ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

আজ বিশ্ব বাবা দিবসঃ বাবা, যিনি নিজে ভেঙে আমাকে গড়েছেন!

সোহানুর রহমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, সরকারী রাজেন্দ্র কলেজ

প্রকাশিত: ০১:০৫, ১৫ জুন ২০২৫

আজ বিশ্ব বাবা দিবসঃ বাবা, যিনি নিজে ভেঙে আমাকে গড়েছেন!

ছবি: সংগৃহীত

স্কুলে যখন রচনা লিখতাম —“আমার বাবা”, আমি লিখতাম: “আমার বাবা একজন স্কুল শিক্ষক। তিনি খুব ব্যস্ত থাকেন। আমি তাঁকে খুব ভালোবাসি।” বাস্তবে সেই বাবারা কেমন? সকালবেলা মুখে চা, হাতে খবরের কাগজ। বিকেলে পকেটে বাজারের লিস্ট। মাঝেমাঝে পরীক্ষার খাতায় সই করা।‌ আর সন্ধ্যেবেলা পড়তে না বসলে ধমক দেওয়া। বাবা বলতে এটুকুই বুঝতাম। বাবারা কখনো বলেন না, ‘আমি তোকে ভালোবাসি’। অন্তত আমার বাবা নয়। কিন্তু তার মতো করে কেই বা ভালোবাসে? যেমন—যখন চৈত্রের বিকালে জ্বর নিয়ে ঘুমিয়ে আছি , তখন মাথায় ভেজা তোয়ালে রাখেন যে মানুষটি, তিনিই বাবা যিনি ক্লান্ত, চিন্তিত, কষ্টে থাকা একজন সাধারণ মানুষ—যিনি নিজের স্বপ্ন বাদ দিয়ে আমাদের স্বপ্ন দেখাতে শেখান!

জীবনের প্রতিটি সংগ্রামের, ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠা, খুব সামান্য থেকে অসামান্য হয়ে ওঠা গল্পের পিছনে মহানায়ক তিনি। জুন মাসের তৃতীয় রবিবার পালিত হয় বিশ্ব বাবা দিবস। তবে এই দিনটি রয়েছে বিস্তার ইতিহাস। ফাদার্স ডে প্রথম উদযাপিত হয় ১৯১০ সালের ১৯ জুন, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের স্পোকেন শহরে। এক তরুণী, সোনোরা স্মার্ট ডড, তাঁর বাবা উইলিয়াম স্মার্ট-এর সম্মানে এই উদ্যোগ নেন। তিনি ছিলেন একজন সিভিল ওয়ারের প্রবীণ সৈনিক, যিনি স্ত্রী মারা যাওয়ার পর একাই ছয় সন্তানকে বড় করেন।

এর আগে, ১৯০৮ সালে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার মনঙ্গাহ খনি দুর্ঘটনায় নিহত প্রায় ৩৬০ জন বাবার স্মরণে প্রথম ফাদার্স ডে আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন গ্রেস গোল্ডেন ক্লেটন। যদিও তা ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়নি, ডডের প্রচেষ্টায় দিনটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পায়।

১৯৭২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ফাদার্স ডে-কে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। আজ তা শুধু আমেরিকা নয়, বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বাবার প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতার দিন হিসেবে।

২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর—ভারত মহাসাগরীয় সুনামির দিন। ইন্দোনেশিয়ার আচে প্রদেশ, ভূমিকম্পের পর আছড়ে পড়ল ভয়াল ঢেউ। লক্ষাধিক মানুষ মারা গেলেন। সেদিনের সংবাদমাধ্যম, উদ্ধারকারী দল আর ইতিহাসের পাতায় বারবার উঠে এসেছে একটি নাম—রিসওয়ান, একজন নাম না-জানা সাধারণ শ্রমজীবী বাবা।

রিসওয়ান তাঁর তিন সন্তানকে নিয়ে বাড়ির কাছে খেলছিলেন যখন পানির স্রোত এসে সবকিছু গিলে ফেলতে শুরু করে। চারদিক থরথরিয়ে কাঁপছে। অনেকেই ছুটে পালাতে শুরু করলেন। কিন্তু রিসওয়ান দাঁড়িয়ে থাকলেন—এক হাতে এক সন্তান, কাঁধে আরেকজন, কোলে ছোট্ট মেয়ে। তিনি তাঁদের একে একে একটি উঁচু দালানের ছাদে তুলে দেন। কিন্তু নিজের জন্য সময় আর ছিল না। ঢেউ এসে তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পরদিন উদ্ধারকারীরা যখন তাঁর নিথর দেহ খুঁজে পান, তখন তাঁর হাত দুটি ছিল ওপরে তোলা—যেন শেষ মুহূর্তেও সন্তানদের দিকে বাড়ানো।

রিসওয়ানের ত্যাগ কখনও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পায়নি, তাঁর নাম নেই কোনও স্মারক ফলকে। কিন্তু তাঁর বেঁচে যাওয়া সন্তানরা বলেন, “আমাদের বাবা আমাদের জীবন দিয়ে বাঁচিয়ে গেছেন। তিনি ছিলেন আমাদের আসল নায়ক।”

বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরের অলিগলিতে এমন বহু বাবা আছেন যাঁদের গল্প হয়তো আলোচনায় আসে না। কৃষক বাবা যিনি নিজের কষ্ট করে ছেড়া লুঙ্গি পরে ছেলের কোচিং ফি মেটান, রিকশাচালক বাবা যিনি মেয়ের স্কুলে যেতে প্রতিদিন ১০০ কিলোমিটার রিকশা চালান তাঁরা প্রত্যেকেই একেকজন রিসওয়ান।

ফাদার্স ডে বাবাকে একদিন উপহার দেওয়া আনুষ্ঠানিকতা নয়, হোক আত্মবিশ্বাসী হয়ে তাঁর চোখে চোখ রেখে বলা—“আমি গর্বিত, তুমি আমার বাবা, তোমাকে ভালোবাসি বাবা।”

আমরা কত সহজে মা কে ভালোবাসা জানাই, কিন্তু বাবাদের ভালোবাসি বলতে কুণ্ঠিত হই। অথচ তাঁরাও ভালোবাসেন, ভাঙেন, কাঁদেন—শুধু নিঃশব্দে। এই দিনটি হোক সেই চুপচাপ ভালোবাসাকে একবার শব্দে তুলে ধরার সুযোগ। কারণ, বাবা মানে শুধু সংসারের হাল ধরা ব্যক্তি নন—তিনি আমাদের চরিত্র গড়ার কারিগর, সাহসের স্থপতি, জীবনের প্রথম শিক্ষক।

লেখক: সোহানুর রহমান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, সরকারী রাজেন্দ্র কলেজ

আসিফ

×