ইত্যাদি করা যেতে পারে। প্রাক-প্রাথমিক স্তরে ‘ডিজিটাল স্বাস্থ্য শিক্ষা’ চালু, স্কুলে ‘স্ক্রিন হেলথ ক্লাস’ বাধ্যতামূলক করা, পিতা-মাতাদের জন্য সচেতনতামূলক সেমিনার, জাতীয় প্রচারণায় মোবাইল আসক্তির ক্ষতি প্রচার করা, প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি এর অপব্যবহারের বিপদ নিয়ে শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে। আমরা যদি না বদলাই, তাহলে একদিন দেখব- আমাদের সন্তানেরা কল্পনা হারিয়েছে, মনোযোগ হারিয়েছে, চোখের আলোও হারিয়ে ফেলেছে। 
এই প্রযুক্তির যুগ সমস্যা নয়, আসল সমস্যা আমাদের নিয়ন্ত্রণহীনতা। প্রযুক্তিকে দোষ না দিয়ে আমাদের পরিবার, শিক্ষা ও রাষ্ট্রীয় মনোভাব বদলাতে হবে। আজই সিদ্ধান্ত নিতে হবে- আমরা আমাদের সন্তানের হাতে স্মার্টফোন দেব, নাকি সুন্দর ভবিষ্যতের চাবিকাঠি? প্রযুক্তি নয়, উদাসীনতাই আমাদের আসল শত্রু। তাই এখনই সময় শিশুর হাতে মোবাইল নয়- ভালোবাসা, সময়, গল্প আর কল্পনার ডানা তুলে দেওয়ার।
লেখক : সমাজকর্মী 

প্যানেল/মো.

×