ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০২ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

নতুন বিশ্বযুদ্ধের কারণ হতে পারে রেয়ার আর্থ নামক দুর্লভ খনিজ

প্রকাশিত: ০১:১৯, ১ জুন ২০২৫

নতুন বিশ্বযুদ্ধের কারণ হতে পারে রেয়ার আর্থ নামক দুর্লভ খনিজ

ছবি: সংগৃহীত

২০১০ সালে জাপানের প্রযুক্তি খাতে হঠাৎ এক গভীর ধাক্কা লাগে। স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, যুদ্ধবিমান থেকে শুরু করে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিপণ্যের উৎপাদন আচমকাই পড়ে যায় অনিশ্চয়তার মুখে। গোটা বিশ্ব প্রযুক্তিনির্ভর দেশগুলো তখন চমকে ওঠে। আর এই বিপর্যয়ের পেছনে ছিল চীনের একটি ছোট কিন্তু কৌশলগত সিদ্ধান্ত—জাপানে রেয়ার আর্থ এলিমেন্টের রপ্তানি সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা।

ঘটনাটি শুরু হয় পূর্ব চীন সাগরের সেনকাকো দ্বীপপুঞ্জের কাছে। সেখানকার জাপানি কোস্টগার্ড একটি চীনা মাছ ধরার ট্রলার আটক করে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় চীন জাপানে রেয়ার আর্থ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এতে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, কারণ জাপান তখন রেয়ার আর্থের জন্য শতভাগ চীনের উপর নির্ভরশীল ছিল। চীনের এই সিদ্ধান্ত প্রযুক্তি শিল্পে এক গভীর সংকট ডেকে আনে।

রেয়ার আর্থ এলিমেন্ট আসলে ১৭টি খনিজ উপাদানের একটি গ্রুপ, যার মধ্যে রয়েছে ১৫টি ল্যান্থানাইড ধাতু, স্ক্যান্ডিয়াম ও ইট্রিয়াম। স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি, ইলেকট্রিক মোটর, উইন্ড টারবাইন, ক্ষেপণাস্ত্র এবং এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান তৈরিতে এই উপাদানগুলো একেবারে অপরিহার্য। একটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান তৈরি করতে প্রায় ৪০০ গ্রাম রেয়ার আর্থ লাগে। এমনকি মিওডিমিয়াম নামক একটি উপাদান, যা রেয়ার আর্থেরই অংশ, শক্তিশালী চুম্বকের জন্য অপরিহার্য।

‘রেয়ার’ নাম থাকলেও এই উপাদানগুলো প্রকৃতিতে খুব একটা বিরল নয়। পাহাড়, মাটি এমনকি সমুদ্রের নিচেও এগুলোর অস্তিত্ব রয়েছে। তবে সমস্যাটি হলো, এগুলোকে খনিজ থেকে আলাদা করে বিশুদ্ধভাবে প্রযুক্তির উপযোগী করতে গেলে অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য ও রেডিওঅ্যাকটিভ পদার্থ তৈরি হয়।

১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে পশ্চিমা দেশগুলো পরিবেশ রক্ষার লক্ষ্যে কঠোর নিয়ম চালু করায় রেয়ার আর্থের উৎপাদন একপ্রকার বন্ধ করে দেয়। আর এই ফাঁকেই চীন এগিয়ে আসে। পরিবেশগত ঝুঁকি বা জনস্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করেই তারা ব্যাপক উৎপাদনে নামে। বাউতৌ নামক অঞ্চলকে তারা একপ্রকার ‘স্যাক্রিফাইস জোন’ হিসেবে ব্যবহার করে, যেখানে বর্জ্য ফেলে রাখা হয় ছোট ছোট নালার মাধ্যমে।

ফলাফল? বর্তমানে বিশ্বে রেয়ার আর্থ উৎপাদনের প্রায় ৭০ শতাংশ এবং প্রক্রিয়াকরণের ৯০ শতাংশই চীনের নিয়ন্ত্রণে। চীন এখন বিশ্ববাজারে প্রায় ৯৫ শতাংশ রেয়ার আর্থ সরবরাহ করে এবং পশ্চিমা দেশগুলোকে সস্তা দামে সরবরাহ দিয়ে তাদের উপর নির্ভরশীল করে তুলেছে।

২০১০ সালের ঘটনার পর পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র চীনের এই আধিপত্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। কারণ সামরিক খাতও রেয়ার আর্থের উপর নির্ভরশীল। ভবিষ্যতে যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ চীন হয়, আর তখন যদি চীন রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, তবে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তিও হুমকিতে পড়তে পারে। তাই যুক্তরাষ্ট্র এখন স্বনির্ভরতার পথে এগোচ্ছে। তারা ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন পাস খনি পুনরায় চালু করেছে এবং অস্ট্রেলিয়ার লাইনাস কর্পোরেশনের মতো বিকল্প উৎসে বিনিয়োগ করছে।

অস্ট্রেলিয়ার এই কোম্পানিটি দীর্ঘদিন ধরে জাপানে রেয়ার আর্থ সরবরাহ করে আসছে। এতে চীনের উপর নির্ভরতা কিছুটা হলেও কমছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র নজর দিয়েছে গ্রীনল্যান্ডে, যেখানে বিপুল পরিমাণ রেয়ার আর্থ মজুদ রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন গ্রীনল্যান্ড কিনে নেওয়ার প্রস্তাব পর্যন্ত দিয়েছিল, যদিও তা সফল হয়নি।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের সঙ্গেও একটি চুক্তি করেছে। যুদ্ধরত ইউক্রেন রেয়ার আর্থে সমৃদ্ধ হলেও বর্তমানে সামরিক সহায়তার প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে বিনিয়োগ করে রেয়ার আর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করতে চাইছে। তবে এই প্রকল্প কতটা সফল হবে বা ইউক্রেন আদৌ উপকৃত হবে কিনা, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে।

রেয়ার আর্থ এখন আর শুধু একটি খনিজ সম্পদ নয়—এটি হয়ে উঠেছে এক গভীর ভূরাজনৈতিক অস্ত্র। বিশ্ব প্রযুক্তি ও সামরিক খাতের একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান হয়ে উঠেছে এই নীরব কিন্তু শক্তিশালী উপাদান। পশ্চিমারা এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে এই অস্ত্র নিজেদের দখলে নিতে। কিন্তু চীন ইতোমধ্যেই অনেকটা এগিয়ে গেছে এই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায়।

আগামী দিনে প্রযুক্তি নয়, রেয়ার আর্থ-ই হতে পারে বিশ্ব রাজনীতির নতুন লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু।

ফরিদ 

×