ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

ইরানে হামলার সিদ্ধান্তের পেছনে কী কারণ রয়েছে ইসরায়েলের?

প্রকাশিত: ১২:১৬, ১৫ জুন ২০২৫

ইরানে হামলার সিদ্ধান্তের পেছনে কী কারণ রয়েছে ইসরায়েলের?

ইরান পরমাণু অস্ত্র চায় না বলে বারবার দাবি করলেও, ইসরায়েল বরাবরই মনে করে—ইরান তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি। সেই বিশ্বাস থেকেই ইসরায়েল ইরানের ওপর বহুদিন ধরে যে হামলার হুমকি দিয়ে আসছিল, অবশেষে তা কার্যকর করেছে। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়েছেন, এই হামলা “প্রয়োজনে যতদিন লাগবে, ততদিন চলবে”।

শুক্রবার ভোরে শুরু হওয়া এই হামলা ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পিত। এতে ইরানের সামরিক ও সরকারি স্থাপনায় হামলা চালিয়ে শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে—তাদের মধ্যে রয়েছেন ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (IRGC) প্রধান হোসেইন সালামি এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ মোহাম্মদ বাগেরি। নিহতদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু বিজ্ঞানীরাও রয়েছেন।

 এই হামলা এমন সময় ঘটল, যখন যুক্তরাষ্ট্র—ইসরায়েলের প্রধান মিত্র—ও ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছিল। ফলে অনেকেই মনে করছেন, ইসরায়েলের এই হুমকি আসলে ছিল ইরানের ওপর চাপ তৈরির যৌথ কৌশল। ইসরায়েল আগেই গাজায় ২০ মাস ধরে চলমান যুদ্ধের মাধ্যমে বহু আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত। আর ইরানে এই হামলা সেই লঙ্ঘনের নতুন অধ্যায়।

ইসরায়েল কখনোই প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি, তবে সাধারণভাবে ধারণা করা হয়—তাদের কাছে পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। কিন্তু ইরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করে, তবে ইসরায়েল এই কৌশলগত সুবিধা হারাবে। তাই এটিই তাদের ‘লাল রেখা’। 

২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে এক চুক্তিতে ইরান সম্মত হয়েছিল, তারা পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত রাখবে এবং IAEA নিয়মিত তাদের স্থাপনা পরিদর্শন করতে পারবে—বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হবে।

কিন্তু ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে ওই চুক্তি থেকে সরে গিয়ে আবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। তবে এখনো যুক্তরাষ্ট্র মনে করে না যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে রয়েছে। চলতি বছরের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা প্রধান টুলসি গ্যাবার্ড বলেন, “আমরা এখনো মনে করি না ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে, এবং সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেই ২০০৩ সালে যে কর্মসূচি স্থগিত করেছিলেন, তার অনুমোদন এখনো দেননি।”

ইসরায়েলের হামলার পেছনে আর কী কারণ থাকতে পারে?

তেল আবিবের দাবি, ইরানের হাতে খুব শিগগিরই ১৫টি পারমাণবিক বোমা তৈরির উপাদান থাকতে পারে। এই আশঙ্কা থেকেই ইসরায়েল 'প্রয়োগের আগেই প্রতিরোধ' নীতি নিচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

এদিকে নেতানিয়াহু আগে ইরানকে আখ্যা দিয়েছিলেন “অক্টোপাসের মাথা” হিসেবে, যার “শুঁড় ছড়িয়ে আছে হুথি, হিজবুল্লাহ ও হামাস পর্যন্ত”। এই ধারণা থেকেই ইসরায়েল মনে করে, ইরানই ওইসব বিরোধী গোষ্ঠীর মূল শক্তি—যাদের “প্রতিরোধ অক্ষ” (axis of resistance) বলা হয়।

২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েল হামাস ও হিজবুল্লাহকে অনেকটা দুর্বল করে ফেলেছে। তাদের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করেছে—যাদের মধ্যে আছেন হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ এবং হামাসের নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার ও ইসমাইল হানিয়া।

হিজবুল্লাহর ওপর হামলার পর ইসরায়েল যে ধরনের পাল্টা আঘাতের আশঙ্কা করেছিল, তা হয়নি। এতে করে ইসরায়েলের যুদ্ধপন্থীরা বলছেন, এই সুযোগে তারা আঞ্চলিকভাবে আরও বড় রকমের পরিবর্তন আনতে পারে—এমনকি কেউ কেউ ইরানে সরকার পরিবর্তনের কথাও ভাবছে, যদিও তা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ ছাড়া সম্ভব নয়।

তবে শুক্রবারের হামলার আগে ইসরায়েল, ইরান বা তাদের মিত্রদের মধ্যে সরাসরি কোনো সাম্প্রতিক সংঘর্ষ ছিল না—শুধু পাল্টা আক্রমণের হুমকি ছাড়া।

এদিকে, ইসরায়েলের অনেকেই নেতানিয়াহুকে অভিযুক্ত করছেন—তিনি নিজের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য সামরিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, যেমন গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। সেখানে ইসরায়েল এখন পর্যন্ত ৫৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।

সমালোচকদের মতে, নেতানিয়াহু এখন যুদ্ধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন—ইরান ও গাজা উভয় ক্ষেত্রেই—কারণ যুদ্ধ ছাড়া তার জোট সরকার ভেঙে পড়তে পারে, এবং তাকে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা ঠেকাতে ব্যর্থতার দায় নিয়ে জবাবদিহি করতে হতে পারে। পাশাপাশি, তার বিরুদ্ধে চলমান দুর্নীতির মামলাতেও তিনি দণ্ডিত হতে পারেন।

 

সানজানা

×