ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে রাজকীয় ইতিহাসের নিঃশব্দ সাক্ষী: রাজা নিপেন্দ্র নারায়ণের স্থাপত্যযুগ

মেহেদী হাসান সেতু, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, পঞ্চগড়

প্রকাশিত: ০৯:০২, ১৬ জুন ২০২৫; আপডেট: ০৯:০২, ১৬ জুন ২০২৫

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে রাজকীয় ইতিহাসের নিঃশব্দ সাক্ষী: রাজা নিপেন্দ্র নারায়ণের স্থাপত্যযুগ

ছবি: জনকণ্ঠ

নীরব পাহারায় দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাস। দেয়ালে দেয়ালে জমেছে কালের ধুলা, তবু মুছে যায়নি স্মৃতির ছাপ। পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু স্থাপনা আজও নিঃশব্দে বহন করে এক রাজকীয় অধ্যায়ের সাক্ষ্য রাজা নিপেন্দ্র নারায়ণের স্থাপত্যযুগ।

উনিশ শতকের শেষভাগে তৎকালীন কোচবিহার রাজ্যের শাসক রাজা নিপেন্দ্র নারায়ণ (১৮৬২–১৯১১) দেবীগঞ্জকে রূপ দিতে চেয়েছিলেন একটি আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে। সেই স্বপ্নের ছাপ রেখেছেন তিনি ইট-পাথরের কাঠামোতে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাজ প্রশাসনিক ভবন (বর্তমান উপজেলা ভূমি অফিস), পুরনো কারাগার ভবন এবং নিপেন্দ্র নারায়ণ ইংলিশ স্কুল (বর্তমান নিপেন্দ্র নারায়ণ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়)।

ইতিহাস, যা আজ নিঃসঙ্গ

কালের বিবর্তনে সেই গৌরবময় স্থাপনাগুলোর চেহারায় আজ ধরা পড়ে শুধুই অবহেলার ছাপ। কোথাও প্লাস্টার খসে পড়ছে, কোথাও কার্নিশ ঝুঁকে আছে ধ্বংসের দিকে। রাজশক্তির প্রতীক হয়ে ওঠা এই দালানগুলো যেন এখন শুধু স্মৃতির ভার বহন করে দাঁড়িয়ে থাকা একাকী প্রহরী।

নিপেন্দ্র নারায়ণ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, বিদ্যালয়ের প্রাচীন অংশটি এখনো পাঠদানের কাজে ব্যবহৃত হলেও প্রতিনিয়ত এর নানা অংশ ক্ষয়ে যাচ্ছে। বারবার সংস্কারের দাবি তোলা হলেও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

পুরনো জেলখানার চিত্র আরও করুণ। জরাজীর্ণ সেই ভবনটি এখন কেবলই ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য ছবি তোলার জায়গা, কিন্তু সরকারি বা স্থানীয় কোনো উদ্যোগ নেই তার সংরক্ষণে। অথচ স্থাপনাটি হতে পারত দুর্লভ এক ঐতিহাসিক নিদর্শন।

প্রবীণদের স্মৃতিচারণে ফিরে আসে স্বপ্নের দিন

স্থানীয় প্রবীণরা বলেন, ব্রিটিশ শাসনামলে রাজা নিপেন্দ্র নারায়ণ দেবীগঞ্জকে ঘিরে যে উন্নয়ন ও প্রশাসনিক পরিকল্পনা করেছিলেন, এই স্থাপনাগুলো তারই প্রমাণ। ছিল সুসংগঠিত নাগরিক কাঠামো, শিক্ষার প্রসার ও শাসনব্যবস্থার ছাপ। তাদের কণ্ঠে এখনও ধ্বনিত হয় সেসব দিন, যখন রাজা নিপেন্দ্র নারায়ণের নাম ছিল গর্ব আর মর্যাদার প্রতীক।

আবহমান ইতিহাসের সম্ভাবনার ঠিকানা

উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, ভবনগুলোর সংস্কার ও সংরক্ষণের বিষয়টি তাদের নজরে রয়েছে। প্রয়োজনীয় অনুমোদন মিললে দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সংস্কৃতি ও পর্যটন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু ইতিহাস নয়, উত্তরবঙ্গের পর্যটনের বিকাশেও এই স্থাপনাগুলোর ভূমিকা অপরিসীম। যথাযথ সংরক্ষণ ও প্রচারণার মাধ্যমে দেবীগঞ্জকে গড়ে তোলা সম্ভব একটি ঐতিহ্যভিত্তিক পর্যটন গন্তব্য হিসেবে।

শেষ কথা: ইতিহাস কি হারিয়ে যাবে নীরবেই?

এইসব নিঃশব্দ ইতিহাসের ধারক ভবনগুলো কি কালের গহ্বরে হারিয়ে যাবে একদিন? যদি আজই না জাগে উদ্যোগ, তবে হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম আর দেখতে পাবে না রাজা নিপেন্দ্র নারায়ণের সেই স্থাপত্যবিজয়।

সময়ের ডাক এখনই সংরক্ষণ করতে হবে রাজকীয় ঐতিহ্য, বাঁচাতে হবে ইতিহাসের শেষ নিঃশ্বাস। ইতিহাস নীরব, কিন্তু তার আবেদন জাগ্রত। প্রয়োজন কেবল আমাদের সম্মিলিত সচেতনতা ও কার্যকর পদক্ষেপ।

আবির

×