
ছবি: সংগৃহীত
কাশ্মীর—যে ভূমি একদিন ছিল সৌন্দর্য আর শান্তির প্রতীক, আজ তা যেন জীবন্ত এক বিষাদগাথা। প্রতিটি পাথর, প্রতিটি গাছ, প্রতিটি নদী যেন অতীতের কোনো গল্প বয়ে বেড়ায়—রক্ত, প্রতীক্ষা আর প্রার্থনার। তবুও, এমন বাস্তবতার মাঝেও কাশ্মীর স্বপ্ন দেখতে চায়।
যেখানে সকাল শুরু হয় সেনা টহলের শব্দে, সেখানে শিশুরা স্কুলে যাওয়ার পথে মাথা নিচু করে হাঁটে। টিউলিপের বাগানে ফোটে হাজারো রঙ, কিন্তু সেই রঙগুলো আনন্দের চেয়ে বেশি হয়ে ওঠে একরাশ প্রতীক্ষার প্রতীক—প্রতীক্ষা শান্তির, স্বাভাবিক জীবনের, নিঃশ্বাস নেওয়ার স্বাধীনতার।
কাশ্মীরি কৃষক জানেন না কখন আবার গোলাগুলি শুরু হবে, কখন বর্ডার বন্ধ হয়ে যাবে, কিংবা তার ফসল জব্দ হবে কি না। তবুও তিনি প্রতি মৌসুমেই জমি চাষ করেন। এটা শুধু জীবিকা নয়, এটা তার প্রতিবাদ, তার আশা, তার স্বপ্ন।
কাশ্মীরের তরুণেরা কবিতা লেখে—যেখানে তারা বন্দুক নয়, ভালবাসা আঁকে; সীমানা নয়, স্বাধীনতা চায়। তারা সামাজিক মাধ্যমে ছবি তোলে, ভিডিও বানায়, পেইন্টিং করে। এই সৃষ্টিশীলতা কোনো রাজনৈতিক বিবৃতির চেয়েও জোরালো, কারণ এরা বলে—"আমরা এখনও মানুষ, আমাদেরও স্বপ্ন আছে।"
একজন কাশ্মীরি মা যখন তার সন্তানকে বিদায় দেয় স্কুলে পাঠানোর সময়, তখন তার চোখে থাকে ভয়ের ছায়া, কিন্তু হৃদয়ে জেগে থাকে আশা—আজ যেন সে নিরাপদে ঘরে ফিরে আসে। সেই মায়েরা প্রতি রাতে ছাদে তাকিয়ে আকাশের তারা গোনেন, যেন কোনো দিন সত্যি শান্তির তারাটা আবার জ্বলবে তাদের জীবনে।
প্রতিবছর বসন্ত আসে কাশ্মীরে। বাদাম গাছে ফুল ফোটে, শালিমার বাগানে রঙ ছড়ায় টিউলিপ। প্রকৃতি যেন বলে, “আমি থেমে থাকবো না।” মানুষও থেমে থাকে না। তারাও বলেন—"আমরা এখনো স্বপ্ন দেখি। যুদ্ধের নয়, ভালোবাসার; বিভেদের নয়, বন্ধনের; অন্ধকার নয়, আলোর স্বপ্ন।"
শ্রীনগরের ডাল লেক কিংবা পেহেলগামের পাহাড়—সৌন্দর্যে যতই অপার হোক না কেন, সেখানেও সেনা টহল এখন বাস্তবতা। স্কুলের পথে থাকা শিশুরা জানে, তাদের শিক্ষা আজ শুধু বইয়ে সীমাবদ্ধ নয়—তাদের শিখতে হয় কিভাবে অস্ত্রের আওয়াজ চেনা যায়, কিভাবে কারফিউতে ঘরে বসে দিন কাটানো যায়।
প্রতি বসন্তে, কাশ্মীরের বাদাম গাছে ফুল ফোটে। টিউলিপ গার্ডেনে ছড়িয়ে পড়ে রঙের মেলা। যেন প্রকৃতি প্রতিবাদ জানায়, “আমরা এখনো ফোটাবো, আমরা এখনো জীবিত।” এই ফুলগুলো শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, বরং একটি জাতির জীবনের প্রতি তাদের দৃঢ় আশার চিহ্ন।
কাশ্মীরি যুবক-যুবতীরা ক্যামেরা হাতে তুলে নিচ্ছে বাস্তবতার কাহিনি। তারা ছবি তোলে, গান লেখে, কবিতা বলে—যেখানে শান্তি ফিরে আসার আহ্বান বাজে। কেউ কেউ বিদেশে পড়তে যাচ্ছে, কেউ আবার স্থানীয়ভাবে ছোট ব্যবসা গড়ে তুলছে। তারা হার মানতে শেখেনি, তারা জানে, কষ্টের মধ্যেই জন্ম নেয় নতুন ভোর।
আজকের কাশ্মীরি কিশোরেরা প্রশ্ন তোলে—কেন তাদের জীবন এত অস্থির? কেন তাদের স্বপ্ন অন্যদের রাজনীতির বলি হতে হবে? তাদের চোখে খেলা করে ক্ষোভ, কিন্তু সেই সঙ্গে থাকে একরাশ আশাও—যে একদিন, কোনও একদিন, তারা কেবল পরিচিত হবে মানুষ হিসেবে।
কাশ্মীর এখনও স্বপ্ন দেখে—একটি স্বপ্ন, যা শুধু তাদের নয়, পুরো মানবতার। সেই স্বপ্ন একদিন বাস্তব হোক, এটাই আমাদের প্রার্থনা।
এফএ