
দেশে এমন অনেক শিশু রয়েছে যাদের নেই কোনো জন্মপরিচয়, নেই কোনো অভিভাবক। এরা পথশিশু নামে পরিচিত। আবার অনেক শিশুর অভিভাবক থেকেও যেন নেই। তারা চরম দারিদ্র্যের কশাঘাতে অত্যন্ত বিপন্ন জীবনযাপন করে। এসব শিশু সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায় না। যত্নের অভাবে এসব শিশু দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে ওঠে। কিন্তু সঠিক সুযোগ-সুবিধা পেলে এরাই দেশের কল্যাণ বয়ে আনবে।
জন্মের পর থেকেই সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশু হয় ছন্নছাড়া প্রকৃতির। প্রচণ্ড অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করার ফলে এদের অধিকাংশই থাকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। নোংরা খাবার খাওয়ার ফলে এরা সাধারণত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। বেশিরভাগ শিশুরা ভোগে অপুষ্টিতে। অযত্নে, অবহেলায় অনেক শিশু চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রাম নামের একটি সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পথশিশুদের প্রায় ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু গোসল করতে পারে না, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই এবং ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলে ডাক্তারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারে না। অবহেলিত এসব শিশুর লেখাপড়ার কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে। পারিবারিক ও নৈতিক শিক্ষারও কোন সংস্পর্শ পায় না এরা। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৯৫ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধরনের শিক্ষাগ্রহণ করছে না। জন্মের পর থেকে এরা শেখে ভিক্ষাবৃত্তি, চুরি, ছিনতাই, মাদক কারবারি ইত্যাদি। এছাড়া পরবর্তীতে অনেকে ডাকাতি, খুন প্রভৃতি বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। কিশোর অপরাধের মূল হোতা এসব পথশিশুই। এছাড়া অনেক কুচক্রী মহল এদেরকে নানা অপরাধমূলক কাজে লাগায়। এদের মধ্যে অনেকে আবার ভয়ানকভাবে শিশুশ্রমের শিকার হয়ে পড়ে। অনেক শিশু হয় অমানুষিক নির্যাতনের শিকার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পথশিশুদের জরিপ ২০২২ -এর তথ্য মতে, নির্যাতনের শিকার পথশিশুর হার প্রায় ৯৬ শতাংশ। তাদের মধ্যে প্রায় ৬১ দশমিক ৭ শতাংশ পথশিশু শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় বা মার খায় এবং প্রায় ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু মৌখিক হুমকি পায়। জরিপে আরও বলা হয়েছে, বেশির ভাগ পথশিশু সপ্তাহে ১ হাজার টাকা বা ১০ ডলারের কম অর্থের জন্য প্রতি সপ্তাহে ৩০-৪০ ঘণ্টা কাজ করছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পথশিশুদের মধ্যে ১৪.৫ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার। এসব শিশুর অধিকাংশই চরমভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। অনেক শিশু ঠিকভাবে কথাই বলতে শেখেনি, কিন্তু এদের মাদক গ্রহণ চোখে পড়লে অবাক হতে হয়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই কোন না কোনভাবে মাদক সেবন করে। এর মধ্যে ১৯ শতাংশ হেরোইন, ৪৪ শতাংশ ধূমপান, ২৮ শতাংশ বিভিন্ন ট্যাবলেট এবং ৮ শতাংশ ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশা করে থাকে। এসব শিশুই সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অপরাধ বৃদ্ধি করে এবং সার্বিকভাবে দেশের জন্য অকল্যাণকর হয়ে পড়ে।
জনবহুল এই দেশে এমনিতেই বেকারত্বের হার উপচে পড়া। তার উপর ক্ষতিকর নাগরিক তৈরি হলে দেশকে কোনোভাবেই উন্নত করা সম্ভব হবে না। কথায় আছে, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে দেশের প্রতিটি শিশুকেই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। সঠিক যত্ন পেলে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা একসময় জনসম্পদে পরিণত হবে এবং দেশের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে শিশুদের অগ্রগতির বিশেষ বিধানের উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে শিশুদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা সহ মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, সুযোগের সমতা, অধিকার-কর্তব্য, স্বাস্থ্য এবং নৈতিকতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। শিশু মানবাধিকারের সর্বজনীন দলিল হচ্ছে ‘জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ-১৯৮৯’। বাংলাদেশ এ সনদে সই করে ১৯৯০ সালের ২৬ জানুয়ারিতে। এ সনদের ৫৪ টি ধারার মধ্যে ২৪ টি ধারা সরাসরি শিশু সুরক্ষা সংশ্লিষ্ট। এ সনদের মূলনীতিসমূহ হলো- ১. পূর্ণ মাত্রায় বেঁচে থাকার অধিকার, ২. পূর্ণ মাত্রায় বিকাশের অধিকার, ৩. নির্যাতন ও শোষণ হতে নিরাপদ থাকার অধিকার, ৪. সামাজিক জীবনে পূর্ণ মাত্রায় অংশগ্রহণের অধিকার। বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘের উদ্যোগ শুরু হয় ১৯৯৯ সালে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারকে জাতিসংঘ ও বহিঃরাষ্ট্রের সহায়তায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন উদ্যোগে কাজ শুরু করতে হবে।
এসব শিশুর সমস্যা নিরসনের জন্য স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। অবহেলিত এসব শিশুর স্বাভাবিক জীবন গঠনের পথ তৈরি করা অতটা সহজ নয়। তবে পরিকল্পনামাফিক ব্যবস্থা নিলে দ্রুত এবং কার্যকরভাবে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশব্যাপী জেলাভিত্তিক সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠান নির্মাণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ কাজে দেশ ও বিদেশের সহযোগী সংস্থা এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সহায়তাও প্রয়োজন হবে। প্রতিষ্ঠানগুলো এমন হবে, যেখানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত তাদের জীবন গঠনের সমস্ত কার্যক্রম পরিচালিত হবে। প্রতিষ্ঠানটিতে নিয়োগকৃত লোক দ্বারা নির্ধারিত অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের খুঁজে এনে প্রথমে আশ্রয় দিতে হবে। তারপর সেখানে তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর সেখানে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাদের বাসস্থান, খাবার ও পোশাকের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া সেখানে তাদের লেখাপড়ার জন্য যথাযথভাবে একটি স্কুল থাকবে, যেখানে শিশুরা পড়া-লেখার সুযোগ-সুবিধা পাবে। লেখাপড়ার পাশাপাশি শিশুদের খেলাধুলাসহ অন্যান্য প্রতিভা বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশও তৈরি করে দিতে হবে। এছাড়া দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে গরিব ও দুস্থ শিশুদের পড়ালেখার জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে দারিদ্রের কারণে কোনো শিশু পড়ালেখা থেকে অকালেই ঝরে না পড়ে। সর্বোপরি, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ ও তাদের প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং এসব শিশুর উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশের সচেতন মহলের অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখতে হবে।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা মেধা ও মননের দিক থেকে দেশের অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়, শুধু সঠিক পরিবেশ ও চর্চার অভাবে তারা পিছিয়ে আছে। অবহেলিত শিশুদের জন্য স্থায়ী সুযোগ-সুবিধা তৈরি হলে ভবিষ্যতে এসব শিশুই হবে দেশের দক্ষ নাগরিক। যার ফলে দেশ একদিকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচবে। অন্যদিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে।
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
প্যানেল