
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক অপার সম্ভাবনার নিঝুম দ্বীপ যেন পর্যটকদের কাছে নতুন চমক হয়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে্য ভরপুর এই দ্বীপে সম্প্রতি যোগ হয়েছে নতুন এক আকর্ষণ নামার বাজার সমুদ্রসৈকতে তৈরি একটি ৮০০ মিটার দীর্ঘ কাঠের সেতু। এটি কেবল কাঠের একটি পথ নয়, এটি স্থানীয় যুবকদের স্বপ্ন, উদ্যোগ আর স্বেচ্ছাশ্রমে গড়া এক বাস্তব কল্পনার রূপ।
সেতুর ওপর দাঁড়ালে একদিকে চোখে পড়ে নীল আকাশ, অন্যদিকে নিচে গড়িয়ে চলা স্বচ্ছ জলরাশি। শেষ বিকালে, যখন সূর্য পশ্চিমাকাশে লাল আভা ছড়িয়ে অস্ত যায়, তখন সেতুর শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের সে দৃশ্য যেন মন ছুঁয়ে যায়। এ যেন এক জীবন্ত পেইন্টিং, যেখানে প্রকৃতি নিজেই তুলির ছোয়ায় রাঙিয়ে চলেছে চারপাশ।
ঘুরতে আসা এক পর্যটক মোঃ সোহান বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সেতুর ছবি দেখে ঘুরতে এসেছি। বাস্তবে এসে দেখি, ছবির চেয়েও সুন্দর। এখানে এসে প্রকৃতির এ সৌন্দর্যে্য মুগ্ধ হয়েছি। এই সেতু যেন পুরো নিঝুম দ্বীপের সৌন্দর্যের দ্বার খুলে দিয়েছে।এই কাঠের সেতু নিঝুম দ্বীপে পর্যটনের সম্ভাবনাকে নতুনভাবে উন্মোচন করেছে। স্থানীয়রা বলেন, আমরা চাই এই দ্বীপে পর্যটকরা আরও বেশি আসুক, দ্বীপের সৌন্দর্যকে উপভোগ করুক।
যদিও এখন ৩০ টাকার টিকিটের মাধ্যমে সেতুতে ওঠার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, তবে আয়কৃত অর্থ সৈকতের উন্নয়নে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি টেকসই ব্যবস্থাপনার উদাহরণ। যদি এই উদ্যোগ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে আরও বিস্তৃত করা যায়, তাহলে নিঝুম দ্বীপ হতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইকো—ট্যুরিজম গন্তব্য।
নিঝুম দ্বীপ নামের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে অদ্ভুত এক মায়া। সম্ভবত সেই কারণেই ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পেয়েছে নোয়াখালীর সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে জেগে ওঠা এই দ্বীপ।
নোয়াখালী জেলার ব্র্যান্ডিংও করা হয়েছে নিঝুম দ্বীপের নামে। সেই থেকে নোয়াখালীকে ‘নিঝুম দ্বীপের দেশ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম বিভাগের নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত হাতিয়া উপজেলার ছোট একটি দ্বীপ এই নিঝুম দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের বুকে মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে ওঠা এই চরটি হাতিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণ—পশ্চিমে অবস্থিত।
চর ওসমান, বাউল্লারচর, কামলার চর ও মৌলভির চর— এই চার চর নিয়ে পুরো নিঝুম দ্বীপ। প্রায় ১৪ হাজার ৫০ একরের এই দ্বীপটি সাগরের মাঝখানে জেগে ওঠে ১৯৪০ সালে। তারও প্রায় এক দশক পর গড়ে ওঠে জনবসতি। দ্বীপটিকে সরকার জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল। শুধু সৈকতই নয়, দ্বীপের মাটিও বালুতে চিকচিক করতো। দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে দেখা যেতো বালুর ঢিবি বা টিলার মতো জায়গা।
নিঝুম দ্বীপের বিশেষত্ব হচ্ছে চিত্রা হরিণ ও অতিথি পাখি: নিঝুম দ্বীপের বিশেষত্ব হচ্ছে চিত্রা হরিণ ও অতিথি পাখি। একসঙ্গে এতো চিত্রা হরিণ দেশের আর কোথাও দেখা যায় না। আর সন্ধ্যা নামলেই শিয়ালের ডাক শিরদাঁড়া দিয়ে রোমাঞ্চের ঢেউ তোলে।
সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার জন্য এখানকার সেরা জায়গা নামা বাজার সৈকত। নামা বাজার থেকে পায়ে হেঁটে ১০ মিনিটের মধ্যেই সৈকতে পৌছা যায়। অপরদিকে বারবিকিউয়ের জন্যও এ জায়গাটি বেশ খ্যাতি রয়েছে।
পর্যটকদের নিঝুম দ্বীপ গিয়ে ফিরতে হয় রাজ্যের ক্লান্তি আর ভোগান্তি সঙ্গে নিয়ে। তবে নিঝুম দ্বীপের গহিন বন, বনের ভেতর পাখিদের ডাক শুনে এবং দ্বীপের চারপাশের নদী ও সৈকতে ঘুরে বেড়িয়ে যাতায়াতের কষ্ট আর ক্লান্তি ভুলে থাকতে পারবেন।
নিঝুম দ্বীপ বেড়াতে যান, এমন মানুষদের বেশি আগ্রহ থাকে বনের ভেতর কাছ থেকে হরিণের পাল দেখার। সম্প্রতি নিঝুম দ্বীপের বনে ঘুরতে গিয়ে হরিণের দেখা খুব একটা মেলেনি। তবে একটি হরিণ সবাই কমবেশি দেখেছেন এটা বলা যায়। সেই হরিণ বেশির ভাগ সময়ই থাকে বন বিভাগের বাংলোর আশপাশে। স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, হরিণটি বাচ্চা অবস্থা থেকে কার্যালয়ের আশপাশে থাকে। তাঁরাই হরিণটি দেখাশোনা করে বড় করেছেন। যাঁরা বেড়াতে আসেন, তাঁরাও হরিণটিকে নানা খাবার দেন। সেটি বনে যায় না। সারাক্ষণ নিঝুম দ্বীপের নামার বাজার ও আশপাশের এলাকায় ঘুরে বেড়ায়।নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণে দ্বীপের ভেতরে যাতায়াতব্যবস্থা বেশ নাজুক। দ্বীপের একমাত্র পাকা সড়কটি জোয়ারের পানির তোড়ে ভেঙে গেছে অনেক স্থানে। বছরের পর বছর ধরে ভাঙা সড়কটি সংস্কার হয়নি। দ্বীপের বন্দরটিলা এলাকার নদীর ঘাট থেকে নামার বাজার পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়কের বেশির ভাগই ভাঙা। সড়কের একাধিক স্থানে কালভার্ট ভেঙে গেছে জোয়ারের তোড়ে। সেখানে কাঠের সেতু নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে, যা দিয়ে কোনোরকমে মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারে।
পাখি, হরিণ দেখতে হলে খুব ভোরে উঠতে হবে। আগে থেকেই কোনো স্থানীয় গাইডকে বলে রাখা যেতে পারে। তাহলে সঠিক জায়গায় যেতে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না। স্থানীয়রা গাইডের কাজ করে। ওরাই সাধারণত পর্যটকদের ম্যানগ্রোভ বনের হরিণ দেখিয়ে নিয়ে আসে।
নিঝুম দ্বীপে পেটপূর্তির জন্য যেতে হবে নামার বাজারে। সেখানকার খাবার হোটেলগুলো সামুদ্রিক মাছ ও চিংড়ি ভাজার জন্য বেশ জনপ্রিয়। আগে থেকে অর্ডার করে রাখলে তুলনামূলক ভালো খাবার পাওয়া যায়।
নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণে সতর্ক থাকা আবশ্যক, বিশেষ করে যাত্রা শুরুর আগে অবশ্যই সেখানকার আবহাওয়ার ব্যাপারে অবগত হয়ে নেওয়া উচিত। নিঝুম দ্বীপে বিদ্যুতের জন্য সবাই জেনারেটর ও সোলারের ওপর নির্ভরশীল। তাই যাত্রার মুহূর্তে ব্যাগ গোছানোর সময় পরিমিত কাপড় ও ফাস্ট এইডের পাশাপাশি মোবাইল চার্জার, ক্যামেরা ও মোবাইলের জন্য অতিরিক্ত ব্যাটারি, পাওয়ার ব্যাংক সাথে থাকা অত্যাবর্শকীয়।
রাজু