
গ্রাফিক্স: জনকণ্ঠ
মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে আজ যুদ্ধের বারুদের গন্ধ। ইসরায়েল-গাজা সংঘাতের রেশ কাটতে না কাটতেই এবার সরাসরি ইরানের মাটিতে আগুন জ্বলেছে। দীর্ঘদিন ধরে তীব্র উত্তেজনা এবং পাল্টাপাল্টি হুমকির পর শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত দুই শক্তিধর প্রতিপক্ষ ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের সূচনা হলো।
ইসরায়েল ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামে ইরানের বিরুদ্ধে চালিয়েছে তাদের ইতিহাসের "সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান"। ড্রোন ও যুদ্ধবিমান থেকে ছোঁড়া বোমার লক্ষ্য ছিল পারমাণবিক স্থাপনা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি এবং সামরিক কমান্ড সেন্টার। এতে ইরানের কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইরানও চুপ করে বসে থাকেনি। রাত গভীর হতেই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনে ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় হামলা চালায় তারা। আকাশজুড়ে সাইরেনের শব্দ, বিস্ফোরণের গর্জন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক— পুরো পরিস্থিতি যেন যুদ্ধের এক বাস্তব চিত্র।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (IRGC) জানায়, ইসরায়েলের অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র, সামরিক ঘাঁটি এবং কৌশলগত বিভিন্ন স্থাপনায় তাদের ‘স্মার্ট’ ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। অন্যদিকে, ইসরায়েল দাবি করেছে তাদের শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশিরভাগ আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এক ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন, ইরানের বিরুদ্ধে অভিযান কেবল শুরু, সামনে আরও বড় কিছু আসছে। তিনি ইরানের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “এই ইসলামি শাসকগোষ্ঠী ৫০ বছর ধরে আপনাদের দমন করে এসেছে। এখন সময় এসেছে তাদের পতনের।”
তবে ইরান পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছে— “যদি অন্য কোনো দেশ ইসরায়েলকে রক্ষা করতে আসে, তবে তারাও আমাদের নিশানায় থাকবে।” এমন হুমকিতে কাঁপছে গোটা মধ্যপ্রাচ্য।
বিশ্ব শক্তিগুলোও চোখ রাখছে পরিস্থিতির দিকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, “ইরান তাদের সুযোগ হারিয়েছে। এখন সামনে রয়েছে আরও কঠোর পদক্ষেপের আশঙ্কা।”
এইসব ঘটনার পটভূমিতে বড় প্রশ্নটি হলো— মুসলিম বিশ্ব কোথায়? যখন গাজা শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল, মুসলিম দেশগুলোর অধিকাংশই ছিল নির্লিপ্ত। আজ যখন তেহরান জ্বলছে, তখনো মুসলিম বিশ্ব যেন নীরব দর্শক। কিছুটা নিন্দা, কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ— এর বেশি কিছু নয়।
ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে এমন অনেক মুসলিম রাষ্ট্র এখন দ্বিধান্বিত। তারা একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা স্বার্থ, অন্যদিকে মুসলিম ঐক্যের দাবি— এই দ্বন্দ্বে তারা নিষ্ক্রিয় থেকেছে বারবার। অথচ মুসলিম বিশ্বের ন্যূনতম ঐক্য থাকলেও হয়তো এমন একতরফা আগ্রাসন বারবার ঘটত না।
তবে এই যুদ্ধ শুধুই ধর্মীয় নয়— এটি ভূরাজনীতি, শক্তির লড়াই, আধিপত্য বিস্তারের খেলা। কিন্তু ইসলামপন্থীদের কাছে প্রশ্ন থেকেই যায়— যখন মুসলিম জনপদে আগুন জ্বলে, যখন নিরীহ মানুষ মারা পড়ে, তখন কেন আপনারা ঘুমিয়ে থাকেন? কবে জাগবেন?
মধ্যপ্রাচ্যে এই উত্তাল পরিস্থিতি কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বাভাস দিচ্ছে? নাকি এটা কেবল আরও এক পর্ব, যেখানে মুসলিম রক্ত ঝরে, বিশ্ব চুপচাপ দেখে?
তেহরান আজ জ্বলছে, কাল হয়তো আরেক শহর। মুসলিম বিশ্ব যদি এখনো না জাগে, তবে শুধু ভূখণ্ড নয়, ইতিহাসও তাদের ক্ষমা করবে না। শান্তির জন্য নয়, অস্তিত্বের জন্যই আজ ঐক্য জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক
এম.কে.