
ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে গত ২২ এপ্রিল ২৬ জন নিরীহ পর্যটক হত্যার ঘটনায় পাক-ভারত উত্তেজনা এখন চরমে। এ ঘটনায় উভয় দেশ পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ নিয়েছে। একে অপরের বিরুদ্ধে ক্রমাগত দিয়ে চলেছে রণহুঙ্কার। তবে যুদ্ধের এ দামামা মূলত পরিণত হতে চলেছে পানি যুদ্ধে। ভারত ঘোষণা করেছে যে তারা ১৯৬০ সালের সিন্ধু নদ পানি চুক্তি (ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি) আর মানবে না এবং এই চুক্তিকে অস্থায়ীভাবে স্থগিত রাখবে যতক্ষণ পর্যন্ত না পাকিস্তান (ভারতের দাবি অনুযায়ী) আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদ কার্যক্রম বিশ্বাসযোগ্য ও চূড়ান্তভাবে পরিত্যাগ করে। ভারতের এ সিদ্ধান্ত একটি ঐতিহাসিক বিপর্যয়কর মুহূর্ত ও যুদ্ধের আগমনী বার্তা। উল্লেখ্য, সিন্ধু নদ পানি চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে গত ৬০ বছর যাবৎ পাক-ভারত যুদ্ধ, সংঘাত ও কূটনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে গেলেও এই চুক্তিটি এতদিন অটুট ছিল।
১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের যুদ্ধ, ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধ, ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলা, ২০১৯ সালের পাল্টাপাল্টি বিমান হামলাÑ এসব রক্তক্ষয়ী ঘটনাবলি সিন্ধু নদ পানি চুক্তিকে ভাঙতে পারেনি। প্রচণ্ড বৈরী সম্পর্কের মাঝেও উভয় দেশের মধ্যে পানি বণ্টনের বিষয় ছিল বিরোধহীন ও স্থিতিশীল। কিন্তু এখন পানি সংক্রান্ত বিবাদ নিয়ে এক ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা ঘটতে চলেছে। সিন্ধু নদ হলো পাকিস্তানের কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহের অন্যতম প্রধান অবলম্বন। তাই ভারতীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পাকিস্তান দেখিয়েছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া। ফলে চিরশত্রু পাক-ভারতের পুরনো বৈরিতার মাঝে পানি নিয়ে আরেকটি নতুন ঝুঁকিপূর্ণ বিরোধের সূচনা হয়েছে। এ বিরোধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। পেহেলগাম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উভয় দেশ যেসব পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ নিয়েছে তা হয়ত এক সময় সমঝোতা-মীমাংসা হয়ে যাবে। কিন্তু পানি বিরোধের সমস্যা যে সহজে সমাধা হবার নয়, তা স্পষ্ট। এই বিবাদ আগামী দিনের ভূরাজনীতি ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে সংঘাতের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়াবে।
সিন্ধু নদের উৎপত্তিস্থল চীনের তিব্বতের হিমালয় পর্বতমালার কৈলাস শৃঙ্গের উত্তর ঢালের গোখার হিমবাহ থেকে, যার সন্নিকটে রয়েছে মানস সরোবর (হ্রদ)। সিন্ধু নদ চীনের তিব্বত সীমানায় ২৫৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে প্রবেশ করেছে ভারত অধিকৃত বিরোধপূর্ণ লাদাখ অঞ্চলে। অতঃপর নদটি ভারতের লাদাখ অঞ্চলে ৭০৯ কিলোমিটার পার্বত্য পথ পাড়ি দিয়ে ঢুকেছে পাকিস্তানের গিলগিট বাল্টিস্তানে। সেখান থেকে পাকিস্তানের খায়বার পাখতুনখোয়া এবং পাঞ্জাব প্রদেশ ঘুরে সিন্ধু প্রদেশের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত মিশেছে আরব সাগরে। পাকিস্তান জুড়ে সিন্ধু নদ মোট ১৯১৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে। অর্থাৎ পাহাড়ের উৎসস্থল থেকে সাগর সঙ্গম (সোর্স টু মাউথ) পর্যন্ত সিন্ধু নদের মোট দৈর্ঘ্য ২৮৮০ কিলোমিটার। সিন্ধু নদের উদ্ভবস্থল তিব্বতের মানস সরোবরে এসে জমে হিমালয়ের বরফগলা পানি। এটি সিন্ধু নদের পানির এক উৎস।
কিন্তু সিন্ধু নদের সব পানির উৎস তিব্বতের হিমালয় তথা মানস সরোবর নয়। সিন্ধু নদের বাম ও ডান তীরে চীন, ভারত, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে উৎপন্ন হওয়া এক ডজনের বেশি উপনদীর পানি এ নদকে করেছে ভরপুর ও বিস্তৃত। উপনদী তাকেই বলা হয় যা পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে সাগরে না মিশে বড় এক নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। সিন্ধু নদের বাম তীরে এরকম উল্লেখযোগ্য পাঁচটি উপনদী চীন ও ভারত থেকে উৎপন্ন হয়ে পাকিস্তান অংশে সিন্ধু নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। যেমন চীনের তিব্বতের মানস সরোবর থেকে শতদ্রু উপনদী, ভারতের হিমাচল প্রদেশ থেকে বিপাশা, রাভী ও চেনাব উপনদী এবং ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর উপত্যকা থেকে উদগত ঝিলাম উপনদী। এই পাঁচটি উপনদী ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পাকিস্তানের পাঞ্জাবে একত্রে মিলিত হয়ে নাম ধারণ করেছে পঞ্চনদ।
উল্লেখ্য, এ পঞ্চনদ থেকেই পাঞ্জাব নামকরণ হয়েছে। পঞ্চনদ একত্রে কিছুদূর প্রবাহিত হয়ে পাকিস্তানের মিঠানকোটে সিন্ধু নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ভারতীয় অংশে প্রবাহিত এই পাঁচটি উপনদীর ওপর নির্মিত হয়ে আছে কয়েকটি হাইড্রো প্রজেক্ট ও ড্যাম। ভারত যদি এই পাঁচটি নদীর পানি প্রবাহ আটকে দিয়ে পাকিস্তান অংশে যেতে না দেয় তাহলে সিন্ধু নদ অচিরেই মরা খালে পরিণত হবে। যা-ই হোক, সিন্ধু নদের ডান তীরবর্তী অঞ্চল তথা পাক-আফগান সীমান্তের কারাকোরাম, হিন্দুকুশ ও সুলাইমান পর্বত থেকে উৎপন্ন বেশ কয়েকটি উপনদী সিন্ধু নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম হলো আফগানিস্তানের কাবুল নদী যা পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে সিন্ধু নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। সুতরাং সিন্ধু নদ শুধু হিমালয়ের বরফ গলা পানির ওপর নির্ভরশীল নয় বরং তা একই সঙ্গে এসব উপনদীর পানির ওপর যথেষ্ট নির্ভরশীল।
১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পানি চুক্তি হয়, যা সিন্ধু নদের পানি চুক্তি (ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি) নামে খ্যাত হয়ে আছে। এই চুক্তি হয় বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতার মাধ্যমে। বিশ্বব্যাংক এই চুক্তি হওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়েছিল ৯ বছর ধরে। এই চুক্তি অনুসারে ভারত বিপাশা, রাভী (ইরাবতী) ও শতদ্রু নদীর পানি ব্যবহার করতে পারবে। অন্যদিকে সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব নদীর পানি পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করা হয়। এ তিন নদী থেকে পাকিস্তানকে ৮০ শতাংশ পানি সরবরাহের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। চুক্তির অংশ হিসাবে, ভারত পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ নদীগুলোর পানি ব্যবহার করতে পারে কেবলমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সীমিত সেচের মতো অ-ভোগ্য উদ্দেশ্যে। কিন্তু ভারত কোনোভাবেই পানি সংরক্ষণ বা পানির প্রবাহ পরিবর্তন করে ভাটির অঞ্চলের পানি প্রাপ্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারবে না। সিন্ধু নদ পানি চুক্তিটির কোনো মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ নেই এবং কোনো এক পক্ষ ইচ্ছা করলেই একে বাতিল কিংবা স্থগিত করতে পারবে না। চুক্তিটির ১২ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চুক্তিটি কেবল পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমেই পরিবর্তন করা যেতে পারে। এভাবে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে সিন্ধু নদ চুক্তিতে এসব বিধান সংযুক্ত করার ফলে পাকিস্তানের জন্য পানি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা মেলে। তাই এর ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তানের কৃষির পুরো সেচ এবং পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠে। দেশজুড়ে নির্মিত হয় বেশ কতক হাইড্রো পাওয়ার প্রজেক্ট ও ড্যাম। যেমন ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মীরের মিরপুর জেলায় ঝিলাম নদীর ওপর নির্মিত হয় মঙ্গলা ড্যাম। বর্ষার পানি ধরে রেখে পরে শুষ্ক মৌসুমে সরবরাহ করার জন্য এটি নির্মিত হয়।
১৯৭৬ সালে খায়বার পাখতুনখোয়া প্রদেশে নির্মিত হয় তারবেলা ড্যাম। বর্তমানে চীনের সহায়তায় গিলগিট বাল্টিস্তানে নির্মিত হচ্ছে সেদেশের সর্ববৃহৎ দিয়ামির বাশা ড্যাম। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পানি নিয়ে বিবাদ শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি হতে পেরেছিল ১৯৬০ সালের ওই চুক্তি অনুসারে। কিন্তু পেহেলগাম ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ভারত এখন আর এই চুক্তি না মানার ঘোষণা দিয়েছে। যদিও এই চুক্তি হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য এবং যা কোনো এক পক্ষ ইচ্ছা করলেই একতরফাভাবে হঠাৎ অস্বীকার, স্থগিত কিংবা বাতিল করতে পারে না। বস্তুত কোনো পক্ষ যদি একতরফাভাবে চুক্তি পালনে অস্বীকৃতি জানায় তবে তা হবে সব ধরনের আন্তর্জাতিক নিয়মের বরখেলাপ।
আন্তর্জাতিক আইন না মানলে অনেক ক্ষেত্রেই সূচনা হতে পারে যুদ্ধের। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে এরকম যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি যদি সত্যিই চিরতরে পাক-ভারত সিন্ধু নদ পানি চুক্তি ভঙ্গ করেন, তবে যুদ্ধ বেধে যাবে। কেননা পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে যে, ভারতীয় অংশে যে তিনটি নদী তাকে দেওয়া হয়েছে সেসবের ওপর ভারতের দ্বারা নতুন করে কোনো বড় ধরনের জলাধার নির্মাণের চেষ্টা হলো যুদ্ধের কাজ (অ্যাক্ট অব ওয়ার) হিসেবে বিবেচিত হবে।
সিন্ধু নদ তিব্বতে উৎপন্ন হয়ে ভারতের যে অংশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে সেই লাদাখ অঞ্চল পাকিস্তান, ভারত ও চীনের মধ্যে একটি বিতর্কিত অঞ্চল। উপরন্তু সিন্ধু নদের সিংহভাগ অংশ পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে বয়ে গিয়ে পড়েছে আরব সাগরে। তাই একে বলা চলে পাকিস্তানের নদী, ভারতের নদী নয়। সিন্ধু নদ পাকিস্তানের মানুষের জীবন যাপনের পথ (লাইফলাইন)। এ নদের ওপর বেঁচে আছে পাকিস্তানের কৃষি ও কৃষক এবং গ্রামগঞ্জ-শহর-উপশহরের জীবন-জীবিকা ও সভ্যতা। পানির অভাবে পাকিস্তানের পাঞ্জাব হয়ে উঠবে মরুময় অঞ্চল। সেখানে উৎপন্ন হবে না ফসল। পাঞ্জাবের সেচব্যবস্থা ও কৃষি বিপর্যস্ত হলে পাকিস্তানের পাঞ্জাবীরা নীরব থাকবে না। তাই পানির অভাবে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবে। পাকিস্তান বাধ্য হবে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে। পাকিস্তান একটি পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধ রাষ্ট্র। যুদ্ধে সে সেটা ব্যবহার করতেও পারে। এতে ভারতের হতে পারে অপূরণীয় ক্ষতি। কেননা ভারত পাকিস্তানের তুলনায় অনেক শিল্পসমৃদ্ধ দেশ।
তার জনসংখ্যার বিরাট অংশ বাস করে শহরে। কিন্তু পাকিস্তানের মানুষ সে পরিমাণ নগরকেন্দ্রিক নয় এবং শিল্প, কল-কারখানাও যথেষ্ট কম। তাই পাকিস্তানের শহরে পরমাণু বোমা ফেললে পাকিস্তানের যে পরিমাণ ক্ষতি হবে, তার তুলনায় ভারতের ক্ষতি হবে বেশি। আর এই যুদ্ধ বাধলে সেটা কেবল পাক-ভারতের মধ্যেই যে সীমিবদ্ধ থাকবে, তা বলা যায় না। চীনও এতে জড়িয়ে পড়তে পারে। আরও জড়িয়ে পড়তে পারে নেপাল। ভারতের সমর-সম্ভার পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু সমগ্র হিমালয় অঞ্চলে যুদ্ধ বেধে উঠলে সেটা সামাল দেওয়া ভারতের পক্ষে সহজ হবে না। ভারত ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীনের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। সে সময়ের চেয়ে ভারতের সমরশক্তি এখন যথেষ্ট বেশি। কিন্তু চীনও গড়ে তুলেছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সামরিক শক্তি, যা কোনোভাবেই ভারতের চেয়ে কম নয়, বরং বেশিই। পাকিস্তানের গোয়াদারে চীন গড়ে তুলেছে বিশেষ বন্দর ও নৌঘাঁটি। সেখানে গোপনে অবস্থান নিয়ে আছে একাধিক চীনা সাবমেরিন, যা পাক-ভারত যুদ্ধ বাধলে ভারতের বিপক্ষে ব্যবহৃত হতে পারে। আক্রান্ত হতে পারে মুম্বাই বন্দর। এছাড়া চীন পুরো লাদাখ ও তার দাবিকৃত পুরো অরুণাচল প্রদেশ দখল করতে চাইতে পারে। এদিকে ভারতের অভ্যন্তরে জাতিসত্তার বিরোধ এখনো বজায় আছে। হিন্দু-শিখ বৈরিতার কারণে পাঞ্জাবের শিখরা হাত মেলাতে পারে পাকিস্তানের সঙ্গেই। তারা স্বাধীন পাঞ্জাব রাষ্ট্র গড়ার জন্য তৎপর হয়ে উঠবে। অন্যদিকে ভারতীয় অংশের কাশ্মীরিরাও চায় ভারত থেকে মুক্ত হতে। পাক-ভারত লড়াই বাধলে এরাও নতুন উদ্যমে অস্ত্র ধারণ করবে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত বোন রাজ্যের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোও ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করবে।
বর্তমানে ভারত পানি আটকে দিয়ে পাকিস্তানকে মরুকরণের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা বাংলাদেশের ওপর প্রয়োগ করেছে অনেক আগেই। বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উজানে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ চালু হয় ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে। এরপর তিস্তা নদীর উজানে নির্মিত গজলডোবা বাঁধ চালু করে ১৯৯৮ সালে। সুরমা-কুশিয়ারা নদীর উৎসস্থল বরাক নদীর ওপর টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনায় রয়েছে ভারত। এভাবে ভারত বাংলাদেশের ৫৪টি যৌথ বা অভিন্ন নদীর জলপ্রবাহে তৈরি করেছে নানা প্রতিবন্ধকতা। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পানি পাওয়ার রয়েছে ন্যায্য অধিকার। কিন্তু ভারত সেই আন্তর্জাতিক আইনের কোনো তোয়াক্কা করে না। তবে ভারতের মনে রাখা প্রয়োজন যে সে নিজেও একটি ভাটির দেশ। কেননা সিন্ধু, শতদ্রু, কিন্নার ও ব্রহ্মপুত্র নদের উৎসস্থল চীনের তিব্বতের হিমালয় পর্বতমালায়। এমতাবস্থায় ভারত কর্তৃক আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের দেখাদেখি চীনও যদি সেই পথ অনুসরণ করে তাহলে ভারত পড়বে মারাত্মক পানি সংকটে। তখন পানির অভাবে ভারতের অবস্থা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতোই হবে সঙ্গীন। ফলে ভারত বাধ্য হবে চীনের দ্বারস্থ হতে । অন্যদিকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয়ে চীনের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে পানি প্রাপ্তির বিষয়ে চীনা হস্তক্ষেপ কামনা করতে পারে। সুতরাং ভারত পানি আগ্রাসন থেকে নিবৃত না হলে শিকারি যেমন কখনো কখনো নিজেই শিকারে পরিণত হয়, ভারতের অবস্থা তেমনই হতে পারে।
ব্রহ্মপুত্র নদের বাংলাদেশ অংশের নাম যমুনা। ব্রহ্মপুত্রে পর্যাপ্ত বরফ গলা পানি থাকায় যমুনা নদীতে এখনো যথেষ্ট পরিমাণ পানির দেখা মেলে। সিন্ধু নদের মতো ব্রহ্মপুত্র নদেরও উদ্ভব হয়েছে চীনের তিব্বতের মানস সরোবর থেকে। ব্রহ্মপুত্র নদের প্রথম ১৪৪৩ কিলোমিটার পড়েছে তিব্বতের মধ্যে। তাই এটি আসলে হলো তিব্বতের নদী। ভারতের মধ্যে এর যেটুকু অংশ পড়েছে তার দৈর্ঘ্য ৮০২ কিলোমিটার মাত্র।
তিব্বতে নদীটির নাম ইয়ারলুং সাংপো। সাংপো নদী যখন ভারতের অরুণাচল রাজ্য দিয়ে ঢুকে অসমের শেষ মাথায় পৌঁছেছে, তখন সেখানে এর নাম হয়েছে ডিহিং। সেখান থেকে নদীটি যখন অসমের সমভূমিতে এসে পড়েছে, তখন তার নাম হয়েছে ব্রহ্মপুত্র। চীন যদি আন্তর্জাতিক নদীর পানি বণ্টন সংক্রান্ত নীতি না মেনে সাংপো নদীর পানি কৃষিকাজে একতরফাভাবে ব্যবহার করতে চায়, তবে অসম প্রায় জলশূন্য হয়ে পড়বে। অবশ্য চীন সাংপো নদীর পানি একতরফাভাবে নিলে বাংলাদেশে যমুনা নদীও শুকিয়ে যাবে। তাহলে সেটা হবে বাংলাদেশের জন্য এক ভয়াবহ সংকটের কারণ। ভারত আন্তর্জাতিক নদীর পানি বণ্টনের সাধারণ নিয়ম না মানলে চীনও আন্তর্জাতিক নদীর পানি বণ্টন নীতিমালা না মানতে চাইতে পারে। ইতোমধ্যেই ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে চীন ১৩৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ শুরু করেছে। এ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বার্ষিক ৩০ কোটি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটাই হবে পৃথিবীর বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প।
কমন বা অভিন্ন নদীতে ভাটির দেশের সমান অধিকার থাকে। এটাই হলো আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি। এই সরল বোধটা ভারতের তরফ থেকে এতদিন উপেক্ষিত থেকেছে। কিন্তু এখন চীনের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় ভারত নিজেই পানির আবদার ও অধিকারের কথা তুলছে। সুতরাং এতদিন শুধু বাংলাদেশই পানির অভাবে দুর্ভোগে পড়েছে। এখন সেই কাতারে ভারতও যুক্ত হতে যাচ্ছে। এখানে অবশ্য বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। কেননা, ভারত এখন নিজেই ভাটির দেশের ন্যায্য পানি পাওয়ার অধিকারের কথা বলছে।
অতএব সেই সূত্রে ভাটির দেশ হিসাবে ভারতের সঙ্গে ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানির হিস্যায় বাংলাদেশেরও ন্যায্য অধিকার আছে। এখন বাংলাদেশ তার নদীর পানির সমান ও ন্যায্য হিস্যার কথা আরও জোরেশোরে তুলতে পারবে। আর ভারত-চীন পানি বণ্টন আলোচনায় বাংলাদেশেরও শামিল হওয়ার সম্ভাবনা ও সুযোগ তৈরি হয়েছে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
প্যানেল