নগরবাসীর সর্বোচ্চ জননিরাপত্তা বিধানের অঙ্গিকার নিয়ে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি) গৌরবের ৩৪ বছরে পা রাখছে আজ মঙ্গলবার (১ জুলাই)। আজ রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নগরবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন আরএমপির পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান। তিনি বলেন,জনগণের নিরাপত্তাই আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার।
তবে এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর চিত্রটা অনেকটাই ভিন্ন। গত বছরের ৫ আগস্টে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর সৃষ্ট সহিংসতার শিকার হয় রাজশাহী নগর পুলিশের সদর দফতরও। নগরজুড়ে পুলিশের স্থাপনা ও যানবাহনে চালানো হয় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। সেই ক্ষত নিয়েই ৩৪ বছরে পা দিল আরএমপি। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে আরএমপি। ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো মেরামত এবং অস্ত্র উদ্ধারে অনেকটা সফল হলেও এখনো পুরোপুরি সংকটমুক্ত হতে পারেনি তারা। জননিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে আছে লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র ।
আরএমপির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আগস্টের সহিংসতায় আরএমপি সদর দপ্তর, ডিবি অফিস, ট্রাফিক অফিস, বোয়ালিয়া মডেল থানাসহ মোট ১৬টি পুলিশী স্থাপনা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়। আগুনে পুড়ে যায় ৫৬টি যানবাহন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় ছিল, দুর্বৃত্তরা ১৬৪টি অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায়।
বিগত মাসগুলোতে এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নিরলস কাজ করেছে আরএমপি। ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনাগুলোর মধ্যে সদর দপ্তর, ডিবি অফিস, ট্রাফিক অফিস, কাশিয়াডাঙ্গা থানাসহ ৮টি ভবন সংস্কার করে কার্যক্রম স্বাভাবিক করা হয়েছে। নতুন ভবনে কাজ শুরু করেছে রাজপাড়া থানা। পোড়া ৫৬টি গাড়ির মধ্যে ২৯টি মেরামত করে রাস্তায় নামানো হয়েছে এবং নতুন ৪টি পিকআপ কেনা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় সাফল্য অস্ত্র উদ্ধারে। লুট হওয়া ১৬৪টি অস্ত্রের মধ্যে ১৪৭টি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বাকি ১৭টি অস্ত্র এখনো সন্ত্রাসীদের হাতে রয়ে গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা নগরীর নিরাপত্তার জন্য বড় একটি কাঁটা হয়ে বিঁধছে।
সংকটকালীন পরিস্থিতির মধ্যেও থেমে থাকেনি আরএমপির নিয়মিত কার্যক্রম। গত সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৯ মাসে মোট ১৬২৫টি মামলা দায়ের হয়েছে এবং ১৫৬৮ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মাদকবিরোধী অভিযানেও সক্রিয় রয়েছে নগর পুলিশ। এই সময়ে ১৪২ কেজি গাঁজা, ৫৯৪.৫ গ্রাম হেরোইন, ৯৯৩ পিস ইয়াবা, ২৯০০ পিস ট্যাপেন্টাডল ট্যাবলেটসহ বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে।
নাগরিকদের অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য চালু করা হয়েছে ‘আরএমপি তথ্য ও সেবা কেন্দ্র’। এ ছাড়া আরএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিট ৩৯৪টি হারানো মোবাইল ফোন উদ্ধার করে প্রকৃত মালিকের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করেছে। এদিকে, যানজট নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক বিভাগ ৫ হাজারের বেশি মামলা দিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকা জরিমানা আদায় করেছে এবং ৩৪৩৭টি যানবাহন আটক করেছে।
সাম্প্রতিক বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনার আসামিদের গ্রেপ্তার করে সফলতার পরিচয় দিয়েছে আরএমপি। এর মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে কোরআন পোড়ানোর ঘটনার মূলহোতা, অটোরিকশায় যৌন হয়রানির আসামি, দুই হাতে পিস্তল নিয়ে গুলিবর্ষণকারী রুবেল এবং পবা উপজেলায় টেন্ডার বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার অন্যতম। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে আরএমপির সামনে একদিকে রয়েছে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বস্তি, অন্যদিকে রয়েছে হারানো অস্ত্রের উদ্বেগ। সব মিলিয়ে এক মিশ্র অনুভূতি নিয়েই নতুন বছরে পা রাখল নগর পুলিশ।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নগরবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান বলেন, জনগণের নিরাপত্তাই আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার। তিনি বলেন, গত বছরটি আমাদের জন্য একটি কঠিন অগ্নিপরীক্ষার বছর ছিল। আগস্টের নজিরবিহীন সহিংসতায় আমরা আমাদের অবকাঠামো ও মনোবল উভয় ক্ষেত্রেই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু আমি গর্বের সাথে বলতে চাই, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে আরও শক্তিশালী হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, লুট হওয়া বাকি ১৭টি অস্ত্র উদ্ধার করা আমাদের জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার এবং একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জনগণের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা বিন্দুমাত্র ছাড় দেব না। এই সংকটকালীন সময়েও আমাদের অপরাধ দমন অভিযান থেমে থাকেনি। আলোচিত সব মামলার আসামি গ্রেপ্তার, মাদক উদ্ধার এবং নাগরিক সেবা, বিশেষ করে হারানো মোবাইল ফোন উদ্ধার করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা আমরা অব্যাহত রেখেছি।
তিনি বলেন, রাজশাহীর শান্তিপ্রিয় জনগণের সহযোগিতা আমাদের মূল শক্তি। রাজশাহীকে একটি নিরাপদ ও অপরাধমুক্ত নগরী হিসেবে গড়তে দৃঢ়ন প্রতিজ্ঞ। আরএমপি এখন আগের চেয়েও বেশি ঐক্যবদ্ধ।
প্রসঙ্গত, ১৯৯২ সালের ১ জুলাই রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ গঠিত হয়েছিলো। তখন এর যাত্রা শুরু হয়েছিলো মাত্র চারটি থানা ও ১০টি ফাঁড়ি নিয়ে। বর্তমানে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের অধীনে ১২টি থানা রয়েছে।
আঁখি
