ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৫ জুন ২০২৫, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ভারত ॥ ক্ষমতার বাঁক বদলে কর্পোরেট মিডিয়া ও পুঁজি

মিলু শামস

প্রকাশিত: ১৯:৪১, ৩ জুন ২০২৫

ভারত ॥ ক্ষমতার বাঁক বদলে কর্পোরেট মিডিয়া ও পুঁজি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ‘যুদ্ধবাণিজ্যে’ ফুলেফেঁপে ওঠা বিড়লার গোপন লালিত নয়, প্রকাশ্য ইচ্ছাই ছিল ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হোক। সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলের কাছে তেমন প্রস্তাবও তিনি রেখেছিলেন। উনিশ শ’ছেচল্লিশ সাতচল্লিশে গান্ধী যখন কংগ্রেস নেতৃত্বের বাইরে,  খানিক একা, প্যাটেলের ক্ষমতা ও প্রভাব অনেক বেশি তখন গান্ধীর একান্ত  অনুগত ও প্রিয়পাত্র হিসেবে পরিচিত কংগ্রেসের আর্থিক ও বৈষয়িক জোগানদাতা বিড়লাও গান্ধীকে ছেড়ে প্যাটেলের ঘনিষ্ঠতা অর্জনে মনোযোগী হয়েছিলেন এবং বলার অপেক্ষা রাখে না দ্রুতই তিনি প্যাটেলের কাছাকাছি চলে আসেন। সুনীতি কুমার ঘোষ জানাচ্ছেন, ‘বাংলা ভাগ হওয়া যখন প্রায় নিশ্চিত সেই সময় প্যাটেলের কাছে বিড়লা প্রস্তাব করেছিলেন, ‘শ্যামাপ্রসাদকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী করে হিন্দু ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে হিন্দুস্তানকে হিন্দু রাষ্ট্র বলে গণ্য করা হোক।’ ভারতবর্ষের ইতিহাস- পাঠককে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পরিচয় নতুন করে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। হিন্দু মহাসভার কট্টর হিন্দুত্ববাদী এ নেতার বিশেষ প্রভাব ছিল কংগ্রেসের ওপর। বাংলা ভাগের পরিকল্পনায় শ্যামাপ্রসাদের দৃষ্টিভঙ্গিই কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। আর এ বিষয়ে বিড়লার ভূমিকা সম্পর্কে শরৎ বসু বলেছিলেন, ‘বাংলার ইতিহাসে মাড়োয়ারি জগৎ  শেঠের যে ভূমিকা ছিল উনিশ শ’ সাতচল্লিশ সালে বিড়লার ভূমিকা তেমনি।’ ‘বিড়লার আবেদন বাস্তবায়ন করা প্যাটেলের পক্ষে সম্ভব না হলেও শ্যামাপ্রসাদ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং  গান্ধী যখন মহাসভা পন্থিদের হাতে নিহত হন তখনো শ্যামাপ্রসাদ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্য। উনিশ শ’ পঞ্চাশে নেহরুর মুসলমানদের প্রতি ‘নমনীয়’ মনোভাবের প্রতিবাদে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন এবং হিন্দু মহাসভার চেয়েও উগ্রপন্থি ‘ভারতীয় জনসংঘ’কে নতুনভাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। উনিশ শ’ বায়ান্ন সালের নির্বাচনে তিনি যে চমক দেখিয়েছিলেন তা কেবল দু’হাজার চৌদ্দর মোদি-চমকের সঙ্গেই তুলনীয়। ওই নির্বাচনে তিনি দক্ষিণ কলকাতা থেকে কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট প্রার্থীকে হারিয়ে কেন্দ্রীয় সভার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ওই সময় কংগ্রেসকে হারানো উল্লেখযোগ্য ঘটনা অবশ্যই।’
শ্যামাপ্রসাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির আর্থিক উৎস যিনি বা যাই হোক তিনি ছিলেন একা। হিন্দু মহাসভার জনপ্রিয়তা ছিল না। শ্যামাপ্রসাদ ছাড়া তাদের সব প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। মোদি একা নন। দলবলসহই বিজয়ী হয়েছিলেন এবং তার বিজয়ের চাবিটি বরাবর ভারতের করপোরেট পুঁজির বৃহৎ শক্তির হাতে। রাহুল গান্ধীর মতো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণকে প্রত্যাখ্যান করে মোদির মতো গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীকে বেছে নেওয়ার অন্তর্নিহিত কারণও তাই পরিষ্কার।
মিসরীয় তাত্ত্বিক সমীর আমিন বিশ্বে একচেটিয়া আধিপত্যের পরস্পর সম্পর্কিত পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এক. প্রযুক্তিগত আধিপত্য। দুই. বিশ্বের ফিন্যান্স বাজারের নিয়ন্ত্রণ। তিন. পৃথিবীর গোটা প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ। চার. মিডিয়া ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর আধিপত্য। পাঁচ. গণধ্বংসী অস্ত্রের ওপর আধিপত্য। পুঁজিবাদী কেন্দ্রের অন্যতম শক্তিধর দেশটি বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্রের সঙ্গে এ পাঁচ বলয়ের মাধ্যমে প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখছে। রূপার্ট মারডক সিলভিয়া বার্লুসকোনি এবং দুই ওয়ারনারসহ হেনরি লুচে পৃথিবীময় দুর্দমনীয় গতিতে তাদের মিডিয়া সাম্রাজ্য বিস্তার করে চলেছেন। স্যাটেলাইট ও কেবল নেটওয়ার্কগুলোও তাদের নিয়ন্ত্রণে। মুদ্রণ শিল্প, বেতার শিল্প, চলচ্চিত্র শিল্প ইত্যাদির ওপর নিয়ন্ত্রণ তো আছেই। সমীর আমিন উল্লিখিত পাঁচ বলয়ের চারটি মোটামুটি দৃশ্যমান হলেও মিডিয়ার প্রভাব চট করে চোখে পড়ে না। এটি কেবল রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বিষয় নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিষয়টিও। এর মূল উদ্দেশ্য শুধু ব্যবসার মধ্য দিয়ে মুনাফা অর্জন নয়, একই সঙ্গে  আধিপত্যবাদী সংস্কৃতি ও মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়া। সংস্কৃতির উৎপাদন-বিনিময়-ভোগ-বণ্টনে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ব্যবসার  পাশাপাশি  এবং ব্যবসাকে  গতিশীল  রাখতেই মিডিয়া সংস্থাগুলো পৃথিবীময় বাজারী মতাদর্শ ও মূল্যবোধ ছড়ায়। এর পৌনঃপুনিক  প্রচার  মানুষের মন ও মগজে প্রভাব বিস্তার করে। চিন্তা ও মূল্যবোধকে নিয়ন্ত্রণ করে মনোজগত  গঠন করে। ভারতের  মিডিয়াগুলো বিশেষ করে টেলিভিশন মিডিয়া মানুষের মনোজগত গঠনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। বিষয়টির ভয়াবহতা বিশেষজ্ঞ ছাড়া সাধারণ মানুষের চোখে হয়তো কমই  পড়েছে। ভারতীয় সিনেমা বিশেষ করে হিন্দি ও বাংলা টিভি সিরিয়ালসহ  অন্য  অনেক অনুষ্ঠান স্লো পয়জনিংয়ের মতো কাজ করছে। আধুনিক  আউটফিটের মোড়কে উপস্থাপিত  হয় বলে ওই বিষ  সাদা চোখে ধরা পড়ে না। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া যে কত ভয়াবহ মোদির উত্থান তা চোখে  আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। অত্যন্ত নিম্নমানের রুচি ও ভাবনা মগজের  কোষে কোষে ঢুকিয়ে দিচ্ছে এ সিরিয়ালগুলো, যা থেকে তৈরি হচ্ছে পশ্চাৎপদ  মনমানসিকতা। যাতে  ভীষণভাবে  আসক্ত আমাদের  দেশের  মধ্যবিত্ত দর্শকরাও। এসবের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে মানুষের মন তৈরি হয়েছে। সেখানে নিজের ভাবমূর্তি এঁকে দেওয়ার কাজ মোদির পক্ষে তাই অনেক সহজ হয়েছে। অনেকেই মনে করেন এমন অভাবিত বিজয়ের পেছনে মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন অন্যতম ভূমিকা রেখেছে। মানুষের চিন্তায় হিন্দুত্ববাদের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে বলেই মোদির পক্ষে নিরঙ্কুশ বিজয়ী হওয়া সম্ভব হয়েছিল। চিন্তাকে প্রভাবিত করার কাজটি মিডিয়া খুব কৌশলের সঙ্গে করে। 
নোয়াম চমস্কি তাঁর এক লেখায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উঁচু পর্যায়ের চব্বিশটি বৃহৎ মিডয়া সংস্থার আধিপত্যের কথা বলেছেন। যারা নিজেরাই অনেক বড় মুনাফাভিত্তিক করপোরেশন এবং স্বাভাবিকভাবেই এদের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ এককভাবে শীর্ষ ধনীদের হাতে। এরাই বর্তমান বিশ্ব-সংস্কৃতিকে নেপথ্যে থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ভারতের শীর্ষ ধনীদেরও অনেকেই মিডিয়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এরা অর্থনীতিতে প্রভাব রাখার পাশাপাশি মিডিয়া জগতেও প্রবল প্রতাপে উপস্থিত। রিলায়েন্সের কর্ণধার মুকেশ আম্বানী ভারতের মিডিয়া কোম্পানিগুলোর অনেক শেয়ার কিনে নিয়েছেন। প্রচুর বিনিয়োগ করেছেন মিডিয়া খাতে। টিভিতে প্রচারিত বিষয়বস্তু নির্বাচনে অগ্রাধিকার পাওয়ার শর্তে এ বিনিয়োগ করা হয়। এই শর্তের গুরুত্ব অনেক। অনুষ্ঠান প্রচারে অগ্রাধিকার পাওয়ার অর্থ হচ্ছে নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণের উপযোগী অনুষ্ঠান প্রচার। ফরচুন ম্যাগাজিনের জরিপে দুই হাজার তেরো সালে বিশ্বের বৃহত্তম পাঁচ শ’ কোম্পানির তালিকায় জায়গা পাওয়া মুকেশ আম্বানী মূলত ভারতীয় মিডিয়া জগতের সম্রাট। মোদির নির্বাচনী প্রচারের ব্যয়ভারের বড় অঙ্কটি সম্ভবত আম্বানীর তহবিল থেকেই গিয়েছিল সেবার। সবই করপোরেট পুঁজির কৌশল। 
বিষয়টি হঠাৎ ঘটেনি। বিশ্ব করপোরেট পুঁজির কাছে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের জন্য সম্ভবত মৌলবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতির কদর বেড়েছে। বিড়লার আকাক্সক্ষা হয়ত এত বছর পর আম্বানী-টাটার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। 
ভারত ভাগের টানটান উত্তেজনা শুরুর সময় থেকেই কংগ্রেস মুসলিম লীগ দু’দলেরই আতঙ্কের কারণ ছিল কমিউনিস্টরা। জাতীয়তাবাদীরা ছিল সমাজবিপ্লবের বিরোধী। শ্যামাপ্রসাদের মতো কট্টরবাদীরা এমনকি মুসলমানদের সঙ্গে মন্ত্রিত্ব ভাগাভাগি করতে রাজি ছিলেন কিন্তু কমিউনিস্টদের সঙ্গে নয়। কংগ্রেস, লীগ দু’দলের জাতীয়তাবাদী নেতাদের মধ্যে ডান বামের টানাপোড়েন থাকলেও কমিউনিস্ট বিরোধিতার প্রশ্নে তাদের মধ্যে অটুট ঐক্য ছিল। 
ব্রিটিশদের চেয়েও কিমিউনিস্টরা তাদের কাছে বেশি ভীতিকর ছিল এ জন্য যে, ব্রিটিশদের কাছ থেকে তাদের ক্ষমতা পাওয়ার সুবর্ণ হাতছানি ছিল। কিন্তু সমাজ বিপ্লব শুধু যে ক্ষমতার স্বপ্ন চুরমার করবে তাই নয় তাদের শ্রেণি অবস্থানও ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। এই ভীতিই তাদের ব্রিটিশের সঙ্গে আপোসকামিতার পথে পা বাড়ানোকে দ্রুততর করেছিল।

প্যানেল

×