
ছবি: সংগৃহীত
প্রেম— এমন একটি অনুভূতির নাম, যার গভীরতা মাপা যায় না, যার রঙ ধরা যায় না হাতে, কিন্তু হৃদয়ে সে রঙ ছড়িয়ে দেয় নিঃশব্দে। সেই নিঃশব্দ ভালোবাসাকে যেন শব্দ, সুর আর রঙে রূপ দিয়েছেন পরিচালক মণি রত্নম, কবি গুলজার, আর সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহমান। ‘দিল সে’ চলচ্চিত্রের গান ‘সাতরঙ্গি রে’ শুধুমাত্র একটি রোমান্টিক গানের দৃশ্য নয়— এ এক প্রেমের রঙিন ভ্রমণ।
এই গানটির মাধ্যমে আরব্য সাহিত্যে বর্ণিত প্রেমের সাতটি ধাপকে অসাধারণ ভঙ্গিতে চিত্রিত করা হয়েছে। প্রতিটি ধাপের সঙ্গে মিলিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে রংধনুর এক একটি রঙ, এবং প্রতিটি রঙেই ধরা পড়েছে প্রেমের এক একটি পর্ব, এক একটি অনুভূতি, এক একটি আত্মিক সত্য।
প্রথম ধাপ – দিলকশি (কালো রঙ: আকর্ষণ)
প্রেমের শুরু সেই রহস্যময় আকর্ষণ দিয়ে, যখন চোখ খুঁজে ফেরে একটি মুখ, যার নাম এখনও অজানা, যার ছায়া তবু হৃদয়জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এই ধাপে মনীষা কৈরালাকে দেখা যায় কালো পোশাকে। তিনি যেন অন্ধকারে জ্বলে ওঠা এক আলো, এক অপার রহস্য। “কোই খ্বাব হ্যায়, বা পরছাঁই হ্যায়, সাতরঙ্গি রে” — নায়ক বুঝতে পারেন না তিনি কি সত্যিই আছেন, না কি শুধু কল্পনায়।
দ্বিতীয় ধাপ – উন্স (হালকা গোলাপি রঙ: মোহ)
আকর্ষণের পর আসে মৃদু মোহ, যেখানে অনুভবের সূক্ষ্ম ছোঁয়ায় হৃদয়ে জন্ম নেয় কোমল এক বন্ধন। এই দৃশ্যে নায়িকার পোশাক হালকা গোলাপি—মাধুর্য আর কোমলতার প্রতীক। “আঁখোঁনে কুছ অ্যায়সে ছুয়া, হালকা হালকা উন্স হুয়া” — চোখের চাহনিতেই প্রেমের মৃদু পরশ।
তৃতীয় ধাপ – মহব্বত (কমলা রঙ: ভালোবাসা)
এটি সেই ধাপ যেখানে প্রেম গাঢ় হয়, আবেগ প্রবল হয়। ভালোবাসা রূপ নেয় আগুনের মতো, যা জ্বলে ওঠে হৃদয়ের প্রতিটি কোণে। নায়িকা এখানে কমলা রঙের পোশাকে, আর পিছনে আগুনের শিখা—প্রেম যেন এক উষ্ণ দাবানল। দুজনের দেহে নাচের ভাষায় প্রকাশ পায় প্রেমের তীব্রতা।
চতুর্থ ধাপ – আকিদত (হলুদ রঙ: বিশ্বাস)
প্রেমের গভীরে প্রবেশ করতে হলে চাই বিশ্বাস। চোখের ভাষা, নীরবতা আর নির্ভরতা এই স্তরের পরিচায়ক। “ছুঁটি হ্যায় মুঝে সরগোশি সে, আঁখোঁ মে ঘুলি খামোশি সে” — প্রেম এখানে মৌন, কিন্তু মর্মস্পর্শী।
পঞ্চম ধাপ – ইবাদত (সবুজ রঙ: উপাসনা)
এটি প্রেমের এমন এক ধাপ, যেখানে প্রিয়জন হয়ে ওঠেন উপাসনার বস্তু। ভালোবাসা তখন আর পার্থিব থাকে না, রূপ নেয় আধ্যাত্মিকতায়। নায়িকা সবুজ পোশাকে, আর শাহরুখ তাঁর সামনে সিজদাহ করেন। প্রেমিক যেন প্রেমিকার পায়ে মাথা রেখে আত্মসমর্পণ করছেন।
ষষ্ঠ ধাপ – জুনুন (লাল রঙ: উন্মাদনা)
এ ধাপে প্রেম পরিণত হয় একপ্রকার উন্মাদনায়। প্রেমিক হয়ে পড়েন এতটাই মোহাবিষ্ট যে আর কিছুই দেখেন না, বোঝেন না। পর্দা জুড়ে থাকে উজ্জ্বল লাল আলো, যা উন্মাদ ভালোবাসার প্রতীক। দুজন একসাথে জলে নৃত্য করেন, নায়িকার পোশাক রূপ নেয় নীল আর বেগুনিতে— সে এখন প্রেমিকের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সপ্তম ধাপ – মওত (সাদা রঙ: মৃত্যু)
সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে তীব্র ধাপ— মৃত্যু। এই মৃত্যু দুঃখজনক নয়, বরং এক অনন্ত প্রেমের প্রতীক। এটি সেই মুহূর্ত, যেখানে প্রেম শরীর ছেড়ে চিরন্তনে রূপ নেয়। গানের শেষে দুজনেরই পোশাক সাদা, প্রেমিকা প্রেমিককে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। গানে বারবার ফিরে আসে—“ইশক পার জোর নেহি” — প্রেম জোর করে হয় না, সে নিজে থেকেই আসে, নিজে থেকেই প্রবাহিত হয়।
‘সাতরঙ্গি রে’ তাই কেবল একটি গান নয়, এটি প্রেমের রংধনু, একটি আত্মার যাত্রা— যেখানে প্রেম শুরু হয় দৃষ্টির আকর্ষণে, আর শেষ হয় চিরন্তন আত্মিক মিলনে। এই গান আমাদের মনে করিয়ে দেয়— প্রেম কেবল অনুভব নয়, তা এক এক করে সাতটি রূপে প্রকাশিত এক বিশাল কাব্য।
এম.কে.