ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২

‘বাবা’ বলার মতো সন্তান আছে, ডাক নেই

বাবা আছে, ডাক নেই— প্রতিবন্ধী সন্তানের পিতৃত্ব এক নীরব যুদ্ধ

নিজস্ব সংবাদদাতা, ডেমরা, ঢাকা

প্রকাশিত: ১৭:৩৩, ১৫ জুন ২০২৫

বাবা আছে, ডাক নেই— প্রতিবন্ধী সন্তানের পিতৃত্ব এক নীরব যুদ্ধ

ছবিঃ এআই দিয়ে তৈরি

বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী সন্তানের পিতৃত্ব এক নিঃশব্দ, অদৃশ্য যুদ্ধ। প্রতিদিন হাজারো পরিবার লড়ছে চিকিৎসা, দারিদ্র্য, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অসহায় বাস্তবতার সঙ্গে। আর এই লড়াইয়ের অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে যিনি সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নেন, নিঃশব্দে সব সহ্য করেন—তিনি বাবা।

মো. নজরুল ইসলাম পেশায় একজন টেলিভিশন মেকানিক। সারাদিন নষ্ট সার্কিট ঠিক করেন, পুরনো টিভি আর ফ্যান মেরামত করেন। সামান্য আয়ে কোনোভাবে চলে সংসার। সেই কষ্টের সংসারের একমাত্র আলো, একমাত্র ভরসা—তার মেয়ে জোছনা। জন্ম থেকেই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। ছোটবেলায় নজরুল ভেবেছিলেন, হয়তো সময়ের সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সময় গড়িয়েছে, স্পষ্ট হয়েছে—মেয়েটি সাধারণ কিছু বিষয়ও বুঝে না।

জোছনার বয়স এখন ১৮। অন্য মেয়েরা যখন কলেজ, বিয়ে কিংবা ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর, জোছনা তখন নিজের নামটিও ঠিক করে বলতে পারে না। দরজা খোলা পেলেই বেরিয়ে পড়ে, পথ হারিয়ে ফেলে। কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে বলে, “আ… আমি… যোস…”—সেখানেই থেমে যায়। ঠিকানাও বলতে পারে না। ভাগ্য ভালো থাকে বলেই কেউ কেউ চিনে ফেলে, নয়তো হারিয়ে যেতে পারত চিরতরে।

মো. নজরুল বলেন, “আমার দিন শুরু হয় মেয়ের দাঁত মাজানো আর মুখ ধোয়ানোর মধ্য দিয়ে। খাওয়ানো, পরিষ্কার করা, চুল আঁচড়ে সাজানো—সবই আমি করি। দোকানে থাকলেও মন পড়ে থাকে মেয়ের দিকে। রাতে ফিরে আবার সব করি আমি। অভ্যাস হয়ে গেছে। ভালোই লাগে। কারণ, সে আমার মেয়ে। ওর জন্যই তো সব করি।”

অন্যদিকে স্বপন আহমেদ—একজন সফল ব্যবসায়ী। তার সব কিছুই আছে। কিন্তু নেই একটাই জিনিস—স্বস্তি। কারণ, তার একমাত্র মেয়ে অহনা জন্ম থেকেই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। সে কথা বলতে পারে না, হাঁটতেও পারে না; শুধু বিছানায় শুয়ে থাকে আর অপলক তাকিয়ে থাকে বাবার মুখের দিকে। চিকিৎসক, কবিরাজ, ঝাড়ফুঁকের ওঝা—কোনো কিছুরই কমতি রাখেননি তিনি। একটাই আশায় ছুটে বেড়িয়েছেন—মেয়ে একদিন ‘আব্বু’ বলে ডেকে উঠবে।

স্বপন আহমেদ বলেন, “প্রতিদিন আল্লাহর কাছে দোয়া করি—আমার মেয়ে, যাকে আমি আদরে ‘মা’ ডাকি, একদিন হাঁটবে, হাসবে, স্কুলে যাবে। জানি না, সেই দিন কখনো আসবে কি না। তবুও আমি অপেক্ষা করি—সেই একটিমাত্র মুহূর্তের জন্য, যা আমার স্বপ্ন নয়, জীবনের মানে।”

আজ বাবা দিবস। অথচ নজরুল আর স্বপনের মতো অসংখ্য বাবার কাছে এই দিনটি শুধুই এক নীরব প্রতীক্ষা। যাদের সন্তানেরা জানেই না ‘বাবা’ মানে কী—কেউ উচ্চারণ করতে পারে না, কেউ বোঝেই না। তবুও তারা রাগ করেন না, অভিযোগ করেন না, আশা ছাড়েন না। তারা জানেন না, তাদের সন্তান কখনো ‘স্বাভাবিক’ হবে কি না, বা সমাজের চোখে ‘সফল’ বলে পরিচিত হবে কি না। তবুও তারা পাশে থাকেন—দিবসে নয়, প্রতিদিন। কারণ, “বাবা” মানে শুধু একটি সম্পর্ক নয়—এটি এক নীরব যুদ্ধ, অসমাপ্ত প্রতিজ্ঞা আর অসীম ভালোবাসার নাম।

ইমরান

×