ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৫ জুন ২০২৫, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার : কে দেখবে জনস্বাস্থ্যের দায়

এ বি এম সিয়াম আহমেদ

প্রকাশিত: ১৮:৩৪, ৩ জুন ২০২৫; আপডেট: ১৮:৪৭, ৩ জুন ২০২৫

নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার : কে দেখবে জনস্বাস্থ্যের দায়

স্বাস্থ্যসেবা একটি মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু বর্তমানে সারা বাংলাদেশে চিকিৎসাব্যবস্থাকে পুঁজি করে স্বাস্থ্য খাতকে পরিণত করা হয়েছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার খোলার সুযোগ আছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটছে অসাধু একটি মহল। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন ধরনের সংকট রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়গুলোর একটি হলো অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর অবাধ বিস্তার। শহর থেকে মফস্বল, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও এখন গজিয়ে উঠেছে নানা নামের ক্লিনিক ও ডায়াগনিস্টিক সেন্টার, যাদের অধিকাংশের নেই কোন বৈধ অনুমোদন, দক্ষ জনবল কিংবা যথাযথ সরঞ্জাম। মূলত সাধারণ মানুষের অজ্ঞতাকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে এসব অবৈধ ও অনুমোদনহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার। ফলে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, ঘটছে অকাল মৃত্যুর মতো ঘটনা। অবৈধ ক্লিনিক, ডায়াগনিস্টিক সেন্টার গড়ে ওঠার দৌড়ে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে গ্রামীণ অঞ্চল। স্বাস্থ্য বিষয়ে গ্রামীণ মানুষদের মধ্যে সচেতনতার অভাব থাকায় ক্লিনিক ব্যবসায়ীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে দেশের গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা। এসব ক্লিনিকে সেবা দানে নেই দক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। ফলে মানহীন এসব ক্লিনিক ও সেন্টারে মিলছে না মানসম্মত সেবা। প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। 
মানহীন এসব প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যসেবা নিতে এসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন গর্ভবতী নারীরা। এসব ক্লিনিকে অদক্ষ ডাক্তার ও নার্স সেবাদানের ফলে গর্ভবতী মা ও নবজাতকের ঝুঁকি বাড়ছে। কখনো মা ও নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। সংবাদমাধ্যমে এমন মৃত্যুর খবর প্রায় সময়ই আমরা পেয়ে থাকি। মূলত এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনার ব্যাপারে চালু রয়েছে কমিশন ব্যবস্থা। বিভিন্ন সেন্টার অনুযায়ী কমিশনের হার ভিন্ন রকম। আর এসবের পেছনে রয়েছে সংঘবদ্ধ একটি দালালচক্র। এমনকি হাসপাতাল থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে বের হওয়ার পর দালালরা একপ্রকার জোর করেই রোগীদের তাদের পছন্দের ক্লিনিক বা সেন্টারে নিয়ে যান। একজন রোগীকে ভর্তি করালে সেই রোগীর বিভিন্ন টেস্ট বাবদ যে টাকা হাসপাতাল নেয় তার একটি অংশ কমিশন বাবদ সেই দালালশ্রেণির লোকদের দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের শেষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশে প্রায় ২০,০০০ এর বেশি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৬,০০০টির বৈধ কোন লাইসেন্স নেই। এর বাইরে আরো অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলোর লাইসেন্স থাকলেও মান বজায় রাখার ন্যূনতম শর্ত মানেনা। মূলত অযোগ্য টেকনিশিয়ান ও পুরনো যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে রোগ নির্ণয়ে ভুল হচ্ছে প্রতিনিয়ত। উদাহরণস্বরূপ- একজন ডায়াবেটিস রোগীর ভুল ব্লাড সুগার রিপোর্ট তাকে হয়তো অপ্রয়োজনীয় ইনসুলিন নেওয়ার পথে ঠেলে দিচ্ছে। আবার, ক্যান্সার সন্দেহে যার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে আসলে হয়তো তার রোগ ধরা পড়ছে না সময়মতো। 
এছাড়াও অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দেখা যায়, চিকিৎসক নামধারী ব্যক্তিরা রোগীদের পরীক্ষা করছেন, প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন অথচ তাদের কোন এমবিবিএস ডিগ্রি নেই। আবার, কোন কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টার তো পরীক্ষা না করে নিজেরাই ইচ্ছেমতো কম্পিউটারে লিখে রিপোর্ট তৈরি করে দেন। মূলত ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা এসব প্যাথলজিক্যাল ল্যাব ও এক্স-রে রুমগুলোতেও স্বাস্থ্যবিধি মানা হয় না। যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত না রাখায় একজন রোগীর দেহের সংক্রমণ অন্য রোগীর শরীরে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা  থেকে যায়। এছাড়াও এই অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো শুধু ব্যক্তি রোগীর জন্য নয়, সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি। কারণ, একটি মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট এর উপর ভিত্তি করে ডাক্তার নির্ধারিত ওষুধ লিখে থাকেন। কিন্তু এই টেস্টের রিপোর্ট-ই যদি ভুল হয় তাহলে রোগীর রোগ তো নিরাময় হবেই না, উল্টো তার শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় বা ক্ষেত্র বিশেষে ভুল অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হতে পারে। মূলত কম খরচের লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করলেও পরে নানা অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও কম্বো প্যাকেজ এর নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়। আর প্রান্তিক জনগণ এই ফাঁদে পড়ে প্রতিনিয়ত ন্যায্য চিকিৎসা সুযোগ হারাচ্ছে। জনস্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ এসব সেন্টার। মূলত স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি, এমনকি চিকিৎসা সংক্রান্ত পেশাদাররাও এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা নিয়মিত তদারকি বা মনিটরিং না করার কারণে তাদের নাকের ডগার সামনে দিয়েই এসব অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারছে। 
এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তা হলো জনসচেতনতা অভাব। সাধারণ মানুষ অনেক সময় বুঝতেই পারেন না যে তারা অবৈধ একটি সেন্টারের সেবা নিচ্ছেন। নাম, বাহারি বিজ্ঞাপন ও দালালের খপ্পরে পড়ে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ভুক্তভোগী হয়ে ফিরছেন সমাজের এক শ্রেণির পিছিয়ে পড়া মানুষ। আর এসব অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টার দৌরাত্ম্য কমাতে জাতীয় পর্যায়ে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। ডিজিটাল নিবন্ধন ও অডিট সিস্টেম চালু করে নিয়মিত পর্যালোচনা করতে হবে প্রতিটি সেন্টারের কার্যক্রম। প্রচারণা ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে মানুষকে জানাতে হবে কোন প্রতিষ্ঠানে গেলে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা পাওয়া যাবে। এর পাশাপাশি মানসম্পন্ন সরকারি ডায়াগনস্টিক সেবা সম্প্রসারণ করতে হবে যাতে জনগণ কম খরচে সঠিক সেবার নিশ্চয়তা পায়। এটি বেসরকারি হাসপাতাল ও সেন্টারগুলোর দাপট কমাতেও সহায়ক হবে। সর্বোপরি মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্যসেবা কোন পণ্য নয়- এটি মানুষের মৌলিক অধিকার। আর এই অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান এবং জনগণের সম্মিলিতভাবে। অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বন্ধ করা শুধু আইনগত নয়, বরং একটি নৈতিক ও মানবিক দায়িত্বও। জনস্বাস্থ্যকে বাঁচাতে হলে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় এই নীরব ঘাতক আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি দুর্বল স্বাস্থ্যভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দিবে।  

শিক্ষার্থী, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

প্যানেল

×