
পাঁচ বছর আগে বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ রূপ নেওয়া করোনাভাইরাস ফের নতুন রূপে ফিরে আসছে। করোনাভাইরাসের অমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের একটি উপধরন হলো এক্সবিবি। এটি মূলত দুটি অমিক্রন সাব-ভ্যারিয়েন্টের সংমিশ্রণে তৈরি BA.2.10.1 এবং BA.2.75। এক্সবিবি প্রথম শনাক্ত হয় ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে। এরপর তা বিশ্বজুড়ে ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে।
> এক্সবিবির বৈশিষ্ট্য-
* এটি উচ্চমাত্রায় সংক্রামক
* এর ইমিউন এস্কেপ ক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ এটি প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন বা টিকা-প্রাপ্ত ব্যক্তির প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও কিছুটা ফাঁকি দিতে পারে
* তবে এখন পর্যন্ত এর প্রভাবে মারাত্মক অসুস্থতা বা মৃত্যুহার বেশি হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হালনাগাদ বুস্টার ডোজ, বিশেষ করে এক্সবিবি-ভিত্তিক ভ্যাকসিন এই ধরন থেকে গুরুতর অসুস্থতা, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে কার্যকর। যদিও সংক্রমণ পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব নয়, তবে টিকা গুরুতর জটিলতা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এক্সবিবি থেকে আরও কয়েকটি উপধরন সৃষ্টি হয়েছে। যেমন- এক্সবিবি .1, এক্সবিবি .1.5 এবং সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে এনবি .1.8.1। এই ধরনগুলোর মধ্যে কিছু কিছু আগের চেয়ে আরও সংক্রামক, তবে টিকা এখনো কার্যকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এক্সবিবি ও এর উপধরনগুলোকে Variant of Interest বা Variant Under Monitoring হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এর মানে হলো, এগুলোর ওপর বৈজ্ঞানিক নজরদারি চলছে এবং এগুলো ভবিষ্যতে জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
গ্লোবাল ভাইরাস নেটওয়ার্ক (জিভিএন) জানিয়েছে, এই ধরনটিতে সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি হলেও গুরুতর অসুস্থতা বা মৃত্যুঝুঁকি বাড়ানোর মতো কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় এবং ১৮ মার্চ ঘটে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা। এরপর ২০২৫ সালের ৮ জুন পর্যন্ত দেশে মোট ২০ লাখ ৫১ হাজার ৭৪২ জন আক্রান্ত হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৫০০ জনের। এখন পর্যন্ত করোনায় সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তির সংখ্যা ২০ লাখ ১৯ হাজার ৩৭৬ জনে। ২০২৪ সালে কেউ মারা না গেলেও ২০২৩ সালে ৩৭ জন এবং ২০২২ সালে এক হাজার ৩৬৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দেশে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৩ জন। মে মাসে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ জনে। আর জুন মাসের প্রথম আট দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৬ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন একজন।
> উপসর্গগুলো হলো-
* জ্বর * সর্দি * গলা জ্বালা * মাথা যন্ত্রণা
* অতিরিক্ত ক্লান্তি * গাঁটে গাঁটে ব্যথা * পেশিতে ব্যথা * গ্যাস, অম্বলের সমস্যা। এই উপসর্গগুলো থাকলে আজই সাবধান হোন।
> করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা
১. কয়েকবার প্রয়োজনমতো সাবান দিয়ে হাত ধোবেন (অন্তত ২৩ সেকেন্ড)।
২. নাক-মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
৩. আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে কমপক্ষে তিন ফুট দূরে থাকতে হবে।
৪. অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ করা যাবে না।
৫. হাঁচি-কাশির সময় টিস্যু, কাপড় দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখতে হবে।
> দেশে প্রবেশপথের জন্য নির্দেশনা-
* দেশের বিভিন্ন স্থল, নৌ, বিমানবন্দরে আইএইচআর (IHR-2005) স্বাস্থ্য ডেস্কসমূহে সতর্ক থাকা, হেলথ স্ক্রিনিং এবং সার্ভেল্যান্স জোরদার করতে হবে।
* দেশের পয়েন্টস অব এন্ট্রিসমূহে থার্মাল স্কান্যার, ডিজিটাল হেন্ড হেল্ড থার্মোমিটারের মাধ্যমে নন টাচ টেকনিকে তাপমাত্রা নির্ণয় করতে হবে।
* চিকিৎসা কাজে স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ মাস্ক, গ্লাভস এবং রোগ প্রতিরোধী পোশাক (পিপিই) মজুত রাখতে হবে।
*ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য রোগ প্রতিরোধ নির্দেশনাগুলো প্রচার করতে হবে।
* জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ভারত ও অন্যান্য আক্রান্ত দেশে ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, করোনা এখন কোথায়, করোনা তো কবেই গেছে- এমন কথা বলেন অনেকেই। তারা খুব ভুলও বলেন না। বৈশ্বিক এ মহামারির প্রকোপ নেই প্রায় কোথাও। তবে এখনো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিন করোনা পরিস্থিতি জানায়। তাদের দেওয়া তথ্য বলছে, এখন অনেক দিন দেশ করোনা-শূন্য থাকে। কোনো কোনো দিন আবার এক বা একাধিক সংক্রমণ থাকে। তবে রোগের তীব্রতা তৈরির ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম। তবে যে কোনো সময় এই চরিত্রের পরিবর্তন হতে পারে। বয়স্ক মানুষ, দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষ, শিশু, গর্ভবতী নারী এবং নানা কারণে যাদের শরীরের রোগপ্রতিরোধ শক্তি কম তারাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
দেশে গত মে মাস থেকেই করোনার প্রকোপ বাড়ছে। নতুন সমস্যা হলো। এরই মধ্যে করোনার একটি নতুন ধরন শনাক্ত হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও প্রচুর সংক্রমণে সক্ষম নতুন এক ধরন বা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে তাঁরা আশ্বস্ত করেছেন, করোনা বাড়তে থাকলেও পরিস্থিতি ভীতিকর নয়।আর যেহেতু বাংলাদেশে পরিবেশ দূষিত, তাই সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজের সুরক্ষা নিজেকেই নিতে হবে। ধুলোবালি থেকে বাঁচতে মাস্ক পরতে হবে। হাত স্যানিটাইজ করতে হবে। একটা ভাইরাস দেহে থাকতে, আরেকটি প্রবেশ করলে তখন ওই ব্যক্তির সংকটাপন্ন অবস্থা তৈরি হয়। এ জন্য ঘরেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। জনবহুল এলাকা, ভিড় থেকে শিশুকে যতটা সম্ভব দূরে রাখুন। কোভিডকালের মতোই মুখে মাস্ক এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার উপর আবারও জোর দেওয়া উচিত। এই রোগ ছোঁয়াচে। সুতরাং সাবধানতা অবলম্বন না করলে, বিপদ বাড়বেই। এই মৌসুমে ঘোরাঘুরি, উৎসব, অনুষ্ঠান বেড়ে যায়। যেকোনো রকম জনসমাগম, উৎসব, অনুষ্ঠান, ভিড় এড়িয়ে চলুন। উৎসব অনুষ্ঠান করতে হলে সীমিত পরিসরে অল্পসংখ্যক মানুষকে নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ইমিউনিটি বুস্টআপ হয় এমন খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। সবাইকে।সচেতনতা, ব্যক্তিগত সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
লেখক : চিকিৎসক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
[email protected]
প্যানেল