ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২

সমবায় কি কৃষক জানে না

শতদল বড়ুয়া

প্রকাশিত: ১৭:০৭, ১৫ জুন ২০২৫

সমবায় কি কৃষক জানে না

সমবায়ের আভিধানিক অর্থ হলো- সম্মিলিত উদ্যোগে কোনো কিছু গড়ে তোলার প্রয়াস। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। যে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাঠে ফসল ফলায় সেই কৃষক জানে না সমবায় কি বা সমবায়ের অর্থ কি। গ্রামের এক স্বচ্ছল কৃষক, সে আবার সমাজপতিও। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের কোনো সংগঠন আছে? সে ছানাবড়া চোখে বলল, এটা আবার কি জিনিস। এতশত বুঝি না, রাত কাটাই ঘরে, দিন কাটাই বিলে। তবুও ঠিকঠাক মতো সংসার চালাতে পারি না। এদিকে আবার সমাজের লোকের কথাও ভাবতে হয়। তাদের জ্বালায় অস্থির থাকতে হয় অহোরাত্র। 
এবার তাকে বুঝিয়ে বললাম, নিজে কষ্ট কর, পরের সুখ-দুঃখে সময় দাও, নিজের সুখের কথা চিন্তা না করে সমাজের মানুষের সেবা করো- এটাইতো একটা সংগঠনের মতো কাজ। তোমরা যে কৃষি কাজ কর, তোমাদের জন্যও সরকার একটা সংগঠন গঠন করেছে- সেটাকে বলে ‘সমবায়’। এত কিছু বলার পরও তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারিনি। 
এতে প্রতীয়মান হয়, যাদের জন্য সমবায়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তারা যেন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। এ মুহূর্তে একটা কথা মনে পড়লো। কথাটি অবশ্য লোকমুখে শুনেছি। কথাটি এ রকম- ‘লর্ড গভর্নর গভীর রাতে পাকিস্তানের জিন্নাহকে ফোন করে পেয়ে গেল। লর্ড জিন্নাহকে বলল, কি ব্যাপার জিন্নাহ সাহেব, এত রাতেও আপনি জাগ্রত আছেন, ভারতের নেহেরুকেফোন করে পেলাম না। জিন্নাহ লর্ডের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, কি করব, এটা আমার ভাগ্যের ব্যাপার। ভারতের জনগণ সচেতন বিধায় নেহেরু শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন। আমার দেশের জনগণ অসচেতন বলে আমি গভীর রাত পর্যন্ত জেগে আছি।’
এই উক্তিটি এখানে তুলে ধরলাম আমাদের দেশের কৃষক সমাজ অসচেতন বলে। সরকার কৃষকের সুবিধার জন্য নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, অথচ কৃষক সমাজ এর অনেক কিছুই জানে না। এর জন্য কৃষক সমাজকে সরাসরি দায়ী করাও ঠিক হবে না। যাদের সমবায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের কাজের জবাবদিহিতা নেই বলে কৃষক সমাজ প্রায় অন্ধকারে নিমজ্জিত। 
সমবায়ের জন্মদাতা হলেন জার্মানির এক অর্থনীতিবিদ। তাঁর নাম রাইফিজেন। তিনি জার্মান সমাজ সংস্কারক। মহাজনদের অত্যাচার থেকে কৃষক সমাজকে রক্ষা করার জন্য সমবায় আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সমবায়ের জনক হলেন উইলিয়াম নিকলসন। এখানে ভারত উল্লেখ করলেও সেই ১৯০৪ সালের কথা। তখন ভারত উপমহাদেশ। তদানিন্তন সরকার দারিদ্র্য নির্মূল করার জন্য সমবায়ের নীতি গ্রহণ করেন এবং একটা ঋণদান সমিতি আইন পাস করেন। এই আইনকে কেন্দ্র করে গ্রাম, শহর, নগর, বন্দর, কৃষক, কারিগর ও স্বল্পবিত্ত মানুষের মধ্যে সমবায়িক কর্মপ্রচেষ্টা বিস্তৃতির পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। সমবায় আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য ১৯১২ সালের সমবায় সমিতি আইন পাস করা হয়। এই আইনে ঋণদান সমিতি ব্যতীত ক্রয়-বিক্রয়, উৎপাদন প্রভৃতিতে কার্যরত অনুরূপ সমিতিগুলোকে সমবায় সমিতিরূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এখানে উল্লেখ্য, এ সময়েই কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সমবায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। 
১৯১৯ সালে ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে সমবায়কে প্রাদেশিক সরকারের আওতাভুক্ত করা হয়। পাকিস্তান আমলে সমবায় ঋণদান সংস্থা, সমবায় কৃষি ব্যাংক, বিক্রেতা সমবায় সমিতি আইন এবং সমবায় বীমা সমিতি ইত্যাদি গড়ে উঠলেও প্রচার প্রচারণা তেমন না থাকায় এগুলো তলিয়ে যায়। এজন্য এককভাবে সরকারকেই দায়ী করা যেতে পারে। এতো গেল বাইরের দেশের প্যাঁচাল। আমাদের দেশ তথা ঘরের খবরই বা আমরা কয়জনে রাখছি। সমবায়ের খবর রাখা কিন্তু সকলের নৈতিক দায়িত্ব এবং কর্তব্য বলে মনে করি। আমরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার কতটুকু মূল্যায়ন আমরা করছি, রাষ্ট্রীয় মৌলনীতিমালার মধ্যে সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যবস্থা রয়েছে। এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে সমবায়ের কোনো বিকল্প নেই। 
একটি কথা সত্যি যে, বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটা দরিদ্র দেশ। দরিদ্র দেশের মূল ভিত্তি হচ্ছে কৃষিকাজ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিশেষ করে কৃষি ক্ষেত্রে সমবায়ের বেশ গুরুত্ব রয়েছে। যে কৃষক সারাক্ষণ হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও সারা বছরের ভাতের সংস্থান করতে পারে না, তারা নানা কারণে উল্টো জড়িয়ে যায় ঋণে। কৃষিজমি বংশ পরম্পরায় হয়ে যাচ্ছে টুকরো টুকরো। মৌসুমের পাকাধান তুলে দিতে হয় মহাজনদের গোলায়। কারণ ঋণের টাকা পরিশোধ হিসেবে নিজের ধান নিজেই তুলে দিতে বাধ্য হয় সুদখোর মহাজনদের হাতে। 
কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণেও রয়েছে নানা ঝক্কিঝামেলা। যে দেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর এবং শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল, সে দেশে সমবায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। সমবায়ের মাধ্যমে উন্নত বীজ, সার প্রয়োগ এবং একত্রে চাষাবাদে অধিক ফসল উৎপাদন কোনো দুরূহ ব্যাপার নয়। কাজেই বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলন জনপ্রিয় করে সমবায়ের মাধ্যমে উন্নত ধরনের বৈজ্ঞানিক চাষাবাদ, কুটির শিল্পের প্রসার, মূলধন সংগ্রহ, কৃষিপণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সমবায়ের প্রয়োগ ঘটাতে পারলে কৃষকের দুর্গতিলাঘবের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি হবে সবল। 
সমবায়ের উপকারিতা বহুবিধ। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যেমন সফলতার গ্যারান্টি পাওয়া যায়, সমবায়ও ঠিক একই ব্যাপার। একত্রে মূলধন বিনিয়োগ করে উৎপাদন ব্যবস্থাকে সহজ ও জনকল্যাণকর করে তোলা যায়। সমবায়ের মাধ্যমে উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী সুলভ মূল্যে জনগণের মধ্যে বিক্রি করাও সম্ভব। সমবায়ের মাধ্যমে সহজে নানা অসুবিধা দূর করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, কয়েকজন মিলে একটা শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করলে এককভাবে কারো ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি হয় না এবং একক লোভের বশবতী হওয়ারও কোনো সুযোগ থাকে না। কারণ সমবায় প্রতিষ্ঠানে অংশীদারগণ মালিক নয় বলে পরস্পরের মধ্যে সাম্যভাব গড়ে ওঠে এবং অধিকতর সহযোগিতার ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। 
সমবায়ের মাধ্যমে বেশি সুফল ভোগ করতে পারে কৃষক। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টির হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য পাওয়ার পাম্পের সাহায্যে সেচ ও পানি নিষ্কাশন সহজ হয়। এক কথায় অভিন্ন স্বার্থে স্বল্পবিত্ত লোকেরা সামান্য সম্পদ বিনিয়োগ করে উপকৃত হয় বলে সমগ্র বিশ্বে সমবায় প্রতিষ্ঠান আজ এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। 
বাংলাদেশের মতো দারিদ্র্যপীড়িত দেশে কোটি কোটি দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের প্রয়োজনে পরস্পরের ক্ষুদ্র স্বার্থের কথা না ভেবে সমবায় আন্দোলন চাঙা করতে পারলে সকলের জন্য ভালো হয়। সমবায়ের কার্যকারণ প্রচার প্রসারে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে গ্রামের তৃণমূল পর্যায় থেকে। ছোটখাটো প্রতিষ্ঠানে সমবায় কিছুটা হলেও সক্রিয় আছে বলে ধরে নেওয়া হলেও সাধারণ কৃষক সমবায় কি, এর কার্যকারিতাইবা কি, এর থেকে কি কি সুবিধা-অসুবিধা ভোগ করা যায় এসবের কিছুই অবগত নয়। এর দ্রুত অবসান ঘটাতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক

প্যানেল

×