ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০১ জুন ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শিক্ষাক্ষেত্রে সংকট

প্রকাশিত: ১৯:৪৭, ৩০ মে ২০২৫

শিক্ষাক্ষেত্রে সংকট

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তর হলো প্রাথমিক শিক্ষা। এখানেই শিক্ষার্থীদের মানসিক, নৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি গড়ে ওঠে। অথচ এই মুহূর্তে দেশের প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে এক চরম সংকট দেখা দিয়েছে। সহকারী শিক্ষকরা ১১তম গ্রেডে বেতন স্কেল চেয়ে সারাদেশে কর্মবিরতি পালন করছেন। ফলে প্রায় এক কোটি শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষের পাঠদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে শিশুর শিখন-জীবনের ভিত্তি। এখানকার শিক্ষকরা শুধু পাঠদান করেন না, বরং শিশুদের মনোজগতে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি, শৃঙ্খলা রক্ষা, নৈতিক শিক্ষা প্রদান ও সামাজিক আচরণ শেখানোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বর্তমানে শিক্ষকরা কর্মবিরতিতে থাকায় শিক্ষার্থীরাও হতাশাগ্রস্ত। একটানা ক্লাস না হওয়ায় শিশুদের পাঠ্যক্রম থেকে ছিটকে পড়ার ঝুঁকি বেড়েছে। বিশেষ করে প্রান্তিক ও দরিদ্র পরিবার থেকে আসা শিশুরা যাদের বিদ্যালয়ই একমাত্র শিক্ষার উৎস, তাদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। বিদ্যালয়ে না গিয়ে অনেক শিক্ষার্থী গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে বা মাদকাশক্তি, শিশুশ্রম কিংবা সামাজিক অপরাধে জড়াতে পারে। যা দীর্ঘমেয়াদে সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ।
বর্তমান সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের অধিকাংশকে ১৩তম বা ১৪তম গ্রেডে বেতন প্রদান করছে। অথচ তারা সরকারি কাঠামোর একজন গুরুত্বপূর্ণ সেবাদাতা হিসেবে শিক্ষা খাতে ভূমিকা পালন করছেন। এই দাবির পেছনে রয়েছে কিছু যুক্তিগ্রাহ্য কারণ। একটি রাষ্ট্রের ভিত্তি গঠনের দায়িত্বে থাকা পেশাজীবীরা যদি ন্যায্য মর্যাদা না পান, তবে তাদের মনোবল ভেঙে পড়ে। এটি শিক্ষার মানেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একই ধরনের দায়িত্ব পালনকারী অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা যদি উচ্চ গ্রেড পান, তবে শিক্ষকরা কেন বঞ্চিত হবেন? এমন প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষকদের আর্থিক ও পেশাগত উন্নয়নের কথা থাকলেও বাস্তবে তা যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি। এতে শিক্ষকদের মাঝে বৈষম্যবোধ তৈরি হয়েছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে গেলে কেবল বেতন বৃদ্ধিই নয়, সামগ্রিকভাবে শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্যও একটি দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনা দরকার।
শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে, যাতে তারা জীবিকা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে শিক্ষার মান উন্নয়নে মনোনিবেশ করতে পারেন। নিয়মিত প্রশিক্ষণ, উচ্চ শিক্ষা, সেমিনার ও কর্মশালার ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে শিক্ষকরা নতুন প্রযুক্তি ও পাঠদান কৌশলে দক্ষ হয়ে ওঠেন। বিদ্যালয় ভবন, শ্রেণিকক্ষ, টয়লেট, খেলার মাঠসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নত না হলে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। শিক্ষকের কার্যকারিতা ও শিক্ষার্থীদের শিখনের মান নিয়মিতভাবে মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন সম্ভব। বিদ্যালয়ের কার্যক্রমে অভিভাবক ও স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে, যাতে শিক্ষা শুধু বিদ্যালয়ের বিষয় না হয়ে সমগ্র সমাজের দায়িত্বে পরিণত হয়।
সহকারী শিক্ষকদের চলমান আন্দোলন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি গভীর ও প্রথাগত সমস্যাকে সামনে নিয়ে এসেছে। শুধু তাৎক্ষণিক বেতন বৃদ্ধি নয়, এই সংকটের সমাধান হতে হবে পেশাগত মর্যাদা, আর্থিক নিরাপত্তা এবং গুণগত শিক্ষার নিশ্চয়তার ভিত্তিতে। এক কোটি শিশুর ভবিষ্যৎ যেন পেশাগত বৈষম্যের বলি না হয়, সে বিষয়ে সরকার, শিক্ষক ও সমাজের সকল পক্ষকে দায়িত্বশীল হতে হবে।

প্যানেল

×