ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের হাতে মোটরসাইকেলের চাবি তুলে দিচ্ছেন, নাকি মৃত্যুর চাবি?

শেখ ফয়সাল আহমেদ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ০১:৩৬, ১৫ জুন ২০২৫; আপডেট: ০১:৪০, ১৫ জুন ২০২৫

অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের হাতে মোটরসাইকেলের চাবি তুলে দিচ্ছেন, নাকি মৃত্যুর চাবি?

ছবি: সংগৃহীত

প্রত্যেক বাবা-মার জীবনের সকল স্বপ্নই আবর্তিত হয় তাদের সন্তানকে ঘিরে। সন্তানের দাবি-আবদার মেটাতে তাঁরা নিজেদের সুখ-সাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে হাসি ফোটাতে চান আদরের মুখে। কিন্তু অনেক বাবা-মা অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর, স্কুল-কলেজ পড়ুয়া সন্তানের শখ পূরণে হাতে তুলে দিচ্ছেন মোটরসাইকেলের চাবি—অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণহীন হাতে সেই চাবিই কি মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে উঠছে না?

◼ বাস্তব কিছু কাহিনি, কিছু কান্না
গত বছর রাজধানীর মিরপুরে ইউনুস মোল্লা তাঁর ১৬ বছর বয়সী একমাত্র ছেলের শখ পূরণে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে মোটরসাইকেল কিনে দেন। কয়েকদিন পর রাতের বেলায় বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে গিয়ে কুড়িল ফ্লাইওভারে রেসিং করার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় সিয়াম। আজও পরিবার শোকে কাতর, আফসোস একটাই—“ছেলেকে মোটরসাইকেল কিনে না দিলে সে আজ বেঁচে থাকত।”

শেওড়াপাড়ার গনি সাহেব এইচএসসিতে ‘এ প্লাস’ পাওয়া ছেলের শখ পূরণে মোটরসাইকেল কিনে দেন। কিন্তু ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে ঘুরতে গিয়ে দুর্ঘটনায় ছেলের প্রাণ চলে যায়।

শাহ আলীবাগের সিএনজি চালক সাগর মিয়া একমাত্র ছেলে নাহিদের শখ পূরণে এনজিও ঋণ ও জমানো টাকা দিয়ে মোটরসাইকেল কিনে দেন। নাহিদ সাভার-আশুলিয়া মহাসড়কে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। কাঁদতে কাঁদতে সাগর মিয়া বলেন, “পোলাডারে হুন্ডা কিনা না দিলে বাইচা থাকত। আমি নিজেই পোলাডারে মাইরা ফালাইছি।”

যাত্রাবাড়ীর রাসেল ঢামেকে চিকিৎসাধীন, দুর্ঘটনায় এক পা হারিয়েছেন। গৌরনদীর আক্কেল আলীর ছেলে অসীম পা হারিয়েছেন, একটি হাতও অকেজো হয়ে গেছে। পাশে থাকা মা-বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমরা মরে গেলে ওকে দেখবে কে?”

◼ কী বলছে পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা
রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি সড়কে প্রতিনিয়ত ঘটছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। অধিকাংশ চালকই অপ্রাপ্তবয়স্ক, নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স, নেই প্রশিক্ষণ, অনেকে হেলমেটও পরে না। হাইওয়েতে একে অপরকে টেক্কা দিতে গিয়ে ঘটছে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। এছাড়া অনেক কিশোরই এই মোটরসাইকেল ব্যবহার করে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-এর এক কর্মকর্তা বলেন, অধিকাংশ দুর্ঘটনার কারণ—ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকা, ট্রাফিক আইন না মানা এবং গভীর রাতে বেপরোয়া চালনা। তিনি বলেন, “মোটরসাইকেল কেনার আগে সন্তানের বয়স, লাইসেন্স, ট্রেনিং ও আইন মানার মানসিকতা থাকতে হবে। না হলে সন্তানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়।”

◼ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না হয়ে থাকে। তাই প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত সন্তানের হাতে মোটরসাইকেল তুলে দেওয়া উচিত নয়। আগে তাকে চালনার প্রশিক্ষণ দিন, ড্রাইভিং লাইসেন্স সংগ্রহ করতে উৎসাহ দিন, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সচেতন করুন।

◼ আমাদের করণীয় কী?
পরিবারে ও সমাজে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

হেলমেট বাধ্যতামূলক করতে হবে—এটি আপনার সন্তানের জীবনের নিরাপত্তা।

সরকারকে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং জরিমানার পরিমাণ বাড়াতে হবে।

◼ মনে রাখবেন—
আপনার সন্তান আপনার প্রাণ, আপনার সব স্বপ্ন। তাকে অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় মোটরসাইকেল দিয়ে আপনি তাকে নয়, নিজেকেই ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছেন।
মোটরসাইকেলের চাবি যেন আপনার হাতে সন্তানের মৃত্যুর চাবি না হয়ে ওঠে।

 

ফরিদ 

×