
জলবায়ু আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ যখন ব্রিটিশ পতাকাবাহী ইয়ট ম্যাডলিন-এ উঠে গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের (এফএফসি) অংশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেন, তখন তিনি কেবল একজন খ্যাতনামা প্রতিবাদকারী হিসেবে নয়, বরং একজন বিশ্ব নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালনের ব্রতী হয়েছিলেন। কিন্তু এই মিশন দ্রুত বাধাগ্রস্ত হয়। ১০ জুন আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরাইলি বাহিনী ম্যাডলিনকে আটক করে, জাহাজটি জব্দ করে এবং কয়েকজন যাত্রীকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে। তাদের মধ্যে ছিলেন থুনবার্গও। বাইশ বছর বয়সী গ্রেটা থুনবার্গ পরিবেশকর্মী হিসেবে সুপরিচিত। তিনি দীর্ঘদিন ধরে উড়োজাহাজে ভ্রমণ এড়িয়ে চলেছেন। ২০১৯ সালে নিউইয়র্কে একটি জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য সমুদ্রপথে যাত্রা করার মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনার জন্ম দেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তাকে কিনা বিমানযোগে ফ্রান্স হয়ে ফেরত পাঠায় ইসরাইল কর্তৃপক্ষ।
বাকি যাত্রীরা এখনো বন্দি অবস্থায় রয়েছেন। আইনি ও ভূরাজনৈতিক এক নাটকের পরবর্তী ধাপের অপেক্ষায়, যা মানবিক সংহতির অপরাধীকরণের দিকটিকে নতুন করে উন্মোচন করছে। এটি ছিল কয়েকটি ফ্লোটিলা প্রচেষ্টার একটি অংশ, যেগুলোর লক্ষ্য ছিল ইসরাইলের দীর্ঘদিনের গাজা অবরোধ ভাঙা। এ ঘটনার মাধ্যমে আবারও সামনে এসেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন- সহানুভূতির ওপর যখন হামলা হয়, তখন কোথায় দাঁড়ায় মানবতা?
ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন পরিচালিত ফ্লোটিলার অংশ ম্যাডলিন-এ ছিলেন ১২ জন যাত্রী, যারা বিভিন্ন দেশের নাগরিক- সুইডেন, ফ্রান্স, ব্রাজিল, জার্মানি, স্পেন, তুরস্ক ও নেদারল্যান্ডস। তাদের মধ্যে ছিলেন একজন চিকিৎসক, একজন রাজনীতিবিদ, একজন সাংবাদিক এবং অন্যান্য শান্তিকর্মী। তাদের কারও হাতে ছিল না অস্ত্র বা ঘৃণার স্লোগান। ছিল চিকিৎসাসামগ্রী ও গাজায় বন্দি বেসামরিক মানুষের জন্য অত্যাবশ্যক সহায়তা। গ্রেটা থুনবার্গের সঙ্গে ছিলেন ইউরোপীয় সংসদের ফরাসি-ফিলিস্তিনি সদস্য রিমা হাসান, জার্মান কর্মী ইয়াসেমিন আকার এবং স্প্যানিশ মানবিক সহায়ক সার্জিও টোরিবিওসহ আরও অনেকে। তাদের লক্ষ্য ছিল সহজ- সাহায্য পৌঁছে দেওয়া, বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করা এবং গাজাবাসীর দুর্দশার নীরবতা ভেঙে দেওয়া। বিশ্ববাসীর কাছে গাজাবাসীর নীরব কান্নার শব্দ পৌঁছানো, স্বার্থান্ধ শক্তিগুলোর ঘুম ভাঙানো।
ইসরাইল দাবি করেছে, নিরাপত্তার স্বার্থে ম্যাডলিনকে আটক করাটা আইনগতভাবে সঠিক ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনবিদ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই জাহাজ আটকানোর ঘটনাকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে আখ্যা দিয়েছে এবং একে আন্তর্জাতিক জলসীমায় জলদস্যুতার শামিল বলে অভিহিত করেছে। সমুদ্র আইন ও মানবিক সাহায্য বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নীতিমালায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, যে কোনো বেসামরিক জাহাজ যদি মানবিক সহায়তা বহন করে, বিশেষত আন্তর্জাতিক জলসীমায়, তাহলে তা হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু ইসরাইল ফ্লোটিলাকে রাজনৈতিক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। কারণ এটি গাজা অবরোধকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে একটি অবরোধ, যা বহু মানবাধিকার সংস্থা ‘উন্মুক্ত আকাশের নিচে কারাগার’ বলে বর্ণনা করে। মূলত এখানেই আইনের চেয়ে বিবেকের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ম্যাডলিন-এ থাকা মানুষদের আটকের মাধ্যমে ইসরাইল কেবল একটি জাহাজ থামায়নি; বরং একটি বার্তা দিয়েছে যে, ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো একটি অপরাধ, এমনকি তা যদি গ্রেটা থুনবার্গের মতো সম্মানিত আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের মাধ্যমেও হয়।
ম্যাডলিন অভিযানে গ্রেটা থুনবার্গের অংশগ্রহণ তার আন্দোলনের গতিপথে এক নতুন মোড়। জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে বিশ্বজুড়ে নেতৃত্ব দেওয়ার পর এবার তিনি মানবাধিকারের বিষয়েও সোচ্চার হলেন। তার দৃষ্টিতে গাজা অবরোধ কেবল একটি রাজনৈতিক বিষয় নয়, বরং এটি একটি নৈতিক এবং পরিবেশগত ইস্যু। গাজার মানুষ শুধু বোমা বা বাস্তুচ্যুতি নয়, বরং মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিশুদ্ধ পানির অভাব, সীমিত বিদ্যুৎ, সংকটাপন্ন হাসপাতাল ব্যবস্থা ইত্যাদি, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে আরও ঘনীভূত করছে। তার যাত্রা ছিল এক বৃহত্তর লড়াইয়ের প্রতীক সামরিকরণ ও রাজনৈতিক উদাসীনতার বিরুদ্ধে। তাকে ইসরাইল থেকে দ্রুত বহিষ্কার করা হয়। ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ছবিতে দেখা যায়, তিনি ফ্রান্স হয়ে সুইডেন ফিরে যাচ্ছেন অত্যন্ত সংযত, সম্মানজনকভাবে এবং তার মৌনতা হয়ে ওঠে সবচেয়ে উচ্চস্বরে প্রতিবাদ।
ম্যাডলিনে থাকা সবাই এখনো দেশে ফেরেননি। অ্যাডালাহ নামে এক মানবাধিকার আইনি সংস্থা জানিয়েছে, যাত্রীদের কয়েকজন ইচ্ছাকৃতভাবে বহিষ্কারনামায় স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান এবং এখনো বন্দি রয়েছেন। তাদের মধ্যে পাঁচজন ফরাসি নাগরিক। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তাদের সুরক্ষা ও প্রত্যাবাসনের আহ্বান জানিয়েছেন। স্পেনও একইভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ফেরার পর স্প্যানিশ কর্মী সার্জিও টোরিবিও ঘটনাটিকে ‘জলদস্যুতা’ বলে অভিহিত করেছেন। প্রতিটি আটকের পেছনে রয়েছে একটি গভীর বার্তা- গাজা নিয়ে রাষ্ট্রীয় বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করে এমন বেসরকারি উদ্যোগগুলোকে বিশ্বব্যবস্থা এখন ক্রমেই সহ্য করতে পারছে না। সাংবাদিক ডাক্তার, সংসদ সদস্য যে কেউ যদি সাহায্যের বাহক হন, তাহলে তিনি হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন।
এ ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে হলে ফিরে তাকাতে হবে গাজার মানবিক বিপর্যয়ের দিকে। অক্টোবর ২০২৩ থেকে গাজার পরিস্থিতি চরমভাবে অবনতি ঘটেছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন বলছে, দুর্ভিক্ষ, রোগ ও অবকাঠামোর ধ্বংস এখন সর্বব্যাপী। ঘনঘন ইসরাইলি সামরিক হামলায় লক্ষ্যবস্তু হয়েছে বাড়িঘর, স্কুল, হাসপাতাল এমনকি জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্র। নারী ও শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তবু সাহায্য পাঠানো হচ্ছে বাধাগ্রস্ত করে বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক নিয়মকানুন ও সামরিক নিষেধাজ্ঞার কারণে। এই প্রেক্ষাপটে ম্যাডলিন কোনো হুমকি নয়, বরং ছিল একটি জীবনরক্ষাকারী মানবিক উদ্যোগ। এই অভিযানের বাধা প্রতীক হয়ে উঠেছে গাজার একাকিত্ব ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তার। গ্রেটা ও তার সহযাত্রীরা যা করেছেন, তা অনেক সরকার যা করতে পারেনি। তাদের শাস্তি আটক, বহিষ্কার এবং রাজনৈতিক হেয়প্রতিপন্নতা আজকের মানবিকতার দুঃখজনক বাস্তবতা উন্মোচন করে- অন্যদের পক্ষে দাঁড়ানো মানেই নিজেকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা।
ম্যাডলিন ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় উঠে গেছে #ঋৎববঞযবঋষড়ঃরষষধ, #ঔঁংঃরপবঋড়ৎএধুধ মতো হ্যাশট্যাগ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। মানবাধিকার সংস্থা, জলবায়ু আন্দোলনকারী এবং রাজনীতিবিদরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এটি একটি নতুন আলোচনা শুরু করেছে- বিশ্ব নাগরিকরা কি এমন সংকটে নৈতিক হস্তক্ষেপ করতে পারেন, যেখানে তাদের সরকার ব্যর্থ বা উদাসীন? একজন পরিবেশ আন্দোলনকারী কি ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলতে পারেন, অবলীলায় ‘হুমকি’ হিসেবে চিহ্নিত না হয়ে? গ্রেটা থুনবার্গ সবসময় মানুষের সচেতনতা জাগানোর জন্য পরিচিত। গ্রেটা থুনবার্গের আন্দোলন সবসময়ই মানুষের নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতা থেকে তাদের জাগিয়ে তোলার জন্য। মাডলিন নৌযাত্রায় তার অংশগ্রহণ কেবল প্রতীকী ছিল না। এটি সরাসরি সেই ধারণার বিরুদ্ধে একটি চ্যালেঞ্জ ছিল যে, মানবিক সহানুভূতি নাকি রাজনীতির সীমায় এসে থেমে যায়। তার বহিষ্কার ছিল এক ধরনের সতর্কবার্তা। তবে একই সঙ্গে এটি ছিল একটি উদ্দীপনাও। একই সঙ্গে এটি এক সজাগ আহ্বান।
ইসরাইল তার অবস্থান ধরে রেখেছে এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোও মুখ খুলছে। যেসব কর্মী এখনো বন্দি, তাদের ভাগ্য এখন ইতিহাস নির্ধারণ করবে- মানবিক সহায়তা কি অপরাধ হবে, না কি তা সংরক্ষিত থাকবে? এদিকে গাজার সংকট অব্যাহত। শিশুরা কেবল বোমায় নয়, তৃষ্ণায়ও মারা যাচ্ছে। হাসপাতালগুলো চলছে ধুঁকে ধুঁকে। গাজার মানুষ এখনো প্রতীক্ষায় বিশ্ব কি তাদের পাশে দাঁড়াবে? থুনবার্গ ও তার সহকর্মীদের হয়তো থামিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাদের বার্তা সহানুভূতি সীমান্ত অতিক্রম করতে পারে। সাহায্য রাজনীতির ঊর্ধ্বে হওয়া উচিত এবং নীরবতা মানে সহাবস্থানে অংশগ্রহণ- এই বার্তাই এখন সমুদ্র পেরিয়ে বিশ্বে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। কারণ শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ হয়তো দ্বন্দ্ব নয়, বরং সমবেদনা বা সহানুভূতিতেই নিহিত।
লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল