
ছবি: সংগৃহীত
“পৃথিবীতে কীভাবে বাঁচতে হয়, বাবা তা বলেন না। তিনি শুধু সারা জীবন সন্তানদের জন্য বেঁচে থাকেন।” – এই কথাটি শুধু প্রবাদ নয়, এটি হাজারো সন্তানের অন্তরের অনুভব।
আজ বিশ্ব বাবা দিবস। সন্তানের জন্য জীবনের প্রতিটি আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে যিনি পরিবারকে আগলে রাখেন, যিনি মুখে কম বলেন কিন্তু কাজে বুঝিয়ে দেন ভালোবাসা—তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর দিন। জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিনটি পালন করা হয়।
বিশ্ব বাবা দিবসের সূচনা যুক্তরাষ্ট্রে। যদিও ১৯০৮ সালে পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ফেয়ারমন্ট শহরে একটি গির্জায় প্রথম বাবা দিবস পালিত হয় বলে উল্লেখ পাওয়া যায়, তবে এই উদ্যোগটি একক প্রচেষ্টা হিসেবে গৃহীত হয়। প্রকৃতপক্ষে ১৯১০ সালে ওয়াশিংটনের স্পোকানে শহরে সোনার স্মার্ট ডোড নামের এক তরুণীর প্রচেষ্টায় প্রথম সরকারি ও সংগঠিতভাবে বাবা দিবস পালিত হয়।
ডোডের বাবা, উইলিয়াম জ্যাকসন স্মার্ট, একজন বিধবা যিনি একা হাতে ছয় সন্তানকে লালনপালন করেছিলেন। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সোনার ১৯ জুন দিনটিকে “ফাদারস ডে” ঘোষণা করার প্রস্তাব দেন। পরবর্তীতে এটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করে ১৯৭২ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এটি জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, চীনসহ বিশ্বের প্রায় ১১১টি দেশে এই দিনটি নানা আয়োজনে পালিত হয়। তবে কয়েকটি দেশে, যেমন—থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া বা ব্রাজিলে বাবা দিবস পালন করা হয় ভিন্ন তারিখে, তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, পরিবারে পিতার ভূমিকা কেবল অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নয়—তিনি নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও অধ্যবসায়ের শিক্ষা দেন। শিশু মনোবিজ্ঞানে একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হলো “father-effect”। গবেষণায় দেখা গেছে, যে শিশুদের জীবনে সক্রিয় পিতৃসঙ্গ থাকে, তাদের আত্মবিশ্বাস, একাডেমিক পারফরম্যান্স এবং সামাজিক দক্ষতা তুলনামূলকভাবে বেশি হয়।
মা যেখানে মমতার আশ্রয়, বাবা সেখানে নিরাপত্তার দেয়াল। অনেক পরিবারে বাবা তার আবেগ চাপা রেখে সারাজীবন সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে যান। বাংলাদেশে গ্রামীণ কিংবা শ্রমজীবী পরিবারে এ চিত্র আরও বেশি প্রকট। একজন রিকশাচালক বাবাও, একজন কৃষক বাবাও ঠিক একই ভালোবাসা নিয়ে সন্তান মানুষ করেন—যা বোঝা যায় কেবল উপলব্ধিতে, উচ্চারণে নয়।
বাংলাদেশে বাবা দিবস মূলত শহরকেন্দ্রিক ও মিডিয়া-প্রভাবিত উদযাপন হিসেবে পরিচিত হলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রান্তিক এলাকাতেও সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, স্কুল-কলেজে আলোচনা কিংবা পরিবারভিত্তিক ছোট আয়োজনে সন্তানেরা বাবাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, উপহার দিচ্ছে কিংবা তাদের অনুভূতি প্রকাশ করছে।
এছাড়া কিছু বেসরকারি সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাবা দিবসকে কেন্দ্র করে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন পোস্টার, ভিডিও বার্তা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।
আজকের এই দিনে আমাদের ভাবতে হবে—বাবা যেন কেবল একটি দিনের ভালোবাসার প্রতীক না হয়ে, হোন প্রতিদিনের শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার অংশ। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে কর্মব্যস্ত জীবন, প্রবাসে বসবাস বা পারিবারিক দূরত্বে অনেক সন্তান পিতার অবদানকে অবহেলা করে থাকেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সন্তানদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন বজায় রাখতে হলে ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে সময় কাটানো, খোলামেলা কথা বলা, ও একে অপরকে শ্রদ্ধা জানানো শিখতে হবে। বাবা শুধু অর্থ উপার্জনের যন্ত্র নন—তিনি একজন মানবিক সত্তা, যাঁর অনুভব, ক্লান্তি ও স্বপ্ন রয়েছে।
বাবা দিবস কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়—এটি উপলব্ধির দিন। যাদের নীরব ত্যাগ ও ভালোবাসার কারণে আমরা আজকের আমরা, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর এক ক্ষণিক মুহূর্ত। তবে এই মুহূর্তকে দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাসে পরিণত করাই হোক আমাদের সবার অঙ্গীকার—বাবাকে ভালোবাসার, শ্রদ্ধার, ও সম্মানের চোখে দেখার।
আসিফ